ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাফসান সাবাব খান

স্মরণ ॥ অফিসার ক্যাডেট সাদমান একটি অনুপ্রেরণার নাম

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

স্মরণ ॥ অফিসার ক্যাডেট সাদমান একটি অনুপ্রেরণার নাম

মিলিটারি জীবনযাপনে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য সব সময় মুখে হাসি ধরে রাখাটা অনেকটাই একটা অসম্ভব কাজ বলা যায়। কিন্তু এই একটা দিক থেকে সাদমানকে দেখতাম আর অবাক হতাম। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ৪৫তম ইনটেকের ক্যাডেট ছিল সাদমান (ক্যাডেট নং ২৪০৩, হুনাইন হাউস)। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে নিজেদের বাড়িতেই বড় হয় সে। গত ২ জানুয়ারি সিলেটে, বেসিক প্যারা কমান্ডো কোর্সের অংশ হিসেবে তার চতুর্থ জাম্পটি সম্পন্ন করার পথে না ফেরার দেশে চলে যান সাদমান। দুটো প্যারাস্যুটের একটাও ঠিকমতো কাজ করেনি দুর্ভাগ্যক্রমে। ৬০০ মিটার উঁচু থেকে পড়ে আর প্রাণে রক্ষা হয়নি অফিসার ক্যাডেট সাদমানের। ক্যাডেট জীবনের শুরু থেকেই পুরোটা সময় খুব দুরন্তপনার মধ্যে কাটত ওর দিনগুলো। স্টাফরা কোনমতেই তার পিছু ছাড়ার সময় পেতেন না। কিন্তু মাঠে নামলেই দুরন্তপনাটাকে পুরোদস্তুর কাজে লাগাত সে। খেলার মধ্যে বাস্কেটবল আর ফুটবলটাই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। এ্যাথলেটিক্সে ক্লাস এইট থেকেই লং জাম্প, ট্রিপল জাম্প কিংবা কোন একটা ট্র্যাক ইভেন্টে মেডেল তার থাকতই। কিন্তু সাদমানের কথা মনে হলেই সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে ওর ড্রামস বাজানোর কথা। ইনটেকের সেরা ড্রামার ছিল ছেলেটা। বেশ ভাল একটা ব্যান্ড টিম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। এখনও মনে আছে শেষ পারফমেন্সের দিন ড্রামস্টিক ঘুরাতে ঘুরাতে স্টেজে উঠল সাদমান, আর অডিটরিয়ামজুড়ে তার সাড়া। ওর নিজের বাড়িতেই যখন ওকে শেষ বিদায় জানাতে গেলাম, ওর রুমে তখনও ড্রাম সেটটা পড়েছিল। চোখের সামনে ভেসে আসছিল ঝাপসা এসব স্মৃতি। পড়াশোনার দিকে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু রেজাল্ট সবসময়ই ধরে রাখত কিভাবে যেন। বিশেষ বিশেষ কিছু বিষয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে দেখতাম ওকে। যেমন ক্লাস ১১ এর দিক থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে শুরু করল ইংরেজী নিয়ে কাজকর্ম। দুরন্ত প্রকৃতির কারণে শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব একট মধুর ছিল না। কিন্তু বকাঝকা খেয়ে কখনও খুব মন খারাপ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সব সময় মুখে হাসি। বরং সাদমান ব্যস্ত থাকত বাকি সবাইকে হাসি খুশি রাখতেই। এই একটা জিনিস দেখে সব সময় মুগ্ধ হতাম। কিভাবে এত কিছুর মাঝেও একটা মানুষ এতটা হাসি খুশি থাকতে পারে। বিএমএতে যাওয়ার ইচ্ছা কতটুকু জোরালো ছিল তা ঠিক জানতাম না। কিন্তু অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যে ওর পারফরমেন্স খারাপ হবে না, এইটুকু নিশ্চিত ছিলাম। একের পর এক তার প্রমাণও দিতে থাকল বন্ধু সাদমান। শুনেছিলাম বিপিসি কোর্সটাতে নাকি সবাই চান্স পায় না। দরকার নিখুঁত ফিটনেসের। নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই জায়গা করে নিয়েছিল সেখানেও। বাবা মায়ের সামনে ফাইনাল জাম্পের আগে ২ জানুয়ারি রাতের জাম্পটিই ছিল শেষ পরীক্ষা। জাম্প সিকুয়েন্সে শেষ পালা সাদমানের। কেন যেন ঠিক তখনই অঘটনটা ঘটতে হলো। নিচ থেকে দেখে নাকি মনে হচ্ছিল একটা ইন্ডিকেটর লাইট খুব বেশি তাড়াতাড়ি ফল করছে। নিচ থেকে অনেক চিৎকার করা হলো রিজার্ভ প্যারাসুটের কথা বলে। গতি কমল না সাদমানের। মুহূর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যায় সবখানে। শোক আর বিস্ময়ে কাতর সাদমানের বাবা-মাকে সান্ত¡না দেয়াটা ছিল প্রচ- কঠিন একটা কাজ। পরদিন দুপুর ৩.১৫ এর দিকে সাদমানের মরদেহ নিয়ে কোটচাঁদপুর মাঠে ল্যান্ড করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। এর আগে সিলেটে জানাজা সম্পন্ন হয়। কোটচাঁদপুরে বাদ আসর সম্পন্ন হয় আরেকটি জানাজা। পুরো এলাকার মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল শেষ বারের মতো একবার সাদমানকে দেখতে। জানাজার পর নিজ বাড়িতেই দাফন করা হয় সাদমানকে। কাউকে নিজ হাতে মাটি দেয়া যে এতটা কষ্টের হতে পারে তা এভাবে না শেখালেও পারত আমাদের এই বন্ধুটা। কোন না কোন একদিন আমাদের সবাইকেই হয়ত বিদায় নিতে হবে। সাদমানের চলে যাওয়াটা ছিল অসময়ে। কিন্তু অল্প এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে সাদমান। হাসতে হাসতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া বলে যদি কিছু থাকে তবে তার দৃষ্টান্ত ছিল ওর জীবনের কঠিন সময়গুলো। একই কোর্সে আমাদেরই অনেক বন্ধু ওই ইন্সিগ্নিয়াটার জন্য জীবনবাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছে। চোখের সামনে একটা বন্ধুকে চলে যেতে দেখেছে সবাইকে কাঁদিয়ে। কিন্তু ওরা পিছপা হয়নি। সাদমানকে উৎসর্গ করেই ৫ জানুয়ারি সম্পন্ন করেছে এই কোর্সটি, শেষ জাম্পটা সম্পন্ন করার মাধ্যমে। ঠিক এভাবেই আমাদের সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে সাদমান, সব সময়, হাসিমুখে। লেখক : প্রাক্তন ক্যাডেট, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ (৪৫তম ইনটেক) অফিসার ক্যাডেট সাদমানের বন্ধু।
×