ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাঘেই মিলছে চৈত্রের আবহ

মন রাঙানো শিমুল প্রকৃতিতে আগাম বসন্ত বিলাপ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

মন রাঙানো শিমুল প্রকৃতিতে আগাম বসন্ত বিলাপ

সমুদ্র হক ॥ এবারের বসন্ত আগমনের আগেই বিলাপ শুরু করেছে। তার আভাস এখনই দিয়েছে প্রকৃতি। তা না হলে ফাল্গুন ফাল্গুন চৈত্রের শিমুল এত আগেই চোখ মেলবে কেন। ঋতুগুলো বাঁধন ছিঁড়ে অধিকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাল দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের পালার বৃক্ষরাজি। কে কত আগে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। যদিও মাঘ মাস শিমুলের প্রস্ফুটনের সময়, ফাগুনের হাওয়া তা আরও দ্রুত করেছে। বসন্তের মাতাল সমীরণে লাল বর্ণচ্ছটায় মন রাঙানো শিমুল নিসর্গের আরেক রূপ তুলে ধরে। এবার তা আগেই তুলেছে। বাতাসের মৃদুমন্দ তালে উঁচু গাছের শাখায় শিমুল দেখে কোন প্রকৃতিপ্রেমী পথিক সুন্দর স্বপ্নে মগ্ন হতেই পারে। লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠ ধরে গাইতে পারে “ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে, জানি না আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে/ যার পথ চেয়ে দিন গুনেছি আজ তার পদধ্বনী শুনেছি/ও বাতাস কেন আজ বাঁশি তব বাজায়ে/দিলে তুমি এই হৃদয় সাজায়ে...”। শুধু পথিকেরই বা কেন। বাঙালী জীবনের সংস্কৃতির আবাহনে শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা হৃদয় সাজিয়ে দেয়। লাল বর্ণচ্ছটার আবেগের ফুলগুলো ছন্দায়িত করে তোলে। স্মৃতির পাতা মেলে ধরলে সুর তোলে ‘ও আকাশ কেন আজ এত আলো ছড়ায়ে....’। আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়েই যেন কথা কয় শিমুল। বাংলার এই মাটিতে শিমুলের আগমন বহুকাল আগে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে উত্তর অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ইন্দোনেশিয়া হয়ে বাংলাদেশে। উদ্যানতত্ববিদ মাসুদুর রহমান জানালেন, গোড়ায় ৩ মিটার ব্যাসের ১৮ থেকে ২০ মিটার উচ্চতার বহু শাখা প্রশাখার এই গাছে শীতে যৌগিক পাতা ঝরে। ফাল্গুনের মধ্যভাগ থেকে চৈত্র পর্যন্ত ১০/১২ সেন্টিমিটার লম্বা লাল বর্ণের ফুল ফোটে। শিমুলের ইংরেজী নাম সিল্ক কটন। বৈজ্ঞানিক নাম বোমবাক্স সিইবা। মালভেসি গোত্রভুক্ত। বসন্তের সময়টায় ফুল ফুটে বৈশাখে গিয়ে ঠেকে। তখন মোচা আকৃতির ফল ফেটে শিমুল তুলা বের হয়ে ছোট্ট বীজসহ বাতাসে উড়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়ে। ট্রপিক্যাল জাতীয় এই শিমুল গাছে পাখিরা এসে বাসা বাঁধে। শিমুলের ফুলে থাকে স্বাদু তরল পদার্থ। পিপাসা মেটাতে অনেক পাখি ট্রানজিট হয়ে বসে এই গাছে। দেশে শিমুল তুলার কদর বেশি। নরম বালিশ ও তোশক বানাতে শিমুল তুলাই অগ্রাধিকার পায়। বর্তমানে শিমুলের গাছ কমে যাওয়ায় শিমুলের তুলার দামও বেড়েছে। একটি শিমুল গাছ হতে মৌসুমে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি তুলা মেলে। অনেক তুলা বাতাসে উড়েও যায়। শিমুল গাছের ইতিহাস আছে। ন্যামইউয়েতের রাজা ফিউতো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে হ্যান শাসনামলে সম্রাটকে খুশি করার জন্য শিমুল ফুলের মালা গেঁথে দিয়েছিলেন। সম্রাট এই ফুলের মালা দেখে অভিভূত হয়ে রাজ্যে উৎসবের আয়োজন করেন। ইতিহাসে এর উল্টো দিকও আছে। তৃণীদাদ টোবেগো দেশে লোকগাঁথায় শিমুল গাছকে ‘ক্যাসেল অব দ্য ডেভিল’ (শয়তানের দুর্গ) বলা হয়। ওদের লোকজ সারমর্ম হলো, কোন এক কাঠুরে গভীর জঙ্গলে বড় শিমুল গাছের মধ্যে বাজিল নামের এক দৈত্যকে মেরে আটকে রাখে। ওই দৈত্য এখনও ওই গাছের মধ্যে আছে। শিমুলকে নিয়ে এ সবই ভিন দেশের মজার কল্পকাহিনী। এইসব কল্পকথাকে ছাড়িয়ে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বাস্তবতায় তাকিয়ে যা মেলে তা অবাক হওয়ার মতো। শিমুল গাছের কা-ের ছাল বাঁকল, কচি গাছের মূল বীজের তেল ভেষজ ঔষধী গুণাগুণ অসাধারণ। ড. তপন কুমার দে লিখেছেন, ডায়াবেটিস, হৃদ রোগ, ফোঁড়া ব্যথা, পোকাড় কামর, প্লীহার ব্যথা, স্ত্রী রোগ সারাতে, পুরুষের শুক্র স্বল্পতা বাড়াতে এবং দেহের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়াসহ ১৮ ধরনের রোগের উপশমে ভাল কাজ করে। শিমুলের আঠা প্রসাধন সামগ্রী, বই বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার হয়। শিমুলের কাঠ নরম। প্যাকিং বাক্স, দেয়াশলাই কাগজের ম- তৈরির ফ্লাই উড হিসেবে ব্যবহার হয়। শিমুলকে নিয়ে এত কথা তারপরও দেশের কোন গ্রামে শিমুলকে নিয়ে কুসংস্কার আছে। শিমুল গাছে কথিত ভূত আছে এমন কথা শুনে বিজ্ঞানের এ যুগে বর্তমান তারুণ্য হেসেই উড়িয়ে দেয়। কোন কুসংস্কারে আমল তো দেয়ই না, উল্টো কল্পকথা শুনে বেশ মজাই পায়। মধ্যবয়সীরা জীবনের কোন অধ্যায়ের স্মৃতির পাতা মেলে প্রণয়ের দিনগুলোকে কাছে টেনে গেয়ে ওঠে ‘ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে....’।
×