এমন বিভীষিকাময় সিরিজ-এর আগে হয়ত দেখেনি কেউ। দলগত পারফর্মেন্স নয়, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে এবার চরম প্রতিপক্ষ হয়ে খেলেছে ইনজুরি আর বৈরি আবহাওয়া। বড় বড় কয়েকটি ইনজুরির সঙ্গে ছিল ধারাবাহিক পরাজয়। নিউজিল্যান্ড সফরের শেষদিকে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা কায়মনে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিলেন- জয়, পরাজয় কিংবা ড্র কিছুই প্রয়োজন নেই, দলের ক্রিকেটারদের সুস্থভাবে দেশে প্রত্যাবর্তন। শেষটাও হয়েছে পরাজয় দিয়ে। ওয়ানডে ও টি-২০ সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়া দলটি টেস্টেও ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়েই দুর্দশার যবনিকাপাত ঘটিয়েছে। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে আর কোন ইনজুরির ছোবল হানা দেয়নি এটাই সবচেয়ে সুখকর ব্যাপার। যদিও পেসার রুবেল হোসেন ডানহাতের কনুইয়ে তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন। ৮-০ ব্যবধানে হেরে যাওয়া বাংলাদেশ দলের ইনজুরির তালিকাটাই বেশি কষ্টের। সীমিত ওভারের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম, অপরিহার্য ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক ও ইমরুল কায়েস কিছু সময়ের জন্য ছিটকে গেছেন। সবমিলিয়ে একেবারে বিধ্বস্ত এক চেহারা নিয়ে দেশে ফিরছে বাংলাদেশ দল। ফেব্রুয়ারিতে আছে ভারত সফর এবং মার্চে শ্রীলঙ্কা সফর। এর আগে এখন ক্রিকেটারদের এই ইনজুরি নিয়েই বড় চিন্তার ভাঁজ।
দুঃসহ পরিস্থিতির শুরু মুশফিককে দিয়ে। সিরিজের প্রথম ম্যাচ, ২৬ ডিসেম্বর প্রথম ওয়ানডেতে তিনি হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির ধাক্কায় ব্যাট করতে করতেই মাঠ ত্যাগ করেন। এরপর আর বাকি ওয়ানডে ও টি-২০ সিরিজ খেলা হয়নি। ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সুস্থতা অর্জন না করেই তিনি প্রথম টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিতে নামেন। ব্যাটিংয়ের সময় পান ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল আর বাম হাতের তর্জনিতে আঘাত। তবু ১৫৯ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দেন ব্যথানাশক স্প্রে করে খেলা চালিয়ে গিয়ে। কিন্তু টানা দুদিন আর মাঠেই নামেননি। তার পরিবর্তে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন ইমরুল। তিনিও কোমরের ব্যথায় শেষদিনে কিপিং করতে পারেননি। দায়িত্ব পালন করেছেন সাব্বির রহমান। মুমিনুল হকেরও ঊরুতে হালকা চিড় ধরা পড়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় মাথায় আঘাত পেয়ে মুশফিক হাসপাতালে চলে যান। আর ব্যাটিং-ই করতে পারেননি তিনি। এ তিনজনই আর দ্বিতীয় টেস্টে খেলতে পারেননি। ওয়ানডে সিরিজেও হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলেন ইমরুল। টি-২০ সিরিজে সবচেয়ে বড় ব্যথা পান অধিনায়ক মাশরাফি। বোলিংয়ের সময় ফিরতি বল ঠেকাতে গিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ফেটে যায় তার। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছে তাকে। টি-২০ সিরিজে ইনজুরির কবলে পড়েন তামিমও। হাতে ব্যথা পান। ইনজুরির এ দীর্ঘ মিছিল যেন শেষই হচ্ছিল না। নড়বড়ে একটা দল নিয়ে সফরের শেষ ম্যাচ ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে নামে বাংলাদেশ দল। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় এবার ব্যথা পান পেসার রুবেল। কনুইয়ে বল লাগার পর উইকেটেই শুয়ে পড়েন তীব্র ব্যথায়। অবশ্য পরবর্তীতে এক্সরে থেকে জানা যায় তিনি বিপদমুক্ত।
এমন দুঃসহ সব ঘটনার সঙ্গে যোগ হয়েছিল দলের টানা ব্যর্থতা। যার পেছনে মূলত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিউজিল্যান্ডের অচেনা পরিবেশ এবং অপরিচিত উইকেট। এবারের নিউজিল্যান্ড সফর নানা কারণে ভুলে যাওয়াটাই ভাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য। শুরু থেকেই সফরকারী বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। তীব্র শীতের সঙ্গে অচেনা পরিবেশ ও ভিন্নধর্মী উইকেটে এবার নিউজিল্যান্ডে প্রথম থেকেই সংগ্রামের মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ফলে গত দুই বছরে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য সেটা পুরোপুরি টলে যায়। ওয়ানডে ও টি-২০ উভয় সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ দল। টেস্ট সিরিজে এ কারণে খুব বেশি প্রত্যাশার কিছু ছিল না। প্রথম টেস্টের মাঠ বেসিন রিজার্ভে শীতের সঙ্গে ছিল ঝড়ো হাওয়া। বলের গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠাটাই দায়। এমনকি একজন মানুষের পক্ষেও ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্যাটিংয়ের সময় সেই বাতাসের ঝাপটাকেও সামাল দিয়ে ক্রিজে থাকতে হয়েছে। তবু ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান করে বিশ্ব ক্রিকেটকে চমকে দেয় বাংলাদেশ। সেটি ছিল টেস্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক এবং ন্উিজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ৫ শতাধিক রানের ইনিংস। ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন পঞ্চম উইকেটে। যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে এটিই সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। দেশের পক্ষে তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে টেস্টে সর্বাধিক ব্যক্তিগত ২১৭ রানের ইনিংস উপহার দেন সাকিব। আর মুশফিক ব্যথা সয়েও খেলেন ১৫৯ রানের অসাধারণ একটা ইনিংস। এক দিনেই সাকিব করেন ২১২ রান। টেস্টের একদিনে ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড এটি বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আর বিশ্বে ৪১তম। বাংলাদেশের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরিয়ান তিনি। অর্জন বলতে শুধু এটুকুই। আর প্রথম টেস্টে চারদিন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ম্যাচের পঞ্চম দিনে বিপর্যস্ত হয়। ওই একদিনেই ফলাফলটা হয়ে যায় পরাজয়ের গ্লানি!
দলীয় পরাজয়গুলো ঠেকানো যায়নি ছোটখাটো লড়াই ছাড়া। পুরো সিরিজে বাংলাদেশের পেসাররা দারুণ বোলিং করেছেন। ওপেনার সৌম্য সরকার রানে ফিরেছেন, পেসার তাসকিন আহমেদের টেস্ট অভিষেক হয়েছে। ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন পেসস্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমান। যদিও টেস্ট সিরিজে তিনি খেলেননি পিঠের ব্যথার কারণে। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে দারুণ কিছু করা নিয়ে বড় একটা সংশয় ছিলই। সেটার ছাপ পড়ে দলের প্রথম ইনিংসে। মাত্র ২৮৯ রানেই প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। দ্বিতীয় দিনশেষে স্বাগতিক কিউইরা ৭ উইকেটে ২৬০ রান তুলেছিল। সফরকারী বোলাররা যে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে করে মনে হচ্ছিল বেশ ভাল অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। তৃতীয় দিন বৃষ্টির কারণে ভেসে যায়। সোমবার ম্যাচের চতুর্থ দিনেও মাঠ ভেজা থাকার কারণে আগেভাগে খেলা শুরুর কথা থাকলেও হয়নি। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর সবকিছুই গেছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৭৩ রানে গুটিয়ে গেছে দল পুরো সফরে সবচেয়ে বাজে ব্যাটিংয়ের নজির দেখিয়ে। তাই শেষটা আরও খারাপভাবেই হয়েছে। বাংলাদেশ দলের হোয়াইটওয়াশ লজ্জায় আরেকটি মাত্রা যোগ হয়। তিন ফরমেটেই এবার কিউই সফরে ব্যর্থতার ষোলকলা নিয়ে শূন্য হাতে ফিরবে এখন দল। সবমিলিয়ে ৮-০ ব্যবধানে এবার নিউজিল্যান্ড সফরে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু হাপ ছেড়ে বেঁচেই গেছে বাংলাদেশ দল এবং দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। নিউজিল্যান্ড সফরটা হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। সেটা থেকে অবশেষে রক্ষা পেয়েছে দল। এবার আগামী সিরিজে এ হারিয়ে ফেলা মনোবল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো আসন্ন ভারত সফর কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে দলকে। প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলবে এবার বাংলাদেশ। এরপর মার্চেই আছে শ্রীলঙ্কা সফর। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তিন ফরমেটে ৮-০ ব্যবধানে হেরে মনোবল হারিয়ে ফেলা দলটি অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে পড়বে। নিজেদের ফিরে পাওয়াটা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি ক্রিকেটারদের ইনজুরি থেকে ফিরে আবার মাঠে ভালভাবে ফেরাটা কঠিন।