ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকারের দক্ষতা

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকারের দক্ষতা

জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে এ সরকারকে কঠিন কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিশেষ করে একের পর এক জঙ্গী হামলায় সরকারকে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নানা রকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু দুই দফায় ৮ বছর শাসনামলে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে এ সরকারের দক্ষতা পরীক্ষিত এখন। হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত জঙ্গীদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখন এ সরকারের পুলিশ-র‌্যাবের কাছে। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনায় সরকার কঠিন সঙ্কটে পড়ে গত বছরের ১ জুলাই। ওই রাতে জঙ্গীরা গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২০ জন দেশী-বিদেশী নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গীদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দু’জন কর্মকর্তা। বিশ্ব কাঁপানো এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। শান্ত বাংলাদেশের পরিচয় নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়। এমনকি শেখ হাসিনার শুভাকাক্সক্ষী হয়েও বিশ্ব নেতাদের অনেকে নিজ দেশে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। এ সরকারের সবচেয়ে বড় বন্ধুদেশ জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে নিজ দেশেই প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। অবস্থা এখন সেই তিমিরে নেই। এখন ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে জাতির সামনে। হলি আর্টিজানে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের নৃশংসভাবে হত্যার পর ভেতর থেকে তাদের ছবি তুলে মারজানের কাছে পাঠিয়েছিল জঙ্গীরা। মারজান সে সব ছবি পাঠান তামিম চৌধুরীর কাছে। তামিম ওই সব ছবি আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক নিউজে’ পাঠায়, যা ওই রাতে ইন্টারনেটে প্রচার পায়। তামিম ও তাওসিফ গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়। মারজান নিহত হয় গত ৭ জানুয়ারি গভীর রাতে ঢাকায় এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’। সরকারের বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত জঙ্গী দমনের কৌশল। বলা হচ্ছে- মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, সাহসী সিদ্ধান্ত, পেশাগত সততা এ সরকারের সন্ত্রাস-জঙ্গী দমন অভিযানকে সফলতা এনে দিয়েছে। গত ছয় মাসে ১৩ জঙ্গী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে নিহত হয় নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। একজন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি তিনজন হলেন রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর, বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ও সাগর। সাগর সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছান, যা পরে হামলাকারীরা ব্যবহার করেন। আর সফটওয়্যার প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফায় হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। সেই টাকা গুলশান হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে শোনা যায়। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, এমন ১৭ জনকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা। বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন, মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি ও তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার হন। গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গী হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাস্টিকার ছাত্র মীর সামেহ মোবাশ্বের, মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম এবং বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। তারা সবাই পরদিন সকালে সেনা কমান্ডদের অভিযানে নিহত হন। সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘উন্নত দেশ হতে করণীয়’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্যারিস ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক রেমি। সফরকালে উন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের করণীয় কী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা এ রকম যে, উন্নত দেশ হতে হলে দেশে শান্তি থাকতে হবে। ওই অধ্যাপক একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে মত প্রকাশ করে বলেছেন, সম্ভবত প্রথম কাজটি হবে শান্তি বজায় রাখা। অসন্তোষ, আন্দোলন, সহিংসতা, যুদ্ধ, সন্ত্রাস উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। একটি দেশ এসব সমস্যায় আক্রান্ত হলে উন্নয়নের সঠিক পথ খুঁজে পায় না। বাংলাদেশে শান্তি বজায় রাখা তুলনামূলক সহজ। কারণ এখানে বেশিরভাগ মানুষই একই জাতির, একই ভাষায় কথা বলে এবং তাদের ধর্মও একই। ওই অধ্যাপকের মতে, আফ্রিকার অনেক দেশ শুধু জাতিগত সহিংসতার কারণে উন্নয়নের সম্ভাবনা বিনষ্ট করেছে। এ সরকারের ৮ বছরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল- জঙ্গীবাদ। যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতে থাকে ঠিক তখন থেকেই জঙ্গী সমস্যা নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশে। বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার শুরু হওয়া ছিল অকল্পনীয় বিষয়। কারণ ১৯৭৫ এর আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধী রাজাকার প্রসঙ্গটি এমনভাবে ডুবিয়ে দেয়া হয়- যা কোন দিনই ভাসমান হওয়ার ছিল না। এটা নিশ্চিত হয়েই বঙ্গবন্ধুর খুনী ও ঘাতকদের বিচার করা যাবে না মর্মে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন করেছিলেন জেনারেল জিয়া। কারণ, ভিন্ন পথে ক্ষমতা দখলে অভ্যস্ত জেনারেল জিয়ার পরবর্তী সকল অপচেষ্টা ছিল গণতন্ত্রবিরোধী। আর এখনও সেই পথই চিন্তা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারসহ বিভিন্ন হত্যাকা-ের বিচার শুরুর মাধ্যমে দেশে যে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বিএনপি-জামায়াতের চিন্তার বাইরে। দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সúক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করাকে তাদের অপছন্দ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে উঠছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচার হয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার হচ্ছে। এ রকম বহু অন্যায়-অপরাধ এবং জঙ্গীবাদের বিচার চলছে। যারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করে, লাখো শহীদের রক্তাক্ত পতাকা তারা তুলে দিয়েছিল, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের সাজা হয়েছে, যাদের সাজা কার্যকর হয়েছে এ সরকারের হাতে। খালেদা জিয়া তাদের আহ্লাদ করে পতাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। যারা ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান, চোরাকারবারী আর দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দেশকে দিতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের নামে পুড়িয়ে শত শত মানুষ হত্যা করল। মায়ের সামনে ছেলেকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, বাবার সামনে তার সন্তানকে পুড়িয়ে মারল। এই বীভৎস দৃশ্য কে সৃষ্টি করেছিল? প্রায় ৫ হাজার গাড়ি পোড়াল, আরও প্রায় ২ হাজার গাড়ি ভাঙচুর করা হলো। ১৮টি রেল, ৭০টি সরকারী অফিস, ৫ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই চক্র পুড়িয়ে দিল। ৬টা ভূমি অফিস পোড়াল। লঞ্চ, রেল, সরকারী অফিস, বিদ্যুতকেন্দ্র কোন কিছুই বাদ ছিল না। সব জায়গায় আঘাত, স্কুল পোড়ানো হলো, এর পর মানুষ হত্যা করা হলো। রাস্তার পাশের হাজার হাজার গাছ তারা কেটেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তারা হামলা করেছে। সেই সময় ২০ জন পুলিশ সদস্য হত্যা করা হলো, বিজিবি সদস্যকে হত্যা করা হলো। ডিজিএফআইর একজন অফিসারকে পর্যন্ত হত্যা করা হলো। আর তা এখন তো দিবালোকের মতো সত্য- সব রকম হত্যা, ষড়যন্ত্র ও কৌশলে ব্যর্থ হয়ে জঙ্গীবাদকে নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কারা? লেখক : সাংবাদিক
×