ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাজকিয়া নূর মুন

১৫০-এ যুবরাজের পুনর্জন্ম

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

১৫০-এ যুবরাজের পুনর্জন্ম

কটকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারসেরা ১৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন ভারতীয় তারকা যুবরাজ সিং। দীর্ঘ ষোল বছরের ক্যারিয়ারে ব্যাটে-বলে দারুণ সব মুহূর্ত রয়েছে, ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপে এক ওভারে ছয়-ছক্কা, ২০১১-এ টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারসহ আরও অনেক। তবু এই সেঞ্চুরির মাহাত্ম অন্যরকম, যুবি নিজেও সেটি স্বীকার করেছেন, ‘হয়ত এটাই আমার সেরা ইনিংস। শেষ সেঞ্চুরি করেছি সেই ২০১১ বিশ্বকাপে। দ্রুত তিন উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আমরা একটা পার্টনারশিপ করতে চেয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে। অন্যপ্রান্তে মাহী (ধোনি) ছিল, যার সঙ্গে আমার অনেক জুটির ইতিহাস রয়েছে। সে যখন ক্যাপ্টেন ছিল না, তখন এভাবে মন খুলে ব্যাট করত। এটা দারুণ অনুভূতি। বিশ্বাস ছিল আমরা দলকে বড় সংগ্রহ এনে দিতে পারব।’ ৩৫-এর শরীরটাকে ২৫ বছরের টগবগে যুবকের মতো ঝড়ঝড়ে করে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে বলেও জানিয়েছেন যুবরাজ। নিজেকে ফিরে পেয়ে ধন্যবাদ দিয়েছেন বাবা-মা, সদ্য বিবাহিত স্ত্রী-পরিবার, ভারতীয় কোচ-নির্বাচক, ভক্ত-অনুরাগী সবাইকে। যুবরাজের জীবনী নিয়ে দারুণ একটা সিনেমা হতে পারে, যার প্রতিটি দৃশ্যে থাকবে টান-টান উত্তেজনা; উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা, মৃত্যুকে জয় করে ফেরা...। মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়সে যা দেখেছেন, যা করেছেন, সেটি কম মানুষের জীবনেই হয়ে থাকে। তিন বছর পর এবার যখন ইংল্যান্ড সিরিজের ওয়ানডে দলে ডাক পেলেন, অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, নিন্দুকেরা সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, ভুলে গেছেন এই মানুষটাই দীর্ঘ আটাশ বছর পর তাদের বিশ্বাকাপ (২০১১) উপহার দিয়েছিলেন! কটকের দ্বিতীয় ম্যাচে ১৫০ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস উপহার দেয়ার পর অনেক প্রশ্নের ভিড়ে দুটি প্রশ্ন আলাদা করে রাখতে হয়। এটাই কি আপনার সেরা ইনিংস, অথবা, এই সেঞ্চুরিতে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? ‘হয়ত এটাই জীবনের সেরা ইনিংস। সত্যি বলতে, অন্যের কাছে নয়, নিজের কাছেই নিজেকে প্রমাণ করার সময় এসেছিল। কঠোর সাধাণার মধ্য দিয়ে যখন নিজে বলতাম, যুবি তুমি ফুরিয়ে যাওনি।’ উত্তর যুবরাজের। বারবাতি স্টেডিয়ামে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনকেই নষ্টালজিয়ায় ভুগিয়েছেন যুবরাজ ও মহেন্দ্র সিং ধোনি। ২৫ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর চতুর্থ উইকেটে দু-জনের ২৫৬ রানের জুটি। যুবরাজ ১২৭ বলে ১৫০ (২১ চার, ৩ ছক্কা), ধোনি ১২২ বলে ১৩৪ (১০ চার, ৬ ছক্কা)। ভারত ৬ উইকেটে ৩৮১। প্রত্যাবর্তনে ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস যুবরাজের (১৪তম সেঞ্চুরি)। নেতৃত্ব ছাড়ার পর ম্যারাথন ধোনি, তিন ভার্সনে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার প্রথম মিশনেই এক ম্যাচ হাতে রেখে কোহলির সিরিজ জয়। অনেক অনেক রেকর্ড। আলোচনার শেষ নেই। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে যুবরাজের ইনিংস। ক্যান্সার জয় করে বেঁচে থাকাই যেখানে বড় কথা, সেখানে ৩৫ বছর বয়সে বাইশ গজে পুনর্জন্ম! স্রেফ অবিশ্বাস্য। ক্যান্সার থেকে সের ওঠার পর ডাক্তার সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘জানি না সে আর কখনো প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরতে পারবে কিনা।’ যুবরাজ ফিরেছেন, সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে, একেবারে রাজার বেশে। টানা তিনটা বছর ছিলেন ওয়ানডে দলের বাইরে। যদিও ক্ষুদ্রতম ফরমেট টি-২০ ম্যাচে যাওয়া আসার মধ্যেই ছিলেন জাতীয় দলে। তবে এবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে ও টি-২০ উভয় সিরিজের দলেই আছেন অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের ম্যাচটা ভাল হয়নি- প্রথম ওয়ানডেতে মাত্র ১৫ রানেই বিদায় নিয়েছিলেন। ৩৫ বছর বয়সী এ বাঁহাতি ফুরিয়ে গেছেন এমন গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। কিন্তু নিজেকে আবার নতুন করে চেনালেন বৃহস্পতিবার। কটকে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস উপহার দিলেন যুবরাজ। পুরনো সেই বিধ্বংসী মেজাজেই তিনি মাত্র ১২৭ বলে ২১ চার ও ৩ ছক্কায় ১৫০ রান করে ফিরে যান। ইংল্যান্ড বরাবরই যুবরাজের প্রিয় প্রতিপক্ষ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় ৪০ এর নিচে। কিন্তু ইংলিশদের বিরুদ্ধে দুরন্ত যুবরাজের ব্যাটিং গড় ৪৭.৪২! আর কোন টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে এত ব্যাটিং গড় নেই তার। আর সেটাই যেন জ্বলে ওঠার কারণ হয়ে গেল। তার আগে প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে পুনেতে মাত্র ১৫ রান করে বিদায় নেয়ার পর যেন টগবগ করে ফুটছিলেন এ অভিজ্ঞ বাঁহাতি। সেটার প্রভাব পড়ল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। লোকেশ রাহুলের পর অধিনায়ক বিরাট কোহলি বিদায় নিলে ক্রিজে আসেন যুবরাজ। কিন্তু তার সঙ্গী হিসেবে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না আরেক ওপেনার শিখর ধাওয়ান। দলীয় ২৫ রানের মধ্যে ৩ টপঅর্ডার সাজঘরে ফেরায় বিপর্যয়েই পড়ে যায় ভারতীয় দল। পেসার ক্রিস ওকস ওই ধ্বংসের শুরু করেছিলেন। চাপের মধ্যে থেকে সদ্য সাবেক হওয়া অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে সঙ্গে নিয়ে সাবলীলভাবেই খেলতে থাকেন যুবরাজ। চতুর্থ উইকেটে গড়ে ওঠে ২৫৬ রানের বিশাল জুটি। এটি ছিল ওয়ানডে ইতিহাসে চতুর্থ উইকেটে দ্বিতীয় সেরা উইকেট জুটি। এর আগে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও অজয় জাদেজা জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ২৭৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েছিলেন। সেটাই এখন পর্যন্ত এ উইকেটের সেরা জুটির রেকর্ড। ক্যারিয়ারের ১৪তম সেঞ্চুরি পেয়ে যান যুবরাজ। ধোনির আগেই বিদায় নেন তিনি। কিন্তু ততোক্ষণে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলে ফেলেছেন। ২০০৩ সালে ক্যারিয়ারের সেরা ১৩৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন যুবরাজ সিডনিতে। এবার সেটাকে ছাড়িয়ে যান তিনি। ১৫০ রান করে থামেন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ওকসের চতুর্থ শিকারে পরিণত হয়ে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের এটিই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় অবশ্য এর স্থান যৌথভাবে পাঁচে। ২০১১ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেছিলেন যুবরাজ। সেবার দ্বিতীবারের মতো ওয়ানডের বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তোলে ভারতীয় দল। কিন্তু বিশ্বকাপের পরই পারফর্মেন্সে অবনতি ঘটতে থাকে এ অলরাউন্ডারের। মাঝে দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগেছেন। ক্যান্সারকে হারিয়ে আবার খেলায় ফিরেছিলেন টি-২০ ফরমেটে। কিন্তু নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি বলে অনিয়মিত হয়ে যান। সে কারণে ওয়ানডে দলেও আর ঠাঁই হয়নি নিয়মিত। ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছিলেন। সর্বশেষ সেঞ্চুরিটা ছিল ২০১১ সালেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে সেই শতক হাঁকান। তারপর থেকে আরও ১৬ ইনিংস ব্যাট করেছেন। কিন্তু ভাল কিছু করতে পারেননি। বিশ্বকাপের ওই সেঞ্চুরির আগেও ১৭ ইনিংসে মাত্র ২ ফিফটিসহ ১৮.৩২ গড় ছিল তার ব্যাটিংয়ের। সেখান থেকে ভালভাবেই নিজেকে ফিরে পেলেন। রাজসিক এক সেঞ্চুরিতে জানিয়ে দিলেন এখনও ফুরিয়ে যাননি।
×