ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিবারের দাবি- এটি সুগভীর ষড়যন্ত্র ॥ এ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কেউ সানিকে ফাঁসায়নি তো?

খ্যাতির বিড়ম্বনায় এবার আরাফাত সানি! আরও এক মামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

খ্যাতির বিড়ম্বনায় এবার আরাফাত সানি! আরও এক মামলা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খ্যাতি অর্জন করলেও বিড়ম্বনা যেন পিছু ছাড়ছে না। রুবেলের পর এবার জাতীয় দলের ক্রিকেটার আরাফাত সানির বেলায়ও ঘটেছে এমন ঘটনা। যদিও আরাফাত সানির পরিবারের দাবি, এটি একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। মূলত মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেই এমন ষড়যন্ত্রে মেতেছে অভিযোগকারী তরুণী নাসরিন। প্রায় এক বছর ধরে নাসরিন এমন ষড়যন্ত্র করছে বলে আরাফাত সানির পরিবারের দাবি। তবে নাসরিন বলছেন, তার অভিযোগ সত্য। তারা একত্রে দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। সর্বশেষ দু’জনে থাইল্যান্ডে বেড়িয়ে এসেছেন। তার প্রমাণাদিও রয়েছে। এদিকে সোমবার নাসরিন ২০ লাখ টাকা যৌতুকের অভিযোগ এনে আরাফাত সানির বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন। এক দিনের রিমান্ড শেষে আজ আরাফাত সানীকে আদালতে সোর্পদ করা হচ্ছে। পুলিশ অভিযোগকারী ও সানির মোবাইল জব্দ করে তা ফরেনসিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা মিললেও, সানির এ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কেউ আপত্তিকর ছবি নাসরিনের মোবাইলে পাঠিয়েছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে মোবাইলের ফরেনসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। গত ৫ জানুয়ারি নাসরিন নামের এক তরুণীর তথ্য-প্রযুক্তি আইনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় আরাফাত সানির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সাত বছর আগে পরিচয়ের পর সানির সঙ্গে ওই তরুণীর প্রেম হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেয়ার কথা থাকলেও সময় ক্ষেপণ করছিল সানি। স্ত্রী হিসেবে তাকে তুলে নিতে চাপ দিলে সানি ফেসবুকে একটি ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে ম্যাসেঞ্জারে তাদের কিছু অন্তরঙ্গ ছবি পাঠিয়ে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল। এ মামলায় সানিকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সোমবার যৌতুকের দাবিতে মারধরের অভিযোগ এনে আরাফাত সানির বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন নাসরিন। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে করা ওই মামলায় ২০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে নাসরিনকে মারধর করার অভিযোগ আনা হয়েছে আরাফাত সানির বিরুদ্ধে। বাদীর আইনজীবী মোঃ কামাল উদ্দিন জানান, আরাফাত সানির সঙ্গে ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর নাসরিনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা বাসা ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থেকেছেন। একসঙ্গে তারা বিদেশে বেড়াতেও গিয়েছেন। বাদীর অভিযোগ, সানির পরিবার তাদের বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তাকে তুলে নেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে সানি তার কাছে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। টাকা দিলে ঘরে তুলে নেবেন বলে জানান। যৌতুকের টাকার জন্য নাসরিনকে মারধরও করে সানি। মামলার আর্জিতে আরাফাত সানির মা নার্গিস বেগমকেও আসামি করার আবেদন করেছিলেন নাসরিন। আদালত কেবল সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। পরে ঢাকার মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম নালিশি মামলাটি আমলে নিয়ে সানির বিরুদ্ধে সমন জারির আদেশ দেন। সানিকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ইয়াহিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, আরাফাত সানির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের দৃশ্যমান প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। তবে আরাফাত সানির মোবাইল ফোন থেকেই ইমেইল আইডি বা ফেসবুক হ্যাক করে বা তার নামে ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে আপত্তিকর কোন ছবি পাঠানো হয়েছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মামলার বাদী নাসরিন তার মোবাইল ফোনে সানির মোবাইল ফোনের ফেসবুক থেকে আপত্তিকর ছবি পাঠিয়েছে বলে দেখায়। এর প্রেক্ষিতে বাদী ও আসামির মোবাইল ফোন দুইটি জব্দ করে তা সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য। তিনি আরও জানান, বাদী নিজেকে আরাফাত সানির স্ত্রী দাবি করলেও, সে সংক্রান্ত কাবিন নামা বা অন্যান্য দলিলাদি দাখিল করেননি। বাদীকে এসব কাগজপত্র তদন্তের স্বার্থে থানায় দাখিল করতে বলা হয়েছে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত বাদী এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র দাখিল করেননি। বাদীর দাবি, এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রই তার কাছে রয়েছে। এ ব্যাপারে বাদী নাসরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মোহাম্মদপুরের ১১০ নম্বর কাঁটাসুরের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৯ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে আরাফাত সানির সঙ্গে তার পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। দীর্ঘদিন প্রেম করি। দেশে এবং দেশের বাইরে দু’জনে ঘুরতে গেছি। সর্বশেষ তারা একত্রে থাইল্যান্ড ঘুরে আসেন। তাদের দু’জনের ভিসা একসঙ্গে লাগানো। ২০১৫ সালে তিনি একবার আরাফাত সানির বাড়িতে যান। তখন সানির মা আমাকে বাড়ি থেকে মারধর করে বের করে দেন। আরাফাত সানি অন্তরঙ্গ মুহূর্তেই ছবি প্রকাশ করে নিজেই অপরাধ করার প্রমাণ রেখেছে। যদিও তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ বলছে, ছবিগুলো ভুয়া এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইমেইল বা ফেসবুক হ্যাক করে পাঠানো হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আদালতে দায়ের করা কাবিননামা সঠিক দাবি করে নাসরিন বলেন, আমি কোন দিনই জানতাম না সানি বিয়ে করেছে। তার বাসায় না গেলে হয়ত জানার অবকাশও ছিল না। তার কাছে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। এসব তিনি সময়মতো তদন্তকারী সংস্থার কাছে দাখিল করবেন। এদিকে এমন ঘটনায় সারাদেশেই চলছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। সবচেয়ে বেশি আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে আরাফাত সানির জন্মস্থান আমিনবাজারসহ আশপাশের এলাকায়। চলছে নানা মোখরোচক সব গল্প। একেক জন একেকভাবে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছেন। সরেজমিনে এলাকায় গিয়েও মিলেছে এমন চিত্র। আরাফাত সানির প্রতিবেশীরা জানান, আরাফাত সানির পিতার নাম আব্দুর রহিম (মৃত)। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। মা নারগিস বেগম গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সানি দ্বিতীয়। জন্মসূত্রে তারা আমিনবাজারের বাসিন্দা। সানি ছোটকাল থেকেই ক্রিকেট পাগল। স্থানীয় মিরপুর মফিদ-ই-এম স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ২০০৩ সালে তার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্ত ক্রিকেটের কারণে তার আর পড়াশুনা হয়নি। যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। স্থানীয়রা জানান, এলাকায় খুব ভদ্র ছেলে হিসেবেই পরিচিত। নেশা বা বিড়ি সিগারেটে অভ্যস্ত নয়। অত্যন্ত বিনয়ী ছেলে। এলাকায় সানির কোন মেয়েলি দুর্নাম নেই। তার এমন কাহিনী মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। আরাফাত সানির বাড়ি ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন আমিনবাজারের সোজানগরের সরকার বাড়ি এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জি ব্লকের ১/২ নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বরে। সোমবার বিকেল চারটার দিকে দোতলা বাড়িটির দোতলায় অবস্থিত আরাফাত সানির বেডরুমে বসেই কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে। মা নারগিস আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, তার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না। এটি একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। তার ছেলের ক্যারিয়ার সারা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে গেল। তাদের সমাজের কাছে দেশের কাছে ছোট করে দিল। সারা দুনিয়ার মানুষ তাদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ২০১৫ সালে একবার একটি মেয়ে এসেছিল। তখন বিষয়টি বুঝতে পারেনি। এতদিন পর মামলা করার পর বুঝতে পারলাম, ওই মেয়েটিই বাড়িতে এসেছিল। ওই সময় কোন ঝামেলা হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন। বেডরুমে বসেই আরাফাত সানির স্ত্রী আফসানা বলছিলেন, আমার বাড়ি আমিনবাজারের পাশের বড়দেশী গ্রামে। ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক চলে আসছে। এ ধরনের কোন বিষয় তিনি ইতোপূর্বে শুনেননি। তবে বছরখানেক আগে একটি মেয়ে তাকে ৪-৫ বার ফোন করে। ফোনে ওই মেয়েটি তাকে অত্যন্ত নোংরা ও বাজে ভাষায় গালিগালাজ করেছে। গালিগালাজের কারণ জানতে চাইলে তিনি নানা উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলতেন। আমি বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছি, কোন ভক্ত হয়ত রাগ করে, এভাবে তার স্ত্রীকে গালমন্দ করে থাকতে পারে। মামলা দায়েরের পর অনুমান করতে পারছি, নাসরিন নামের সেই মেয়েটিই আগে ফোনে নানা আজেবাজে কথাবার্তা ও গালাগালাজ করেছে। তিনি বলেন, আমার স্বামী এমন কাজ করতেই পারে না। যদিও কোন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, তাতে বলার কথা। আদালতে আমার স্বামী অবশ্যই নির্দোষ প্রমাণিত হবে, বলে আমি আশাবাদী। যদি নির্দোষ প্রমাণিত না হয়, তাহলে তাদের বিয়ের সম্পর্ক টিকে থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই টিকে থাকবে। মানুষ অনেক সময় ভুল করতে পারে। ভেবে নেব, এটি আমার স্বামীর ভুল ছিল। ভবিষ্যতে আর যদি ভুল না করে, তাহলে অবশ্যই সংসার টিকে থাকবে। তবে বার বার ভুল করলে, সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেব তা পরে ভেবে দেখা যাবে। হয়ত এক ভুল থেকে বাকি জীবনে আর ভুল করবে না। তাদের কোন সন্তানাদি নেই। সন্তানাদি হয়নি, হবে না এসব প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। বলেন, বয়স কম, তাই এখনই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি না। সময় হলেই সব হবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জাতীয় দলে বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে ২০১৪ সালে অভিষেক হয় সানির। দেশের হয়ে সর্বশেষ তিনি গতবছর টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেন। তার আগে ২০১৫ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে দেশের হয়ে শেষ ওয়ানডে খেলেন।
×