ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে একান্ত সাক্ষাতকারে অর্থমন্ত্রী

শেখ হাসিনা অনেক বড় রোল মডেল -আবুল মাল আবদুল মুহিত ॥ সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭

শেখ হাসিনা অনেক বড় রোল মডেল -আবুল মাল আবদুল মুহিত ॥ সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়

প্রশ্ন : ৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে এসে আপনার কেমন লাগছে? আর যে বছরটি পার হয়ে এলেন সে বছরটি সম্পর্কেও আপনার মন্তব্য কি? উত্তর : আমার তো বেশ ভালই লাগছে। আমি যে ৮৩ বছর পূর্ণ করলাম তাতে বেশ তৃপ্তি পাচ্ছি এ জন্য যে, গত বছর আমি যে কাজে লিপ্ত ছিলাম, তাতে বাধা-বিপত্তি খুব কম ছিল। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি মনে করি যে, শান্তি এবং আইনের রাজত্ব না থাকলে আমার বেশ অসুবিধা হয়। জনগণের খুশি মনে কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হয়, এটা এই বিগত বছরে ছিল না। প্রশ্ন : তার মানে আপনি বলছেন যে বছরটি পার করে এলেন সেটা খুবই ভাল বছর? উত্তর : খুবই ভাল বছর। প্রশ্ন : অবশ্য ওই বছরে হলি আর্টিজানসহ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এটা কি অর্থনীতির ওপর ইমপ্যাক্ট ফেলেছে? উত্তর : না, তেমন পড়েনি। এটা নিয়ে একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জঙ্গীদের দমনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূলত এককভাবে যে দৃঢ়তা প্রকাশ করেন তার ফলে সেই আশঙ্কা কার্যকরী হয়নি। প্রশ্ন : আমরা দেখেছি, হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে আপনাকে জাপান যেতে হয়েছে- উত্তর : আমি জাপান গেলাম, মৌলবাদী আক্রমণে জাপানের সবচেয়ে বেশি লোক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জঙ্গীরা যাদের হত্যা করে তাদের বেশিরভাগই ছিল জাপানী। জাপানীরা এদেশে কাজ করছে সম্ভবত ১৯৫৮ সাল থেকে, অনেক জাপানী এখানে আমাদের গৃহবধূ। জাপানের তাতে একটি প্রশ্ন জাগেÑ তারা কি এখানে বন্ধু বলে গৃহীত হচ্ছে না? আমার জাপান সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের নিশ্চিত করা যে, আমাদের দেশে তাদের আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি এবং তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব। আমাদের দেশে মূলত বিদেশীরা খুব সমাদৃত এবং জাপানীরা সহজে আমাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন বলে আমরা তাদের বিশেষ সুনজরে দেখি। আমি সেটাই জানাতে জাপানে যাই যে, জঙ্গীবাদ আমরা কোন মতোই সহ্য করছি না এবং করব না। আমরা ইতোমধ্যে বিদেশীদের নিরাপত্তা বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তাও জাপানীদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার ফলে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে জাপানীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসেছেন এবং নতুন উদ্যোম নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এসব কর্মীর পরিবার এখনও খুব সাবধানে আমাদের দেশে ফিরে আসছেন। আমার মনে হয় অচিরেই সে বিষয়ে অগ্রগতি হবে। প্রশ্ন : এ ধরনের কাজগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই করার কথা কিন্তু আপনি কেন গেলেন, সিনিয়র বা অর্থমন্ত্রী এ জন্য? উত্তর : যেহেতু জাপান এখানে আমাদের উন্নয়ন কাজে গভীরভাবে লিপ্ত এবং দ্বিপাক্ষিকভাবে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বেশি। সে জন্য তারা আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে যায়। প্রশ্ন : জাপানী কর্তৃপক্ষ এখন পুরোপুরি সন্তুষ্টÑ যে নিষেধাজ্ঞা তাদের নাগরিকদের প্রতি আছে সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত কি? উত্তর : তারা উইথড্র করবে- অলরেডি করেছেও। আমাদের প্রচুর বন্ধু জাপানে আছেন। যেমন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী তারো আসো। তার আগে বহুদিন তিনি জাপানী জনপ্রতিনিধিদের বাংলাদেশ ককাসের নেতা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের এখানে এসে বড় বড় প্রকল্পের সহায়তার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে যান- সব মিলে এখন বিষয়টি ভালোর দিকে। প্রশ্ন : এবার একটু ভিন্ন প্রশ্ন করি, ৮৩ বছর বয়সেও-বীচ কার্নিভ্যাল ক্রিকেট, কনসার্ট- সব কিছুতেই ভীষণ রকম উপস্থিতি আপনার; অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরে এগুলো কিভাবে সম্ভব? উত্তর : এটাই আমার শক্তি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ বেশ জটিল। সেখানে বিনোদনের প্রয়োজন আছে সেটা অন্য কাজ থেকে পাই। প্রশ্ন : গান এবং খেলা এ দুটোতেই উপস্থিতি কি ছোটবেলা থেকে? উত্তর : আমি পড়াশোনায় সব সময়ই ভাল ছিলাম। আমার আকর্ষণ শুধু পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। আমি নিজে গান গাইতে পারি না- তবে উপভোগ করি। খেলাধুলা খারাপ করতাম না। তবে যে খেলাটি বাংলাদেশে সব সময়ই হয় অর্থাৎ ফুটবল তাতে কোন দিন ভাল করেনি- প্রশ্ন : কোন্ কোন্ খেলাগুলো আপনি বেশি ভাল করতেন? উত্তর : আমি টেনিস খুব ভাল খেলতাম। তখন আমাদের স্যান্ডার্ড তেমন ভাল ছিল না। তবে আমাদের যুগে আমি একজন ভাল টেনিস খেলোয়াড় ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, রানার্সআপ হয়েছি। ভলিবল ভাল খেলতাম। বাস্কেটবলও মন্দ খেলতাম না। হকিতে ভাল ছিলাম। টেনিস ও হকিতে ক্যাপ্টেন ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তান অলিম্পিকে, বিভিন্ন খেলায় আম্পায়ারের ভূমিকাও পালন করেছি। বলতে গেলে আমার মানসিকতাটা ছিল এ রকম যে, খেলাধুলা না করলে তৃপ্তি হয় না। সে জন্য একটু চেষ্টা করেও খেলাধুলা করা উচিত। আমাদের দেশে খেলাধুলার সময় খুব নির্দিষ্ট। বৃষ্টির ক’মাসে খেলাধুলা হয় না। এ জন্য আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওই সময়ে শরত-হেমন্ত ও শীত- এই ছয় মাসে নিজের ক্লাসগুলো এমনভাবে সাজাতে চেষ্টা করতাম যাতে ২টার পরে আমার কোন ক্লাস না থাকে। খেলতে গিয়ে একবার খুব নার্ভাস হয়েছি, ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক টেনিস প্রতিযোগিতায় ঢাকা ক্লাবের এক নম্বর কোর্টে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ যুবক খেলোয়াড় সাঈদ হাইয়ের সঙ্গে একক টেনিস খেলায়। প্রথমে সম্ভবত চারটে গেমে আমি কোন বলের মোকাবেলাই করতে পারলাম না। তারপরে একদম ভাগ্য এবং চিন্তার দৃঢ়তায় একটি খেলায় জয় পেয়ে দারুণ হাততালি পেলাম। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দুই সেটে খেলায় ফয়সালা হয় এবং আমার কৃতিত্ব ছিল আমি প্রতি সেটে একটি করে খেলা জিতি। প্রশ্ন : তাহলে একটা প্রশ্ন আপনাকে করাই যায়, এখন যে ঢাকার বাচ্চাদের খেলার কোন মাঠ নেই- এটা সরকারের একজন হিসেবে আপনাকে কষ্ট দেয় না? উত্তর : অবশ্যই খুব কষ্ট দেয় এবং খারাপ লাগে। আমি খুব খুশি যে ধানম-ি ৭ নম্বর রোডের নিকটস্থ মাঠটাকে এক সময় (বাপার নেতা যখন ছিলাম তখন) উদ্ধার করতে সক্ষম হই। আরও ভাল লাগে যে মেয়র হানিফের সহায়তায় উত্তরায় খেলার মাঠে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে সক্ষম হই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান যে ধারণা আমাদের সরকার পোষণ করে তাতে একটি বিদ্যালয়ে মাঠের জন্য জমি নির্দিষ্ট করা বাধ্যতামূলক। এক একর জমি না থাকলে স্কুল স্থাপন করা যায় না। যদিও বহুতল ভবনে স্কুল স্থাপন এখন নিয়মিত ব্যবস্থা। আমার নির্বাচনী এলাকায় আমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য খেলার মাঠ স্থাপনে বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছি। দক্ষিণ সুরমায় একটি খেলার মাঠ স্থাপনের জন্য জমি দেখছি। শাহপরান এলাকায় খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, ফুটবল একাডেমি এগুলো স্থাপনের কার্যক্রম চলমান। অনেক স্কুলের মাঠ বেদখল হয়ে গেছে, সেখানে কয়েকটি স্কুল মিলে উন্মুক্ত মাঠ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া উচিত। প্রতি উপজেলায় সরকার উন্মুক্ত এলাকার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এগুলো স্টেডিয়াম নয়- তবে বড় খেলার মাঠ যেখানে নানা ধরনের খেলাধুলা চলতে পারে। অনেক খেলায় বড় মাঠের প্রয়োজন হয়ও না, যেমন- হাডুডু, ভলিবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন। সারা দেশে খেলার মাঠ নির্মাণে এই সরকার বিশেষ কার্যক্রম চালু রেখেছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল টেনিস আর টেনিসের জন্য আমাদের চাপে বর্তমানের টেনিস গ্রাউন্ড সৃষ্টি হয়। তখন সেখানে কোন গ্যালারি ছিল না। আমরা চারটি মাঠ তৈরি করি। সেগুলো সবই ছিল গ্রাস কোর্ট। এ ব্যাপারে আমাদের সহায়ক ছিলেন খাজা সদরুদ্দিন। তিনি নিজে খেলতেন এবং আমাদের সহায়তা করতেন। তিনি সম্ভবত তখন ঢাকা ক্লাবে টেনিস খেলা দেখাশোনা করতেন। ঢাকা ক্লাবের সঙ্গে প্রায় সংশ্লিষ্ট লন টেনিস এ্যাসোসিয়েশনের এই চারটি কোর্টের দেখাশোনা তিনি করতেন। আমাদের সময়ে ছাত্র মহলে ভাল ভাল খেলোয়াড় ছিল। আবদুল ওদুদ, শামসুল আলম, আসাদুল হক খসরু ও শাহ মনোয়ারুল ইসলাম। প্রশ্ন : মন্ত্রী হওয়ার পর আপনার জন্মবার্ষিকীতে আমি প্রথম যে সাক্ষাতকার নেই- সেখানে আপনি বলেছিলেন, আমাদের অন্যতম একটি রফতানি খাত হতে পারে খেলনা, বর্তমানে তার অবস্থা কি? উত্তর : আমরা গার্মেন্টসে ইতোমধ্যেই এক নাম্বার অবস্থান করে নিয়েছি। তখন উঠতি অন্য শিল্পের কথা মনে আসলেই খেলনা শিল্প, আসবাবপত্র ও জুতা এবং চামড়াজাত দ্রব্যাদি এগুলোর কথা মনে পড়ত। চামড়াজাত দ্রব্য এখন ভাল করছে। এখন আমাদের দ্বিতীয় খাত পাটশিল্প। যে রকম শক্তিশালী খাত ছিল তা না হলেও পাটশিল্প এখনও সদম্ভে বিরাজ করছে। রফতানি অবশ্য কম। কিন্তু দেশে পাট দ্রব্যাদি ব্যাপকভাবে এখন ব্যবহৃত হয়। খেলনা সম্পর্কে আমার বিশেষ আগ্রহের কারণ হলো এটার চাহিদা চিরদিনই ব্যাপক। এখানে খেলনা প্রস্তুত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল সহজেই আমদানি করা যায়। বস্ত্র এবং পোশাক এখনও ৮২ শতাংশের মতো বৈদেশিক রফতানি আয়ের সূত্র। এরপরে আসে ফ্রোজেন ফুড, তৃতীয়টা পাট, তারপর আইসিটি। খেলনার রফতানির সুযোগ এখনও রয়েছে। প্রশ্ন : আপনাকে সব সময় কোন না কোন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত দেখি, পরিবারে নিশ্চয়ই সময় দিতে পারেন নাÑ আসলে কি আপনার ফ্যামিলি একে মেনে নেয়? উত্তর : আমার পরিবারে, আমি যে এই রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকি এ ব্যাপারে তাদের কোন অভিযোগ নেই। আমার স্ত্রী ঘর দেখাশোনা করেন। সন্তানদের দেখাশোনা তাঁর বড় কর্তব্য মনে করেন। লেখাপড়ায় আমার স্ত্রী তাঁর সময়ে ভাল ছাত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইচ্ছে করলে একটি ভাল সর্বক্ষণিক চাকরি নিতে পারতেন। সে চেষ্টা তিনি কখনও করেননি, পারিবারিক জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এরই কারণে আমার ছেলেমেয়েরা আমার কাছ থেকে সে রকম সময়ের দাবি করে না। প্রশ্ন : আরেকটি বিষয়Ñ আপনি যেমন আপনার পরিবার থেকে সব সময় সহযোগিতা পাচ্ছেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনা আপনাকে কি মাপে সহযোগিতা করেন; তাঁর সঙ্গে আপনার কাজের ধরনের একটু বিস্তারিত বলবেন? উত্তর : শেখ হাসিনার সঙ্গে অনেক রাজনীতিবিদের সম্পর্ক মামা বা চাচা। তারা বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ছিলেন। তাদের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি অনেক অল্প বয়সের। আমি ছাত্র রাজনীতি করেছি ৫৬ সাল পর্যন্ত। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে অনেক গিয়েছি। কিন্তু তখন শেখ হাসিনার তেমন সময় হয়নি আমাকে জানবার বা চেনবার। আমার চাকরি জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সচরাচর দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল। যখন আমি স্পোর্টস ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তারপরে যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চাকরির সময়ে শেখ হাসিনা তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় হয়নি। আমি সরকারী চাকরি ছাড়ি ১৯৮১ সালে। তারপরে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূচনা। ১৯৮৬ সালে তাঁরই আহ্বানে আমার তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়- একজন উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী যখন হলেন তখন বেশ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে আমার বেশ যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় যখন আমি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটি জাতীয় সর্বসম্মত কার্যক্রম প্রণয়ন। এই সময় সরকারী কর্মকা- সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক, যদিও আমি চাকরি করি অত্যন্ত নির্দিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে। আমার একটি জাতীয় কর্মসূচী ড. কামাল হোসেন হাইজ্যাক করে সেটাকে গণফোরাম নামের রাজনৈতিক দলের মেনিফেস্টো বানিয়ে ফেললেন। স্বাভাবিকভাবে শেখ হাসিনা আমার ওপর রুষ্ট হন। তিনি ভাবলেন, আমি কামাল হোসেনের দলের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। আমি কিন্তু গণফোরামে এক বছরও ছিলাম না এবং আমি আবার বৈদেশিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকের কাজ নিয়েই তখন ব্যস্ত থাকি। ২০০০ সালের দিকে ঠিক করলাম যে, আমি এখন ওই সব কাজকর্ম কমিয়ে দিয়ে অবসরে যাব। সে জন্য কিছুদিন আমাকে বেশ রোজগার করতে হলো, যাতে আমি ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের পেনশন ফান্ড বানালাম। এর একটি বিশেষ কারণ ছিল, আমি ব্রিটিশ আমলের আইন অনুযায়ী অবসর গ্রহণ করি এবং পঁচিশ বছর চাকরি করে অবসর নেই। যাতে আমার হাতে টাকা পয়সা খুবই কম ছিল। আমি এককালীন টাকা পেলাম দুই লাখের নিচে। মাসিক পেনশন হলো মাত্র ৯শ’ টাকা। যা হোক, ২০০০ সালে আমি আমার পেনশন ফান্ড প্রায় ঠিক করে ফেলি এবং দেশে নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করি। সে সময় সিলেটের এমপিদের একটি আহ্বানে আমাকে সাড়া দিতে হলো। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে সিলেট-১ আসনে কোন প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি সে সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি রাজনীতিতে থাকব না, শিক্ষকতা করব। তখন সিলেটের এমপিরা ও কয়েক বন্ধু-বান্ধব আমাকে উপদেশ দিলেন আপনি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কথা ভেবে দেখুন। সে সময় শেখ হাসিনা আমাকে ডাকলেন এবং আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমার গণফোরাম অধ্যায় ভালভাবে দেখেননি। যাহোক, তিনি আমাকে বললেন, তিনি আকস্মিক একটি সমস্যায় পড়েছেন জনাব হুমায়ুন রশীদের মৃত্যুর কারণে। এ জন্য তাঁকে অনেকেই বলেছেন, আমি ওই আসনে প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগের সুযোগ থাকবে। সে সময় নির্বাচন প্রায় আসন্ন, আমার নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ ছিল দেড় মাসেরও কম। আমি তাঁর কাছ থেকে সময় পেলাম আমাকে সিদ্ধান্তটি সতেরো দিনের মধ্যে নিতে হবে। আমি তখন প্রথমে গেলাম আমার ঘনিষ্ঠ মহলে, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্দেশ্য। তাদের সম্মতি পাবার পর আমি সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সোসাইটির সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। তাদের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা আমাকে এতই আগ্রহী করল যে, আমি সতেরো দিন সময় না নিয়ে আট-দশ দিনের মধ্যে জানালাম যে আমি নির্বাচন করতে রাজি আছি। সে নির্বাচনে আমার নির্বাচনী খরচের ব্যবস্থা করে দেন শেখ হাসিনা। সিলেটের জনগণও কম-বেশি অবদান রাখেন। আমি উল্কার মতো ৩৫ দিন প্রচার চালালাম। কিন্তু তাতেও আমার পরিচিতি খুব বেশি হলো না। আমি ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলাম। সে নির্বাচনে দেখলাম ভোটাররা চায় প্রার্থীরা তাদের কাছে যাবেন, ভোট চাইবেন ও পরিচিতি হবেন। আর দ্বিতীয় শিক্ষা হলো, নির্বাচনটি এমনভাবে দুষ্ট হয়েছে যে, এখানে জালিয়াতি ও চুরি ছাড়া ফল যথাযথ হয় না। যা হোক, নির্বাচনের পরে আমি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বললাম, তাঁর শত চেষ্টা ও সহায়তার পরে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারি। তিনি বললেন, আপনি যেতে পারেন। তবে আপনি নির্বাচনে জালিয়াতি ও চুরি সম্পর্কে যথেষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। এ বিষয়ে আপনি একটি রিপোর্ট তৈরি করলে আমার জন্য সুবিধা হয়। আমি ছয় মাসের প্রচেষ্টায় বহুজনের সাক্ষাতকার ও সহযোগিতা নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করলাম। এ রিপোর্টটি শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করলেন এবং সেটি নিয়ে সুধী সমাজে ও বিদেশীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিদেশে বিষয়টি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনের বিষয় ছিলÑ অ জরমমবফ ঊষবপঃরড়হ : অহ রষষবমরঃরসধঃব মড়াবৎহসবহঃ এই সময়ে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন করবেন। সে জন্য তিনি আমাকে বললেন, আমি যেন কাগজপত্র তৈরিতে সহায়তা করতে পারি। তখন থেকে আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। পরবর্তী আটটি বছর আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কর্মরত থাকি। এই সময়ে আমি বহুলোকের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন খাতে কীভাবে জনকল্যাণকর কর্মপন্থা নেয়া যায় তার একটি রূপরেখা তৈরি করি। এই পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে চিন্তার আদান প্রদান ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ‘চিন্তা কোষে’র বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হই। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারটি আমারই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। এখানে আমাদের প্রধান কাজ হয় ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য একটি সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনার প্রথম খসড়া ২০০৪ সালে আমি বহুজনের সহায়তায় প্রণয়ন করি এবং এটি নিয়ে পরবর্তী দুই বছর এর সম্পাদনার কাজ শেখ হাসিনার সঙ্গে করে যাই। তাতে আমার প্রধান সহায়ক হন- নূহ আলম লেনিন। যখন আমাদের সম্পাদনা শেষ হয়- সে সময় নেত্রী ছিলেন আমেরিকায় এবং আবুল বারাকাত তখন আমেরিকায় যাচ্ছেন বলে একটি চূড়ান্ত কপি নেত্রীর কাছে পৌঁছানোর জন্য তাঁর মাধ্যমে পাঠাই। এই কার্যক্রমটি চূড়ান্ত করতে ২০০৬ পর্যন্ত সময় লাগে। এই কার্যপত্রের একটি বড় অংশ ছিল নির্বাচনী জালিয়াতি, চুরি ও পরিহারের কৌশল। খালেদা জিয়ার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে এই বিষয়টি হয়ে যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার এই বিষয়ে সবিশেষ নজর দেয়। চীফ নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা যে সমস্ত সংস্কার নির্বাচনে নিয়ে এলেন, তার মূল ভিত্তি ছিল আমার রিপোর্টে নির্বাচনী সংস্কারের সুপারিশগুলো। যখন ২০০৮ সালে নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হলো, সেই নির্বাচনে নতুন নির্বাচনী আইনের ফলে এবং দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিযুক্ত করার ফলে বাংলাদেশে ১৯৭৩-এর পরবর্তী দ্বিতীয় বারের মতো একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর পরই আমি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রণালয়ের বিন্যাস সম্পর্কে তাঁর কাছে কিছু কাগজপত্র দেব। তখন তিনি আমাকে এ নিয়ে খুব সুযোগ দিলেন না, তিনি বললেন একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনার সঙ্গে বসব। এর কয়েকদিন পরে হঠাৎ আমি কেবিনেট সেক্রেটারির কাছ থেকে একটি টেলিফোন পেলাম, ‘আজ বিকেলে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান হবে এবং সেখানে শপথ নেয়ার জন্য আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে।’ আমি তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরলাম। ফিরে তৈরি হয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে হাজির হলাম। তখনই তিনি আমাকে বললেন, আপনি আমার অর্থমন্ত্রী হবেন এবং আপনাকে সহায়তা করার জন্য আপনার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে দেব। আমি ঠিক মন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি উপদেষ্টা হওয়ার আগ্রহী ছিলাম। যাহোক, তিনি আমাকে যে দায়িত্ব দিলেন, তার এখন নবম বর্ষ চলছে। এই সময়ে আমি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ২০০৬ সালে গৃহীত বিভিন্ন খাতের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচীর যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলাম সেটাই অনুসরণ করেছি। শেখ হাসিনা আমাকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার কারণ হলো, এসব ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য একটি রূপরেখা গভীরভাবে চিন্তা করে আগেই প্রস্তুত করেছিলাম। আমি এখন তাঁকে বলেছি, এ ধরনের একটি রূপরেখা আমাদের ২০৪১ সালের জন্য প্রণয়ন করতে হবে। এই টিমের নেতার বয়স ৬০ থেকে ৬৫ হতে হবে। প্রশ্ন : আপনি সম্প্রতি কুয়াকাটায় কার্নিভ্যাল করে আসলেন, উদ্দেশ্য ছিল পায়রা বন্দর। আমাদের যে অনেকগুলো পোর্ট হচ্ছে এর উপযোগিতা কতখানি? উত্তর : আমাদের আগে মাত্র দুটি পোর্ট ছিল। তার ভিতর চট্টগ্রামটা চলত। মংলা নষ্ট করে ফেলে ছিল। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গে মংলা বন্দরও পুনরুদ্ধার করেছি। এরপরে সত্যি অর্থে পরিপূর্ণ পোর্ট হচ্ছে একটি তা পায়রা। আর মাতারবাড়ি যে পোর্ট হচ্ছে তা সম্পূর্ণ কয়লা পোর্ট। জাপান নিজস্ব অর্থায়নে এটা করছে। অন্যদিকে মংলা বর্তমানে নিজস্ব সম্পদে চলছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিস হয়েছে। তৃতীয় পোর্ট পায়রা এখন প্রাথমিক পর্যায়ে। একটি পোর্ট তৈরি করতে অনেক দিন লাগে। খুব দ্রুত গতিতে করলেও সাত-আট বছর লাগে। তবে এ পোর্টের আমাদের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রশ্ন : আপনি শুধু একজন মন্ত্রী নন, আপনি বাংলাদেশের অন্যতম একজন বুদ্ধিজীবী এবং বর্ষীয়ান নাগরিক, ভবিষ্যত প্রজন্ম সম্পর্কে কিছু বলুন- উত্তর : ভবিষ্যত প্রজন্ম বুদ্ধিমত্তায় তারা অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের। তাদের প্রয়োজন এখন একজন রোল মডেল। শেখ হাসিনা ভেরি গুড রোল মডেল। এবার বিভিন্ন স্তরে তাদের রোল মডেল প্রয়োজন। সাফল্যের জন্য আমাদের সময় যে শিক্ষা ছিল তা যথেষ্ট নয়। এখন অনেক ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা সব বিভাগের দরকার। এ জন্য আমাদের মনোযোগ আরও বেশি দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট হয়নি। আমার আরেকটি প্রস্তাব আছে, আমরা বেশি বেশি পরীক্ষা নিচ্ছি। এটা কমানো দরকার। আর একটি বিষয় হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ইউনিয়নের বর্তমান দুর্ভিক্ষ। হল ইউনিয়ন, কলেজ ইউনিয়ন এগুলোতে হতো নেতৃত্বের শিক্ষা, রাজনীতিতে অংশ নেয়ার প্রশিক্ষণ। এখন শিক্ষা জগতে শান্তি আছে কিন্তু প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে কোন ছাত্র ইউনিয়ন কোন প্রতিষ্ঠানে নেই। এই অভাব দূর করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ না মিলে তাহলে ভবিষ্যত তো অন্ধকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এদিকে কোন নজর দেয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়টি ভুলেই গেছে। ভবিষ্যতের জন্য এটি দুর্যোগ সৃষ্টি করছে।
×