ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুদরাত-ই-খুদা বাবু

অভিমত ॥ ঢাকাকে বাসযোগ্য করা কি অসম্ভব?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

অভিমত ॥ ঢাকাকে বাসযোগ্য করা কি অসম্ভব?

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) সম্প্রতি বিশ্বের ১৪০টি শহরের বাসযোগ্যতার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ইআইইউ নামক ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, ভৌত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীলতা বা শৃঙ্খলা- এই পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা করে। এ তালিকায় বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে প্রথম হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর আর ঢাকার অবস্থান প্রতিবছরের মতো এবারও একদম তলানিতে (১৩৭তম)। ২০১৫ সালে ইআইইউ জরিপে সারা বিশ্বে বসবাসের জন্য সবচেয়ে অনুপযোগী (দ্বিতীয়) শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ঢাকা। আর ২০১৪ সালে বসবাসের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। এ জাতীয় খবরগুলো ঢাকাবাসী তথা এ দেশের জনগণের জন্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগের এবং নিরানন্দের। বলা হয়ে থাকে, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, সুনামির ওপর কারও হাত নেই এবং তা রোধ করাও সম্ভব নয়। কিন্তু একটু সচেতন হলে জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ, অপরিকল্পিত ফ্যাক্টরি-কারখানা নির্মাণ করে একটি শহরের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করা, একটি শহরকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত করা, এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে পুরো একটি শহরকে পানির নিচে তলিয়ে দেয়া, একই রাস্তা অসৎ উদ্দেশ্যে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে দুর্গন্ধময় পরিবেশ তৈরি করা, যানজট, ধুলাবালি, ধোঁয়া আর মশার উপদ্রবকে জনগণের নিত্যসঙ্গী বানানো, পানি-বিদ্যুত-গ্যাস সঙ্কটে শহরবাসীকে ভোগান্তির হাত থেকে তো অন্ততপক্ষে রক্ষা করা যেতে পারে। রাজধানী ঢাকাকে আতঙ্কিত ও অপ্রস্তুত শহর হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ করা হয় এবং এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। কিন্তু বিষয়টি যেন ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’-এই অবস্থার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ ও যানজটমুক্ত করতে নানা পরিকল্পনার ্র্র্রকথা শোনা যায়। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে নিত্য নতুন পরিকল্পনাও তৈরি হয়। আবার এসব বিষয় নিয়ে প্রায়ই সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই সব পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। ইআইইউর গত কয়েক বছরের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ন টেকসই নয়, যা প্রতিটি নগরবাসীই উপলব্ধি করতে পারেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা এত পিছিয়ে? স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা ভালই বলতে হবে। ঢাকায় নেই কোন সামরিক যুদ্ধের হুমকি বা বড় ধরনের সহিংস অপরাধের উপস্থিতি, নেই কোন সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় হাজার হাজার মৃত্যুর রেকর্ড, নেই পশ্চিমাদের ঢাকার প্রতি বিদ্বেষ। এখানে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা ধনী দেশগুলোর মতো না হলেও একবারে যে অপ্রতুল তা কিন্তু নয়। কিন্তু পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকায় নেই। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনগণ কর্তৃক ট্রাফিক আইন না মানার পাশাপাশি সুষ্ঠু গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাবে ঢাকার রাস্তা-ঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এই যানজটের কারণে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে কার্যক্ষমতা ও মনোযোগ। ঢাকা এমন একটি শহর যেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য সামান্যতম যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত সেটুকুও দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। যতটুকু আছে সেখানেও হকাররা পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ‘ম্যানেজ’ করে বসায় দোকানপাট, হাট-বাজার। এক শ্রেণীর মানুষের সীমাহীন অর্থলিপ্সা রাজধানী ঢাকাকে ভয়াবহ ইট-কাঠের বস্তিতে পরিণত করছে। কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণে কিছুতেই সর্বগ্রাসী নারকীয় অগ্নিকা- ঘটত না, যদি প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দ্রব্যাদিসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের ফ্যাক্টরি ও কারখানা আবাসিক এলাকার দালানকোঠাকে বিপজ্জনক মৃত্যুপুরী না করে তুলত। ঢাকা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকায় বড় আকারের অঘটন ঘটলে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা হবে ভয়াবহ অকল্পনীয় ও অপরিমাণযোগ্য। রিস্ক এ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়ার্সের জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে অন্যতম ঢাকা। ঢাকা মহানগরীর প্রায় তিন লাখ ২৬ হাজার পাকা ভবনের মধ্যে ৭২ হাজার ভূমিকম্প ঝুঁকি মধ্যে আছে। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে ২৫ কিমি বিস্তৃৃতব্যাপী ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন তিন লাখেরও বেশি মানুষ। গৃহহীন হয়েছেন ১০ লাখেরও বেশি এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস, এ্যাসেম্বলি বিল্ডিং, প্রিন্স ক্যাথেডাল ও মেইন জেলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাজধানী ঢাকায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস এবং দেশের বিপুল সংখ্যক জনগণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রাজধানীমুখী হওয়ায় এ সংখ্যা প্রতি দিনই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ঢাকার ওপর বর্তমানে জনসংখ্যার চাপ যে হারে বাড়ছে তাতে করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকায় হলে এবং তা রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা তার একটু উপরের মাত্রার হলেই ঢাকা ধূলিসাত হয়ে যেতে পারে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ ঘটলে বাড়িঘর, অফিস-আদালত, ফ্যাক্টরি, শিল্প-কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এর পাশাপাশি বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেলে এবং পানি ও গ্যাসের পাইপলাইন ফেটে গেলে যে কি ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে জাপানের শিল্পনগরী কোবের ভূমিকম্পে বেশিরভাগ লোক মৃত্যুবরণ করে কেবল ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক ও গ্যাসলাইনের অগ্নিকা-ে। হাইতি ও কোবের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সময় থাকতেই হুঁশিয়ার হওয়া। অর্থনীতির পরিভাষায় উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্য নির্বিবাদে স্থানান্তরের সুযোগ থাকলে যে কোন স্থানের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুফল সংযুক্ত অন্যান্য এলাকায়ও পৌঁছানো যায়। তুলনামূলকভাবে পণ্য চলাচল সহজ ও সাশ্রয়ী হলে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোরও বিকেন্দ্রিকীকরণ অত্যন্ত জরুরী। অনুরূপভাবে মৎস্য ভবন, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজিএমসি) ও অনেক সরকারী-বেসরকারী অফিস-কারখানা-ইন্ডাস্ট্রি যেগুলোকে ঢাকা থেকে দেশের অন্যত্র স্থানান্তর করা অত্যন্ত জরুরী। এ ব্যাপারে বুয়েটসহ সরকারী ও বেসরকারী প্রকৌশল সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। ঢাকাকে পরিষ্কার রাখতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালকে পরিচ্ছন্ন বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে তা সচেতন ব্যক্তিরাই ভাল বলতে পারবেন। মেয়র দুজনের পক্ষে কি ঢাকাকে পরিষ্কার রাখা ও বসবাসের যোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব? নিশ্চয় না। তাহলে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ কতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক যেন সত্যিকার অর্থেই বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে ওঠে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা। লেখক : বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক
×