ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই শেয়ারবাজারের এ রেকর্ড;###;বিনিয়োগের সুবাতাস

পুঁজিবাজারে শীর্ষে ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

পুঁজিবাজারে শীর্ষে ব্যাংক

রহিম শেখ ॥ ২০১৬ সালে সার্বিকভাবে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি আমদানি খাতও অনেক গতিশীল ছিল। এছাড়া সার্ভিস চার্জ থেকেও মুনাফার একটি বড় অংশ পেয়েছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংক গত বছরে পরিচালন মুনাফা করেছে ১৭ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর মুনাফা বেড়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২৫ ব্যাংকের। কমেছে তিন বেসরকারী ব্যাংকের। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্তসহ দুটি ব্যাংক মুনাফা হারিয়ে লোকসানে পড়েছে। তবে গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সূচক ও লেনদেনে রেকর্ড গড়েছে ঢাকার শেয়ারবাজার। ইতোমধ্যে লেনদেনে শীর্ষে উঠে এসেছে ব্যাংকিং খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অর্থনীতির অগ্রগতি বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবাতাস বইছে। অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাংকগুলো বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, পাশাপাশি নতুন নতুন কার্যক্রমও চলছে, যা ব্যবসায়ীদের মনোভাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগেরবারের মতোই এবারও পরিচালন মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারী খাতের ইসলামী ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দুই হাজার তিন কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল এক হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিদায়ী বছরে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। পরিচালন মুনাফার দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারী খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বছর শেষে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৬৮১ কোটি টাকা। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মুনাফা করে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বেসরকারী খাতের ব্র্যাক ব্যাংক। ২০১৬ সালে ৯২২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। এর আগের বছর ৪৬২ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছিল ব্র্যাক ব্যাংক। অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাংকটির। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক ৮৬১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। পঞ্চম ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৮০২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ষষ্ঠ অবস্থানে দি সিটি ব্যাংক ৭৫১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ৭০৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফা করে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। অষ্টম ইস্টার্ন ব্যাংক ৭০৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, নবম পূবালী ব্যাংক ৭০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং দশম অবস্থানে রয়েছে প্রাইম ব্যাংক ৬২৫ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ৬১৩ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৬১১ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৬০২ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ৫৯৩ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৫৭৪ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক ৫৪৭ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৫০৬ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক ৪৬৮ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক ৪৫২ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক ৪৪১ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ৪২২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ৪০২ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩৭৩ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৩৭০ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৩৫২ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৩৩২ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩১২ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংক ২৬১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ৩৯টি বেসরকারী ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বাদে আর সব ব্যাংকই মুনাফা করেছে। গত বছর আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লোকসান দিয়েছে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ৮৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। জানা গেছে, নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং ৪০ শতাংশ হারে (আগে ছিল সাড়ে ৪২ শতাংশ) কর্পোরেট কর দেয়ার পর ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার হিসাব হয়। আর এ নিট মুনাফার ওপরই নির্ভর করছে ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ নগদ ও স্টক লভ্যাংশ দেবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের। বেসরকারী খাতের মেঘনা ব্যাংকের এমডি নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্যাংকগুলোর ব্যবসা থেমে নেই। বিভিন্ন সময়ে দেয়া ঋণের বিপরীতে সব সময়ই নির্দিষ্ট হারে একটি আয় আসছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো এখন দেখেশুনে অনেক সতর্কতার সঙ্গে ঋণ বিতরণের কারণে খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। ফলে এবার প্রভিশনিংয়ের প্রয়োজনীয়তা কমে নিট মুনাফা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক বছর আগেও দেশের পুরো শেয়ারবাজারে একদিনে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন ছিল বহু আকাক্সিক্ষত। সেখানে এখন একদিনে ব্যাংক খাতেই ৫০০ কোটি টাকার উপরে শেয়ার কেনাবেচা নজর কেড়েছে। ইতোমধ্যে সূচক ও লেনদেনে ছয় বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। গত সোমবার বাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৮টির শেয়ারদর বেড়েছে। কমেছে একটির আর অপরিবর্তিত রয়েছে একটি ব্যাংকের শেয়ারের দাম। এ খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে গড়ে ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। মঙ্গলবারও ছিল একই চিত্র। ব্যাংক খাতের শেয়ারদর ও লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী জনকণ্ঠকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বর হিসাব বছর শেষে লভ্যাংশ ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার কিনছে। এতে এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ছে। পাশাপাশি লেনদেনও সাম্প্রতিক সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো প্রতি বছর অন্তত ১০ শতাংশ হলেও লভ্যাংশ দেয়। ব্যাংকগুলো নিজেদের ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রাখতে হলেও এ লভ্যাংশ দেয়। সে হিসাবে ব্যাংকগুলোর দাম নিচেই রয়েছে। তাছাড়া অন্য খাতের কোম্পানিগুলো অল্প লভ্যাংশ দিলেও তাদের যে শেয়ারের দাম হয় সে তুলনায় ব্যাংকের দাম কম। তাই বিনিয়োগকারীদের এদিকে আগ্রহ রয়েছে। তবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উর্ধতন কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপী ঋণ নিয়ে অনাস্থা রয়েছে। দিন দিন খেলাপী ঋণ যেভাবে বাড়ছে তাতে ব্যাংকের শেয়ারের দাম খুব বেশি বাড়া ইতিবাচক নয়। তবে খেলাপী ঋণ বাড়লেও সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্ন খাত থেকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রতি বছরই বাড়ছে। এজন্যই বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারের দিকে ভিড়ছেন।
×