ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বই যাদের নিয়তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বই যাদের নিয়তি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘এ্যাক্সিডেন্টে আমার পোলাডার পা ভাইঙ্গা গেছে। তারপর থেইক্যা পঙ্গু হাসপাতালে আইতাছি আর যাইতাছি। গত দুই মাস ধইরা এই পোলাডারে নিয়া আমার যত ভোগান্তি। সঙ্গে আরও আছে ঔষুধ ও আওন যাওনের খরচ। প্রত্যেক দিন ৪০০ ট্যাকা দামের ইনজেকশন দিতে হয়, ডাক্তার দেখাইতে খরচ হয় ১০০ ট্যাকা। ড্রেসিং করতে মোট খরচ হইছে ১২ হাজার ট্যাকা। আমার পোলার এত কষ্ট আমি মা হইয়া ক্যামনে সহ্য করতাছি, তা আল্লাহ জানে। আর কোন মায়ের কইলজার টুকরা যেন এমনে এ্যাক্সিডেন্ট কইরা পঙ্গু হইয়া ঘরে না পড়ি থাকে।’ রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) শফিকের মা ফাতেমা আক্তার ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তার সংসারের দুঃখের কথাগুলো বলছিলেন। ফাতেমা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যেইদিন আমার পোলার এ্যাক্সিডেন্ট হইলো, ওইদিন ও পাশের বাড়ির আরেক পোলার সাথে বাড়ির পাশের মেইন রোড দিয়া হাঁটতাছিল। রাস্তা দিয়া একটা মোটরসাইকেল যাওনের সময় আমার পোলাডারে ধাক্কা দেয়। এ্যাক্সিডেন্টে আমার পোলার ডান পায়ের হাঁটু ও গোড়ালির হাড় ভাইঙ্গা গেছে। এরপর থেইক্যা পোলারে নিয়া আমার যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে। ওরে লইয়্যা হাসপাতাল আর বাড়িত দৌড়াদৌড়ি করতাছি। কবে যে এই দুর্ভোগের শেষ হইবে, জানি না।’ পঙ্গু হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সংখ্যাই বেশি। ময়মনসিংহের ১৩ বছরের মানিক আজাদ, পোশাক শ্রমিক আমিনুল, গৌতম, রশিদরা পঙ্গু হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, ‘জীবনটা হঠাৎ থেমে গেছে। সুস্থ জীবনে কি আবারও তারা ফিরতে পারবে?’ শফিক, আমিনুল কিংবা আশিকের মতো অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কাতরাচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালের বিছানাসহ নিজ বাড়ির বিছানাতেও। দুর্ঘটনায় শিকার এসব কিশোর-শিশু, এমনকি পরিণত বয়সের নারীপুরুষও প্রতিদিন পঙ্গুত্ব বরণ করছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। অনেক দুর্ঘটনার খবর প্রকাশ পেলেও অনেক ঘটনা আবার চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কমছে না দুর্ঘটনার রেশ। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীর পাশাপাশি দুর্ভোগে পড়ে এদের পরিবারগুলো। অনেক পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আহতদের যন্ত্রণা, কষ্ট ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। সঙ্গে অনেকদিন চিকিৎসা খরচ চালানোর ব্যবস্থা করাটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলোর। রোগীর দেখাশুনার কাজে পরিবারের একজন সদস্যকে সারাদিন থাকতে হয় তার পাশে। এছাড়া পরিবারের কর্মক্ষম কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করলে সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচার) ২০১৬ সালের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন দেখা যায়, ২০১৬ সালে মোট ২৩১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৪১৪৪ জন, আহত হয়েছেন ৫২২৫ জন। ২০১৫ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৬২৬টি, নিহতের সংখ্যা ৫০০৩ জন ও আহত ৬১৯৭ জন। বিশ্লেষকদের মতে ২০১৫ সালসহ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিগত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। যদিও নিসচার এই পরিসংখ্যান শুধু মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে অনেক আঞ্চলিক তথ্য অপ্রকাশিত রয়েছে যা কোন মিডিয়ায় উঠে আসেনি। সুতরাং এসব পরিসংখ্যানের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কতটি হচ্ছে এবং আহত-নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে আমরা একটা ভাসমান ধারণা পাচ্ছি। তবে প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি বলে ধারণা করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে টানা ৬ মাস চিকিৎসা নিচ্ছেন চাঁদপুরের সিএনজি চালক গালিব মোল্লা। তিনি জানালেন, ‘দীর্ঘ চার বছর ধরে সিএনজি চালাইছি আমি। কিন্তু কোনদিনও এ্যাক্সিডেন্ট ঘটে নাই। ঘটনার দিন রাত আটটায় আমি বাড়ি ফিরছিলাম। মেইন রোডে হঠাৎ একটি ট্রাক এসে পিছন থেকে আমাকে ধাক্কা দিল। আমি সিএনজিসহ ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে যাই। কোনমতে সিএনজি থেকে বের হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি আমার ডান পায়ের বেশকিছু জায়গার হাড় ভেঙ্গে গেছে। এভাবে পরিবারের বোঝা হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল।’ গালিব মোল্লার পাশেই ছিলেন তার সহধর্মিণী কুলসুম বেগম। তিনি জানালেন, বাড়িতে তাদের দুই ছেলে মেয়ে আছে। চার জনের সংসারের রোজগার করার মতো একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন তার স্বামী। তার এ অবস্থায় পরিবারে অসচ্ছলতা দেখা দিয়েছে। জমানো টাকা তার স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়েছে। এখন আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে চলছেন তিনি। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের বেশিরভাগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের চিকিৎসার মধ্যেই থাকতে হয়। অনেক সময় পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে রোগীরা চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। ফলে একসময় তাদের পঙ্গুত্ববরণ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। দেশের আনাচে-কানাচে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। অনেকেই আবার চিকিৎসার অভাবে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার সংখ্যা যেন ক্রমাগত হ্রাস পায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। কোন রাস্তা দিয়ে ট্রাক, কোন রাস্তায় বাস এবং রিক্সাসহ ছোট যানবাহন চলবে তার পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। অদক্ষ চালক কিংবা হেলপারের হাতে যে ট্রাক সে তার পাশের রিক্সাকে চাপা দিলে কিংবা ধাক্কা দিলে তার যে কী অবস্থা হতে পারে, সেটা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে, এ দুর্ভোগের কোন অন্ত নেই। সেইসঙ্গে, যারা গাড়ির ফিটনেস দেয় তাদের সংশ্লিষ্টতা আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গাড়ি চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ফাঁকা রাস্তায় প্রতিযোগিতা করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, চালকের অদক্ষতা, খেয়ালিপনা, ওভারটেকিং, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ফুটপাথ দখল, ট্রাফিক আইন না মানা, রাস্তার নির্মাণ ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, গাড়ির ত্রুটি, সড়কে জেব্রাক্রসিং না থাকা ও না মানা, নির্ধারিত গতিসীমা মান্য না করা, রাস্তায় ওভারটেক করার তীব্র মানসিকতা ও ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলার কারণে মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়কগুলোতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।
×