ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ কামরুল হাসান

পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন ॥ প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা উদযাপন

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন ॥ প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা উদযাপন

মাত্র ক’দিন আগেই পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আর এখন ফেসবুকের রিমাইন্ডার সাকরাইন। পৌষ সংক্রান্তির এ উৎসব বুড়িগঙ্গার তীর থেকে এখন সোজা সিলিকন ভ্যালির ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। ১৪ জানুয়ারি সকালেই ফেসবুকের ওয়ালে বাঘের ছবি দেখেই অনেকের চোখ কপালে। অসাধারণ! আমাদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসন পেতে শুরু করেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার পর এখন সাকরাইন। এ উৎসবের ব্যাপারটা তরুণদের কাছে একেবারেই নতুন ও ভিন্ন। ঢাকার আদি অধিবাসী কিংবা ‘ঢাকাইয়াদের’ একান্ত নিজস্ব আয়োজন এ উৎসব। বছর দুয়েক হলো এ উৎযাপন সংবাদপত্রের খবর হয়েছে। তার আগে এ উৎসবের খোঁজ কেবল পুরান ঢাকাবাসীই রাখত ও জানত। কিন্তু বছরখানেক ধরে উৎসবের বর্ণাঢ্য আয়োজন। চোখ ধাঁধানো আতশবাজি, কান ফাটানো পটকা ও মিউজিক। তরুণদের মুখে আগুনের ভোজবাজি। আকাশে হরেক রঙের ঘুড়ি ও বখাট্টা ঘুড়ি। সব মিলিয়ে উৎসবের নতুন এক মাত্রা আকর্ষণ করতে শুরু করে তরুণ-তরুণীদের। পুরান ঢাকার আশপাশে যাদের সুযোগ হয়েছে তারাই উৎসবে অংশ নিয়েছেন। মেতেছেন অপার আনন্দে। নেচে-গেয়ে পাড় করেছেন জীবনের একটি পৌষ রাত। ১৪ এপ্রিলের নববর্ষ উৎযাপনের মতোই পৌষ সংক্রান্তি উৎযাপনের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট। অর্থাৎ প্রতিবছরের ১৪ জানুয়ারি। এবছরই তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১৪ জানুয়ারি আসার আগ থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই নিয়ে ইভেন্ট পেজ খোলা হয়। বন্ধু মহলের অনেককেই দেখা যায় এই ইভেন্টে আগ্রহী হতে। অনেকেই পুরান ঢাকাই বসবাসকারী বন্ধু কিংবা পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। যেন উপস্থিত থাকতে পারেন এই মহেন্দ্রক্ষণে। ডি-প্রজন্মের পাঠকদের জন্য আমরাও হাজির ছিলাম এই আয়োজনে। চাঙ্খারপুলের ব্যস্ত যানজট দেখে বোঝার উপায় নেই। পুরান ঢাকায় আজ সাকরাইন উৎসব। যথারীতি রিক্সা, গাড়ির তীব্র যানজট। অফিস, দোকান ও খাবার দোকানে ব্যস্ততা। পথে-ঘাটি কোথাও জীবনযাত্রার ব্যতিক্রম ছিল না বরং শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় সবার মাঝে ছিল এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা। তবে মাঝে তরুণদের চোখে পড়ছিল। পরিপাটি পোশাকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে। লক্ষ্মীবাজার ও বাংলাবাজারের মাঝামাঝি একটি বাড়ির ছাদে ওঠার পরিকল্পনা। সঙ্গে ফটোগ্রাফার জাওয়াদ। তার ভার্সিটির এক বন্ধুর পরামর্শেই এই ছাদে উঠে আসলাম। এ যেন মাস্তির পাঠশালা। ছাদভর্তি তরুণ-তরুণী। বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঘুড়ি নিয়ে ব্যস্ত সবাই। বিশাল সব নাটাই। এক পাশে অসংখ্য ঘুড়ি। আশপাশের সব ছাদের একই চিত্র। উচ্চ ভলিউমে মিউজিক। চিৎকার-চেঁচামেচি। ছাদের এক পাশে পিঠা খাওয়ার আয়োজন। চিতল পিঠা, পায়েস, ফল দিয়ে আগত অতিথিদের নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা। নাটাই হাতে তরুণরা ব্যস্ত প্রতিপক্ষের ঘুড়ি সামলাতে। রমণী ও শিশুরা তাদের উৎসাহ যোগাচ্ছেন। আকাশভর্তি নানা রঙের ঘুড়ি। বুড়িগঙ্গার একে বারেই তীরঘেঁষা এই এলাকা। যতদূর দৃষ্টি যায় সব ছাদেই একই অবস্থা। কখনও বখাট্টা বলে অনেকের চিৎকার-উল্লাস। নুয়ে পড়া ঘুড়ি ধরারও কোন উৎসাহ নেই। কারণ প্রত্যেকের কাছে মজুদ অসংখ্যক লাল-নীল ঘুড়ি। যার রঙে ছেয়ে গেছে আকাশ। বরং নাটাইয়ের সুতায় নতুন ঘুড়ির বন্ধন লাগিয়ে আবারও আকাশে উড়ানোর চেষ্টা। বাতাস থাকায় খুব সহজেই আকাশে উড়ে যাচ্ছে ঘুড়ি। খুব বেশি কসরত করার প্রয়োজন হচ্ছে না। সুতা টান দিলেই ঘুড়ি উড়েছে। সন্ধার কিছুটা আগে যখন পড়ন্ত সূর্য কালো বুড়িগঙ্গার ওপরটায় ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে তখন বিক্ষিপ্তভাবে পটকার শব্দ ভেসে আসতে থাকে কানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরোদমে পটকার শব্দ। শুরু হয়ে গেল উৎসব। প্রায় সব ছাদ থেকেই পটকার শব্দ, উল্লাস ও আনন্দ। সন্ধ্যার আজান ধ্বনিত হওয়ার মুহূর্তে কিছুটা নীরবতা। শেষ হয় ঘুড়ি ওড়ানো। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আসল উৎসব। একেবারেই মাথা নষ্ট আনন্দ। আশপাশের সব ছাদেই উচ্চ ভলিউমে ডিজে মিউজিক। তরুণ-তরুণীরা শরীর দুলিয়ে সব ছাদেই জড়ো। ফুর্তি ও আনন্দের কোলাহল প্রায় সব ছাদেই। সন্ধ্যা নামার পরই শুরু হলো সাকরাইন আমেজ। উৎসব উদযাপনে পুরান ঢাকার মানুষদের জুড়ি মেলা ভার। তার প্রমাণ মিলল এবারের আয়োজনেও। উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করতে হাজির হয়েছে অসংখ্যা তরুণ-তরুণী। তাদের কতক স্থানীয় বাকিরা অধিকাংশই বহিরাগত। অতিথিদের অধিকাংশই আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা নিজেদের বন্ধু কিংবা পরিচিত জনের সুবাদে এ উৎসবে আমন্ত্রিত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু কোথাও গুটিয়ে থাকা মানুষ চোখে পড়ল না। খানিক বাদেই আকাশ বিদীর্ণ করে আতশবাজির শব্দ। আগুনের ফুলকির তারকারাজি আকাশজুড়ে। বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুরের দিকেই আমেজটা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। রাতের আকাশে ফ্লাড লাইটের তীব্র আলোর নাচন সঙ্গে আগুনের ভোজবাজি। বহু ছাদেই প্রায় একই দৃশ্য। তরুণরা মুখে কেরোসিন পুড়ে আগুনে ছুড়ে দিচ্ছে। চারপাশে অসংখ্য ক্যামেরার শাটারের ক্লিক ক্লিক শব্দ। চলছে নাচ-গান। উচ্চ ভলিউমে শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে আতশবাজি। মুহূর্তেই আকাশ যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গে ছেয়ে গেছে। পুরো অঞ্চল উৎসবের মাদকতা। অন্ধকার কিছুটা গাঢ় হলে উদযাপনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। যেন কান পাতা দায়।
×