ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অসুস্থ জোছনা বেগমের জীবন সংগ্রাম

ভিক্ষার টাকায় সন্তানের লেখাপড়া- মা স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার বানানোর

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

ভিক্ষার টাকায় সন্তানের লেখাপড়া- মা স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার বানানোর

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ সন্তানের প্রথম শিক্ষক হচ্ছেন তার মা। আর প্রথম স্কুল হচ্ছে তার পরিবার। এখান থেকে একটু একটু করে সন্তানরা তাদের শিক্ষাজীবনের সূচনা করে থাকে। আর এই শিক্ষাই তার ভবিষ্যত জীবনের জন্য ভিত্তি তৈরি করে। মা ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কি বিশাল তার পরিধি! সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোন প্রাণীরই প্রাণ ধারণ সম্ভব নয়। গর্ভধারিণী, জননী, জন্মদাত্রী হিসেবে সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে। এমনই এক মা জোছনা বেগম (৫৫) ছেলেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে ডাক্তার বানাতে চান। স্বামী সহিদুল ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করে জোছনা বেগমকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তার একমাত্র ভরসা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে জাবেদ আলীকে ঘিরে। তাই ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভিক্ষায় নেমেছেন। তিনি সৈয়দপুর রেল স্টেশনসহ এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করেন। নিজেও অসুস্থ। দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরে তার। চোখের চিকিৎসা করাতে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। ভিক্ষায় যা আয় হয়, তা ছেলের জন্য জমা করছেন। সৈয়দপুরের শহীদ ডাঃ জিকরুল হক সড়কে শনিবার এই মায়ের সঙ্গে গাইড বই হাতে দেখা মেলে জাবেদ আলীর। এ সময় জাবেদ জানায়, সে নীলফামারী সদরের পলাশবাড়ী পরশমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ‘ক’ শাখার ছাত্র। তার রোল নম্বর ৭। পূর্ব পলাশবাড়ির আরাজি হাটখোলা গ্রামে বড় বোন নুরন্নাহার ও ভ্যানচালক দুলাভাই ওমর আলীর বাড়িতে থেকে সে লেখাপড়া করছে। সৈয়দপুর স্টেশন ও গেটবাজার এলাকায় তার মা ভিক্ষা করেন। গত এক সপ্তাহের উপার্জিত ৪৮০ টাকা দিয়ে স্থানীয় একটি লাইব্রেরি থেকে ছেলের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গাইড বই কিনে দিয়েছেন। এখন বই নিয়ে সে ফিরে যাবে বড় বোন দুলাভাইয়ের বাড়িতে। জোছনা বেগম বলেন, ভিক্ষা করে দিন শেষে জোটে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। সামান্য কিছু খেয়ে রেলস্টেশনে বা গেটবাজারের কোন দোকানের বারান্দায় ঘুমিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেন। প্রতি সপ্তাহে একবার মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি গিয়ে ছেলে জাবেদের খাওয়ার খরচ দিয়ে আসেন। এই মা আরও বলেন, তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমারের চিকনমাটি গ্রামে। স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে টাঙ্গাইলে গিয়ে বসবাস করছে। খোঁজখবর নেয় না। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি ভিক্ষা করেই। এখন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ এবং ডাক্তার তৈরি করতেই আমার জীবন সংগ্রাম চলছে। ছেলে জাবেদ বলে, মায়ের আশা পূরণ করতে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তার মায়ের জন্য সে গর্ব করে বলে, মায়ের ওইটুকু উপার্জন দিয়েই এখন চলছি। ভবিষ্যতে কী হবে তা জানি না। তবে নিরাশ আমি নই। এখন মাকে স্কুলড্রেস, জুতা আর ব্যাগের জন্য বলেছি। মা তা কিনে দিতে পারবেন কি না জানি না। সংগ্রামী এই মা-ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশের এক দোকান থেকে ভেসে আসছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব, মাগো বলো কবে শীতল হবো, কত দূর আর কত দূর বল মা? পলাশবাড়ী পরশমনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হামিদুল ইসলাম বলেন, আমার স্কুলের ছাত্র জাবেদের জীবন এমন সেটি জানা ছিল না। এখন জানতে পেরে তার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হবে। স্কুলের সব সুযোগ-সুবিধা তাকে দেয়া হবে।
×