ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলাদেশ ঘুরে মনে যে প্রত্যয় জন্ম নিয়েছে

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশ ঘুরে মনে যে প্রত্যয় জন্ম নিয়েছে

গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকটা বাংলাদেশে ছিলাম। এবার কাজের চাপ একটু কম ছিল। তাই মানুষজনের সঙ্গে বেশি মিশতে পেরেছি। নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনের পরের দিনটাতেই নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে দেখা করেও দেশের রাজনীতির তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করেছি। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন খুবই জনপ্রিয়। তার বিরোধী বিএনপির অনেক নেতার মুখেও এবার তার প্রশংসা শুনেছি। কেউ কেউ তো বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হাসিনা নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। এটা আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু ১৬ দিন দেশ ঘুরে এসে আমারও মনে হয়েছে শেখ হাসিনা নিজে জনপ্রিয় বটে; কিন্তু তার দল তেমন জনপ্রিয় নয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, মন্ত্রী, এমপির বিরুদ্ধে জনসাধারণের মনে প্রচুর ক্ষোভ বিদ্যমান। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকায় বড় দল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল। শেখ হাসিনা যথাসময়ে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক পদে বসিয়েছেন। তাতে এই প্রাচীন বটবৃক্ষে নতুন পাতা গজাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দলের জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে। তবে ওবায়দুল কাদের একা কিছুই করতে পারবেন না, যদি আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্রুত একটি ত্যাগী ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে না পারেন। দেশের তরুণ প্রজন্মের চোখে দেশ গড়ার একটা নতুন স্বপ্ন জাগাতে না পারেন। দেশের তরুণেরা আওয়ামী লীগকে কী চোখে দেখে তা এবার একটু জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। বিভ্রান্ত তরুণদের যে অংশ হতাশা, বেকারত্ব ও প্রকৃত শিক্ষার অভাবে উগ্রপন্থা ও ধর্মান্ধতার দিকে ঝুঁকেছে তাদের কথা বলছি না, যে অংশে তারুণ্যের স্বপ্নের মশাল এখনও নেভেনি, যারা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ গঠনে এখনও আস্থাবান, তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতাকে ধরে রেখেছে বটে, কিন্তু কতদিন ধরে রাখতে পারবে সে সম্পর্কে তারা সন্দিহান। তাদের মতে, সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে পড়েছে। দেশের বাম দলগুলোর এখন সত্যই বামদশা। বড় বাম দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেছে বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগে ডানপন্থীদের দাপটের মুখে কোন প্রভাবই বিস্তার করতে পারছে না। স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকে সিপিবি, ন্যাপ (মুজাফ্ফর), গণতন্ত্রী দল প্রভৃতি আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট না হয়েও এই বড় দলটির নীতি নির্ধারণে বাতিঘরের কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর বাহুতে শক্তি জুগিয়েছে। দলটিকে ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পরে পড়তে দেয়নি। এখন সেই অবস্থা নেই। অতীতে আওয়ামী লীগ রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কালচার দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং পরিচালিত হতো। এখন দলটি অসাম্প্রদায়িক দল বলে দাবি করলেও বিএনপি ও জামায়াতের ধর্মীয় রাজনীতির কালচার দ্বারা প্রভাবিত। ফলে দলের তরুণ অংশও বিভ্রান্ত। এবার ঢাকায় অবস্থানকালে তাদের কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক কালচারের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন না। এই হতাশা ও বিভ্রান্তি থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেক নেতা ও কর্মী আদর্শহীনতায় ভুগে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নানারকম সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে পুরোপুরি ফিরে না এলে দলের এবং সহযোগী দলগুলোর ভেতরে পচনরোধ করা যাবে না। এতসব কিছুর পরেও বলব, আওয়ামী লীগের অনেক স্খলন পতন সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্মাণে দলটির এবং হাসিনা নেতৃত্বের কোন বিকল্প এখনও নেই। ভারতে বাম ও গণতান্ত্রিক শিবির একটি বড় ভুল করে এখন বিপর্যয়ে পড়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বে ও সংগঠনে যত অবক্ষয় ঘটে থাকুক এটিই ভারতে সর্ববৃহৎ দল, যে দলটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলে। অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে গঠিত সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্য সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস এক নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষতার সেøাগান সামনে এনে বহুকাল পর জয়ী হয়েছিল এবং ক্ষমতায় এসেছিল। দিল্লীতে কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফিরে আসা বড় বাম রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সহ্য হয়নি। বড় বুর্জোয়া দল হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যে বহু ভুলত্রুটি ও স্খলন-পতন আছে। কিন্তু এই কংগ্রেসের বিকল্প আরেকটি সর্বভারতীয় অসাম্প্রদায়িক দল গড়ে ওঠা অথবা বামজোট কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠার আগেই আমেরিকার সঙ্গে সহযোগিতার অজুহাতে কংগ্রেস সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার এবং কংগ্রেস-বিরোধিতার রাজনীতিতে নেমে একটি বাম গণতান্ত্রিক জোটের কি লাভ হয়েছে? দিল্লী করতলগত হয়েছে প্রচ- সাম্প্রদায়িক এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা বিজেপির। অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের বিকল্প এখন ঘোর সাম্প্রদায়িক বিজেপি। ভারতের বামপন্থীদের কণ্ঠে এখন একটাই গান -“নাক দিয়ে নরুন পেলাম, তাক ডুমাডুম ডুম।” স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের বিকল্প দল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল অবিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির। তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে তারা তা পারেননি। স্বাধীনতার পর অবিভক্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল অসাম্প্রদায়িক জাতীয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিকল্প দল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র দৃঢ়মূল হওয়ার আগেই অবাস্তব বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক দেয়া এবং সমাজ বিপ্লবের নামে ইনফেনটাইল এডভেনচারিজম দলটিকে বিভক্ত ও ধ্বংস করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও সেনাপতি জিয়ার নেতৃত্বের নয়, তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প দল হয়ে গড়ে উঠতে যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সমর্থক কিছু নেতাও ছিলেন এই দলে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে পরাজিত করে বিএনপি ক্ষমতাতেও গিয়েছিল। কিন্তু অচিরেই বিষ বৃক্ষের মতো এই দলে গজিয়ে উঠল তারেক রহমানের নেতৃত্ব। স্বাধীনতার শত্রু জামায়াতীদের আত্মীয় সম্বোধন করে তিনি তাদের গলা জড়িয়ে ধরলেন। শুরু হলো আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে স্বাধীনতায় মূল আদর্শগুলোর বিরোধিতা। ভারতের বিজেপির মতো অসাম্প্রদায়িক নামের আড়ালে বিএনপি বর্তমানে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। অতীতের মুসলিম লীগের আদর্শের অনুসারী। এই পদস্খলনই বিএনপির বর্তমান দুর্ভাগ্যের কারণ। নইলে তাদের জনবল আছে, জনসমর্থনও আছে। তা সত্ত্বেও কবে তারা আবার ক্ষমতায় যেতে পারবেন তা অনেক বড় জ্যোতিষীও বলতে পারবেন না। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল দরকার। তবে তার চরিত্র হতে হবে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্ম নিরপেক্ষ, এই বিকল্প গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগের মতো শক্তি ও জনসমর্থন নিয়ে গড়ে ওঠার আগে আওয়ামী লীগকে আঘাত করার অর্থ হবে অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক তালেবান শক্তিকে ক্ষমতায় ডেকে আনা। ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী এই চেষ্টাটি করতে গিয়ে বিএনপি ও জামায়াতকে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করেছেন। নিজেরা রাজনীতিতে ফসিল হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেননি। হতাশ কাদের সিদ্দিকী মনোবেদনায় এখন বলে বেড়াচ্ছেন “স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে ভুল করেছি।” সিপিবি, জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম ইত্যাদি বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলো এখন খরচের খাতায়। কয়েকজন বড় কম্যুনিস্ট নেতা এখন খবরের কাগজের কলামিস্ট হয়ে পুরনো তত্ত্বের জাবর কেটে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন। দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল নেই। এই শূন্যতা দীর্ঘকাল বিরাজ করা ভাল নয়। বিরাজ করলে অশুভ ও অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথা তোলার সুযোগ পায়। এ জন্যে আওয়ামী লীগেরও উচিত, দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল যাতে গড়ে ওঠে তাতে সাহায্য জোগানো। এবার ঢাকায় অবস্থানকালে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ সরকার এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. বারকাতের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। রাজনৈতিক মতবিনিময়ও হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ এখন আগের মতো শক্তিশালী নয়। কিন্তু মঞ্চ এখনও টিকে আছে এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধে নিষ্ঠ। ইমরান আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মঞ্চকে এই সময় রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করা ঠিক হবে কিনা? আমি বলেছি হবে না। করলে তা গণফোরাম, বা আবদুর রাজ্জাকের বাকশালের পরিণতি বরণ করবে। গণজাগরণ মঞ্চকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র রক্ষায় একটি প্ল্যাটফরম হিসেবে অদলীয় ভিত্তিতে আবার শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এই মঞ্চের কাজ হবে আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র, সেকুলারিজম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পথে ধরে রাখার জন্য প্রচ- প্রেসার গ্রুপ হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ। আওয়ামী লীগে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীরা যাতে মাথা তুলতে না পারে সেজন্যে ওয়াচ ডগের দায়িত্ব গ্রহণ, যে কাজটি স্বাধীনতার আগে সিপিবি, ন্যাপ, প্রভৃতি দল করেছে। আওয়ামী লীগকে বিরোধিতার সময় এটা নয়। এই বিরোধিতা আওয়ামী লীগের ভেতরে বাইরে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীদের সাহায্য জোগাবে। ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকীর আওয়ামী লীগ বিরোধিতা দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাহায্য জোগাচ্ছে না। সাহায্য জোগাচ্ছে ডান প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরকে। মনে হলো, ইমরান সরকার আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তাকে বলেছি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের হতাশা তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা সৃষ্টি করেছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের ভেতরে বাইরে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার, যে আন্দোলন আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে এবং দলটি সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের হতাশা দূর করে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে। আওয়ামী লীগের এখনও দুটি বড় মূলধন আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের এখনও ঘুরে দাঁড়াবার সময় আছে। লন্ডন: ২৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৭
×