ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

বছরের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া মাসব্যাপী বাণিজ্যমেলা শেষ সপ্তাহে এসে পৌঁছেছে। বিশাল পরিসরে এটি আয়োজিত হলেও ছুটির দিনগুলোয় বড়ই ছোট মনে হয় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন শেরে বাংলা নগরের উন্মুক্ত এলাকাটিকে। পূর্বাচলে ৬০ বিঘা জমির ওপর স্থায়ী বাণিজ্যমেলা কেন্দ্র তৈরির কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। চীনের অর্থায়নে আগামী ২০১৯ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। তাহলে আগামীতে ঢাকাবাসী কিছুটা স্বস্তি পাবে। গত শুক্রবারের উপচে পড়া ভিড় নিয়ে বিশদ রিপোর্ট বেরিয়েছে জনকণ্ঠে। ঢাকা এমনিতেই জনতার চাপে ভারাক্রান্ত। বাণিজ্যমেলার মতো রকমারি পণ্যের মেলা ঢাকাবাসীর কাছে এক দরকারি উৎসব হিসেবে উপস্থিত হলেও সেখানে শুধু ঘুরে বেড়াতে যান অল্প কিছু মানুষ এটা সত্যি। বেশিরভাগ মানুষই যান দেখেশুনে কেনাকাটা করতে। দেশী পণ্যের বিরাট কদর থাকলেও বিদেশী পণ্যও কম বিক্রি হয় না মেলায়। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মানোন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি নতুন বাজার খোঁজার প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে। গত বছর বাণিজ্যমেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে কী চাহিদা আছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। সেই চাহিদা অনুযায়ী আমাদের দেশের কোন কোন পণ্য রফতানি বা উৎপাদন করা সম্ভব, প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব সে বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। মানছি এক বছরেই প্রধানমন্ত্রীর দরকারি সাজেশনের সুফল দেখা যাবে না, কিন্তু কিছুটা ইঙ্গিত তো পাওয়া সম্ভব। সেটি কি পেলাম আমরা? সে যাই হোক, বছরের শুরুতে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। শহরে এখন দুই কোটি লোকের বাস। বাণিজ্যমেলার মতো আকর্ষণীয় একটি মেলায় ছুটির দিন এক-দেড় লাখ লোক হওয়া অস্বাভাবিক মনে হয় না। সবাই তো একই সময়ে যাচ্ছেন না! রাজধানীবাসীর বিনোদনকেন্দ্রের বড়ই অভাব। তাই যে কোন মেলাতেই প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে। বাণিজ্যমেলায় রকমারি পণ্য ছাড়কৃত মূল্যে পাওয়া যায়Ñ এটা ক্রেতাদের টানে। বিশেষ করে মহিলা ক্রেতারা ঘর-গেরস্থালির পণ্য আর আসবাবপত্রের স্টলে বেশি ভিড় জমান। বাণিজ্যমেলায় বাণিজ্য হবে, সেটাই স্বাভাবিক; তবে এটি যে প্রাণোচ্ছল আনন্দময় এক মানব মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, সেটাও অনেক বড় বিষয়। বলা দরকার, এবার দেশী-বিদেশী মোট ৫৮০টি স্টল নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপসহ মোট ৫টি মহাদেশ অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশসহ ২১টি দেশ। বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যমেলায় মোট ৪৮টি স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। বাণিজ্যমেলা আয়োজনের মাধ্যমে বিদেশী ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পরিচয়ের সুযোগ সৃষ্টি বড় প্রাপ্তি। তাছাড়া এ আয়োজনে দেশীয় বাণিজ্যের বৃদ্ধিরও বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়। উৎপাদিত পণ্যের মান যাচাই করারও অবকাশ মেলে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের প্রচলিত ও অপ্রচলিত কৃষি পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজার খোঁজার একটি প্ল্যাটফরম হতে পারে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা, এমনটা আমরা ভাবতে পারি। বিগত দুই বছরে বাণিজ্যমেলায় গড়ে ৮০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ পাওয়া গিয়েছিল। এবার তা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বারেবার উবার রাজধানীতে ট্যাক্সি ক্যাব পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ঘনবসতির এই মহানগরে রাস্তায় ট্যাক্সির দেখা কম মেলে। আর সিএনজি অটোরিক্সাঅলাদের স্বেচ্ছাচারিতার কথা বহুল উচ্চারিত। তিন চাকার বাহন সিএনজি কতটা যাত্রীবান্ধব তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পলকা এ যানটিতে হাতের মুঠোয় জান নিয়েই ওঠেন যাত্রীরা। তীব্র ঝাঁকি আর উচ্চ শব্দ সহ্য করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। এমন একটি বাস্তবতায় ধীরে ধীরে ঢাকায় ‘উবার’ সার্ভিস যে বেশ এগিয়ে গেছে এটা আমার জানা ছিল না। কানাডা থেকে আমাদের এক শিল্পীবন্ধু এসেছিলেন সপরিবারে একদিন সন্ধ্যায় বাসায় বেড়াতে। ফেরার সময় তিনি ট্যাক্সি ডাকলেন, ডাকলেন মানে কাজটি নিঃশব্দে হলো। মোবাইল ফোনে কিছুক্ষণ টেপাটেপি করলেন, সাত মিনিটের মধ্যে বাসার সামনে গাড়ি এসে হাজির! একটু চমকাতেই হলো। উবার’ নামের যে ‘অন-ডিমান্ড’ ট্যাক্সি সেবা সারা পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে- তারা এবার বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকাতে প্রথমবারের মতো ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করেছে। বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকা ট্রাফিক জ্যামের জন্য বিখ্যাত হলেও উবার আশা করছে, এই সমস্যা কমাতে ভূমিকা রাখবে তাদের এই মোবাইল এ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবা। বিশ্বের ৬৬টি দেশের ৫০৭টি শহরে এর কার্যক্রম চালু আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা হচ্ছে ৩৩তম শহর যেখানে উবার সেবা চালু হলো। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক উবার কোম্পানির লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরগুলোতে চলাচল সুগম করা এবং যানজট ও বায়ুদূষণ কমানো। উবার বিভিন্ন শহরে চালু হবার পর প্রতিষ্ঠিত ক্যাব কোম্পানিগুলোর বাধা, মামলা ও বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে। ঢাকায় শুরুতে কিছুটা বাধা আসলেও অল্পতেই সেটি টপকে গেছে উবার। বিআরটিএ এই সেবা চালুর পর বলেছিল, এটি বেআইনী। ঢাকা শহরে উবারের ব্যবহার কীভাবে করতে হবে তা পাঠকদের জানা দরকার। প্রথমে স্মার্টফোনভেদে এ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইওএস এ্যাপ নামিয়ে নিন। নামানোর ঠিকানা : অ্যান্ড্রয়েড যঃঃঢ়ং://মড়ড়.মষ/ীঊতফখঐ আইওএস যঃঃঢ়ং://মড়ড়.মষ/৬ঔঋৎঃহ * নাম, ই-মেইল, মুঠোফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। একটা সাংকেতিক নম্বর মুঠোফোনের এসএমএসে আসবে। সেটি দিয়ে তারপর এ্যাপে লগইন করুন। * এ্যাপের মূল পাতায় মানচিত্রে দেখে নিন কাছেপিঠে কোথাও উবারের ট্যাক্সি আছে কি না। * আপনার অবস্থান অর্থাৎ কোথা থেকে ট্যাক্সিতে উঠতে চান তা ঠিক করে দিন। * গন্তব্য ঠিক করে দিতে হবে। একই পাতায় লেনদেনের ধরন ও প্রমোশনাল কোড যোগ করা যাবে। সম্ভাব্য ভাড়া দেখে নেওয়ার সুযোগও আছে। * সব ঠিকঠাক থাকলে ‘রিকোয়েস্ট উবারএক্স’ বোতাম চাপুন। ট্যাক্সি চালকের ছবি, পরিচয় ও গাড়ির ধরন দেখাবে। বাতিল না করলে নির্দিষ্ট সময় পরে ট্যাক্সি এসে হাজির হবে। মানচিত্রে ট্যাক্সির অবস্থান দেখাবে, প্রয়োজনে মুঠোফোনে যোগাযোগের সুযোগও আছে। বলা দরকার, ঢাকায় সেবা চালুর দুই মাসের মাথায় ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে উবার কর্তৃপক্ষ। বর্ধিত ভাড়ার হার গতকাল সোমবার থেকে কার্যকর হয়েছে। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া গুনতে হবে ১৮ টাকার স্থলে ২১ টাকা। আর গাড়িতে রাস্তায় অপেক্ষার জন্য গুনতে হবে তিন টাকা করে, যা ছিল দুই টাকা। ভিত্তি ভাড়া অবশ্য আগের ৫০ টাকাই থাকছে। উবারের গাড়ি ডেকে তা প্রত্যাহার করলে (পাঁচ মিনিট পর) দিতে হবে ৫০ টাকা। প্রথম দফায় এটির নেটওয়ার্কে যোগ হয়েছিল ৩০০ গাড়ি। ক্রমান্বয়ে তা আরও বেড়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উবারচালক আমাকে বললেন, ইতোমধ্যে এক হাজার গাড়ি রাজধানীতে চলতে শুরু করেছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষের বক্তব্য এ বছরের মধ্যেই তাদের সেবাবলয়ে যোগ হবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার গাড়ি। যদি দুই বছরেও সেটা সম্ভব হয় তাহলেও গণপরিবহনের ঝক্কির এই মহানগরে তা বিরাট উপকার বয়ে আনবে, তা বলাই বাহুল্য। বইমেলার আগে বনলতা রিডিংস মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরের একটি শিল্পমণ্ডিত বাড়ির নাম বনলতা। বাড়িতে বসবাস করেন লেখকজুটি। তাদের আয়োজনে বাড়িটিতে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে ‘বনলতা রিডিংস’ শিরোনামে পাঠ-আয়োজন। আসলে এটি লেখক-আড্ডাই। একঝাঁক বিভিন্ন বয়সের লেখক নিজেদের রচনা থেকে পাঠ করবেন। সেই রচনা হতে পারে গল্প কিংবা কবিতা, কোন অনুবাদ অথবা উপন্যাসের অংশবিশেষ। একজন পড়া মানে বাদবাকি সবার শোনা। লেখকদের মধ্যে এভাবে সরাসরি সংযোগও তৈরি হয়ে থাকে। এটা ঠিক যে একজন লেখক তার সমকালের সব লেখকের লেখার সঙ্গেই পরিচিত থাকবেন, এমনটা প্রায় অসম্ভব। ব্যক্তিগত চেনাজানা থাকলেও এক লেখকের কাছে অপর লেখকের লেখা অপঠিত থেকে যেতে পারে। তাই এ ধরনের আয়োজন থেকে লেখকদের নিজেদের লেখা অপর সতীর্থ লেখকের কাছে সরাসরি তুলে ধরার অবকাশ তৈরি হয়। এটাই বরং তাৎপর্যপূর্ণ। এমনিতে ব্যস্ত ঢাকায় এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাতায়াত কিছুটা ঝক্কিরই বটে। নানা কারণেই লেখকদের আড্ডা কমে এসেছে ঢাকায়। তাই এমনতর আয়োজনে লেখকের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎ এবং পারস্পরিক মত বিনিময় কুশল বিনিময়ের সুন্দর একটি সুযোগ মেলে। বনলতা রিডিংসে আগের আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন লেখক ছাড়াও সাধারণ পাঠক, গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পী। এইবার গত শুক্রবারের আয়োজনে শুধু লেখকরাই আমন্ত্রিত হন। ফলে পাঠপর্ব আরও সংহত ও মনোযোগ-কাড়া হয়েছিল। এমন একটি উপভোগ্য সান্ধ্য আয়োজনের জন্য ফারহানা-ফারসীম জুটি উপস্থিত সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছেন। এ ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ফারসীম কথা বললেন ‘উপরিতলের নিচে’ বইটি নিয়ে; গ্যালিলিওর গল্প ছাড়াও তার ‘বৃষ্টি’ নিবন্ধ থেকে পাঠ করলেন। ফারহানা মান্নান শিশুশিক্ষা, বিশেষ করে শিশু-শরীরে মানবিক স্পর্শের সংবেদনশীলতা নিয়ে বক্তব্য দিলেন। মাসউদুল হক খসড়া গল্পের থিম জানালেন, সেইসঙ্গে মুখোমুখি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুই মাইক্রোর আরোহীদের দ্বন্দ্ব ও মনোজগৎ নিয়ে লেখা গল্প নিয়ে বললেন। কবিতা শোনালেন এনায়েত কবীর, শিমুল সালাহউদ্দিন ও শাহরিয়ার লীন। এনায়েতের কবিতায় ছয়মাত্রার ছন্দ নিয়ে সামান্য বিতর্ক হলো, তার ফেসবুকে চার লাইনের ‘স্কাড’ নিয়েও মজা হলো। লীন তো নিজের লেখা নিয়ে ভারি শরমিন্দা। শিমুল আবৃত্তি করতেন এটা বোঝা গেল তার কবিতা পাঠে। রুখসানা কাজলের পঠিত কাহিনীতে দেশভাগের ক্ষরণ উঠে এলো। সুলতান সুলেমানের অন্য পাঠ মিললো সোহরাব সুমনের সদ্য প্রকাশিত বইয়ে। সুফি কবি রুমির গুরু শামস তাবরেজির বয়ান কবিতার মতো করে পাঠ করলেন সাব্বির নাসির। জমজমাট আলোচনা হলো সুফিবাদ এবং লেখকের শব্দচয়ন নিয়ে। অনেকক্ষণ চলল আলোচনা। সুলতানা শাহরিয়া পিউ কোন এক কবির উদ্দেশে পাঠ করলেন তার অন্তরের কথামালা। ছবি তোলার কাজটি করলেন সায়কা শর্মিন। বইমেলার আগে নিজেদের সাম্প্রতিক লেখা পাঠ ও আলোচনার এ ব্যতিক্রমী আয়োজনে উপস্থিত লেখকরা এক ধরনের প্রেরণা পেলেন। তিন মাস পর পর এটি আয়োজিত হবে বলে উদ্যোক্তারা জানান। ২২ জানুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×