ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

রুনি-ইংলিশ ফুটবলের কিংবদন্তি

প্রকাশিত: ০৫:০২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

রুনি-ইংলিশ ফুটবলের কিংবদন্তি

আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। খামখেয়ালি কাজকর্মের জন্য তিনি সর্বদাই থাকেন মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সর্বকালের সেরা এই ফুটবলারের সঙ্গে ক্রিকেটের আলোচিত চরিত্র শেন ওয়ার্নের মিল খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্রিকেটের সেরা লেগ স্পিনারের উল্টাপাল্টা কর্মকা-ের দরুন তাকে অভিহিত করা হয় ‘ক্রিকেটের ম্যারাডোনা’ হিসেবে। তবে ম্যারাডোনা একটি দিক থেকে ওয়ার্নের চেয়ে নিষ্কলুষ। অনেক সমালোচনা থাকলেও আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি কখনই। কিন্তু শেন ওয়ার্ন ক্রিকেটের পাশাপাশি এই বিষয়েও কম আলোচিত হননি। চারিত্রিক নোংরামির কারণে স্ত্রী সিমোনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ওয়ার্নের। ক্রিকেটের নষ্ট বালকের এমন অপকর্মের পর চাউর হয় গলফ সম্রাট টাইগার উডসের কাহিনী। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। যার জের ধরে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়েছে উডস-এলিনের। এরপর ক্রীড়াঙ্গনে স্ক্যান্ডালের এই ধারা বজায় রাখেন ইংলিশ ফুটবলার জন টেরি। ২০১০ বিশ্বকাপের আগে পরনারীর সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ফাঁস হওয়ার পর অধিনায়কত্ব হারান। এর সূত্র ধরেই আরেক ইংলিশ তারকা এ্যাশলে কোলের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তিনিও নাকি চুপিসারে অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত! এরপর ২০১০ সালেই এই ঘটনাকে প্রবাহিত করেন তারকা ফুটবলার ওয়েন রুনি। মেজাজী এই তারকারও নাকি অনৈতিক সম্পর্ক আছে! ক্যারিয়ারের উঠতি সময়ে এমন খবরে বেশ বিচলিত হয়েছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা। তবে বিষয়টি তিনি ভালভাবেই সামলে নিয়েছেন। যার প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত বছর ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। নতুন বছরের প্রথম মাসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়েও সর্বোচ্চ গোলের কীর্তিগাথা রচনা করেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই তিনি পেছনে ফেলেছেন কিংবদন্তি স্যার ববি চার্লটনকে। তাই তো রুনিকেও এখন বলা হচ্ছে ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার। দিন কয়েক আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে স্টোক সিটির বিরুদ্ধে ম্যাচ। ম্যাচে নিশ্চিত পরাজয় দেখছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেই সময় ত্রাতা হয়ে আসলেন ওয়েন রুনি। ম্যাচের ৯৪ মিনিটের সময় গোল করেন এ ইংলিশ স্ট্রাইকার। আর সেই গোলটি ঠাঁই করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। কারণ কিংবদন্তি ববি চার্লটনের করা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন এই গোলের মাধ্যমে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে রুনির এটি ২৫০তম গোল। ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটির পক্ষে সর্বাধিক ২৪৯ গোল করেছিলেন চার্লটন। এখন রুনিই হয়ে গেলেন সর্বকালের সেরা। এক প্রতিক্রিয়ায় রুনি জানান তিনি বিরাট মর্যাদার মনে করছেন এ রেকর্ডটিকে। তিনি মনে করেন এটা অনেক গর্বের অর্জন। চার্লটন নিজে মাঠে থেকে তার রেকর্ড ভেঙ্গে যেতে দেখেছেন। পরবর্তীতে ড্রেসিং রুমে গিয়ে রুনিকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে স্টোক সিটির নিজেদের মাঠ ব্রিটানিয়া স্টেডিয়াম। জুয়ান মাতার আত্মঘাতী গোলে শুরুতেই পিছিয়ে পড়া ম্যান ইউ আর সেটা পরিশোধ করতে পারছিল না। নির্ধারিত ৯০ মিনিট পেরিয়ে ইনজুরি সময়ের খেলা চলছে। সে সময়ই গোল করলেন রুনি। দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচান। আরেকটি ড্র যখন হতাশার সৃষ্টি করে গ্লানিময় করে তুলেছে রেড ডেভিলস শিবির, তখনও সেটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা নেই। কারণ রুনি অসাধারণ এক রেকর্ডই গড়েছেন। গোলটির মাধ্যমে শুধু দলকে পরাজয় থেকেই বাঁচাননি, সর্বকালের গোলের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন ক্লাবটির। ওল্ডট্রাফোর্ডে এর আগে সর্বাধিক ২৪৯ গোল করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ী ফরোয়ার্ড চার্লটন। তার রেকর্ড এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের শুরুতেই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন রুনি। বোর্নমাউথের বিরুদ্ধে লীগের উদ্বোধনী ম্যাচেই গোল করে সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছিলেন। এ কারণে প্রায় নিশ্চিতই ছিল যে চলতি মৌসুমেই নতুন রেকর্ড গড়বেন রুনি। কিন্তু সেটা হয়নি নানাবিধ কারণে। নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। অধিকাংশ ম্যাচেই ছিলেন বদলি খেলোয়াড় এবং কিছু ম্যাচে পুরোপুরিই বাইরে থেকেছেন। সেই বদলি হয়েই এবার ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ৩১ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার। এটি ছিল ইউনাইটেডের হয়ে তার ৫৪৬তম ম্যাচ। সে ম্যাচে ২৫০তম গোল পেয়ে গেলেন বদলি হিসেবে নেমে। ম্যাচের পর দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে রুনি বলেন, ‘এটা নারকীয় ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু। এটা সত্যিকারের একটা সম্মান এবং আমি খুবই গর্বিত বোধ করছি। যে খেলোয়াড়রা এই ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তারা সবাই ছিল বিশ্বমানের। আমি এ ক্লাবের হয়ে খেলতে পেরে গর্বিত। আর এখন সর্বকালের সেরা গোলদাতা হওয়াটা অনেক বড় সম্মান।’ এই গোলেই যে ববি চার্লটনের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস গড়েন রুনি। চলতি মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে এটা রুনির করা মাত্র দ্বিতীয় গোল। বোর্নমাউথের বিপক্ষে প্রথম গোলটি করেছিলেন টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিনেই। রেড ডেভিলদের হয়ে ২৫০ গোলের ১৮০টি করেছেন তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে। ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টে করেছেন আরও ৩৯ গোল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ১৩৬টি করেছেন নিজেদের মাঠে। এ্যাওয়ে ম্যাচে তার করা গোলের সংখ্যা ১০৬। এছাড়া ৮টি গোল করেছেন নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। রুনি ডান পায়ে করেছেন ১৯৩ গোল। ২৭টি করেছেন বাঁ পায়ে। এছাড়া বাকি ৩০ গোল করেছেন হেডে। রুনির রেকর্ড গড়াটা নিজে উপস্থিত থেকে দেখেছেন ৭৯ বছর বয়সী চার্লটন। ম্যাচ শেষে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। এ বিষয়টি আরও বেশি উৎফুল্ল করেছে রুনিকে। তিনি বলেন, ‘যখনই কেউ এ ক্লাবের হয়ে স্বাক্ষর করে সে বুঝতে পারে তিনি (চার্লটন) কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। গোল করে তাকে পেছনে ফেলার বিষয়টি এমন যা আমি কখনও করতে পারব বলে ভাবিনি। তার প্রতি আমার সর্বোচ্চ সম্মান আছে। তিনি ড্রেসিং রুমে আমার কাছে এসে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাকে অনেক সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল।’ চার্লটন পরবর্তীতে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ২৪৯ গোলের সর্বশেষটি আমি করেছিলাম। সে কারণে আমার কাছে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল যে আমি ক্লাবটির সর্বকালের সর্বাধিক গোলদাতা। এ কারণে আমি মিথ্যা কথা বলব না যে রেকর্ড হারানোর কারণে আমার মধ্যে হতাশা কাজ করছে না। কিন্তু তবু আমি ওয়েনের জন্য বেশ উৎফুল্ল। ইতিহাসের বইয়ে জায়গা পাওয়ার উপযুক্ত সে।’ অবশ্য রুনির এই রেকর্ডে আগ্রহ নেই ম্যানইউ কোচ জোশে মরিনহোর। স্পেশাল ওয়ান বলেন, এটা একটা দারুণ অর্জন। কিন্তু রেকর্ড ভাঙার পর এখন আবার রুনিকে সাধারণ একজন খেলোয়াড় হয়ে যেতে হবে। দলের জন্য আরও অনেক গোল করার চেষ্টা করতে হবে।
×