ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

(গতকালের পর) পুলিশদের ক্ষমতার অপব্যবহারেও বলার কিছু নেই। আলাপচারিতায় কয়েকজন সেনা অফিসারই বলছিলেন, পুলিশই এখন রাজা। বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা অপ্রতিহত, মন্ত্রীরা সংকুচিত। রাষ্ট্রের মর্যাদা নিরুপিত হয় আমলাতন্ত্রের মাপকাঠিতে। ঋণখেলাপীদের বা যারা ব্যাংকের সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের স্বার্থও অটুট। জামায়াতে ইসলামীর কোণঠাসা অবস্থা হলেও তারা নিষিদ্ধ হয় না। মাদ্রাসার স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। হেফাজতি বা হেজাবীর স্বার্থ রক্ষায় সব দাবি মানা হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কেউ হুংকার দিলেই সরকার পিছু হটে। আওয়ামী লীগ তো সব সেক্টরের স্বার্থই দেখছে। শুধু উপেক্ষা করছে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে যারা আছে তাদের। কারণ, তাদের ধারণা, এরা শেখ হাসিনার ল্যাওট বিশেষ, টাকা কড়ি বা মস্তান এদের নেই। এসব ফালতুদের চিৎকার না শুনলেই বা কী কিন্তু শফিদের বাতচিত শুনতে হয়। ১৯৭১ সালে তারা মুজাহিদ ছিল। যা তা ব্যাপার! বাঙালিদের ব্যাপারটা এমন, যখন বিজাতীয় ভাষায় বলা হয়, ‘শুয়োরকা বাচ্চা’ তারপর দু’একটা লাথি, তখন বলে, ‘না’ স্যারের পার্সোনালিটি আছে।’ ভদ্র বা বিনয়ী হন, বলবে, ‘শালার কোন মুরোদ নেই।’ মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িকতা বা প্রগতির পক্ষে আছে তারা কথা বললেই তা ইসলামবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও তখন ছবক দিতে কসুর করে না। আমরা বলতাম, শেখ হাসিনা বিপাকিস্তানীকরণ করছেন। এখন পাঠ্য বইয়ের হেজাবিকরণ দেখে প্রশ্ন জাগে, আমরা যা বলেছি তা কি মায়া না বিভ্রম? অথচ, এরা কখনও আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল না। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রও ছিল না। হয়ত বলবেন, তারা এখন পক্ষে। ঠিক আছে, সচিবালয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে যান তাহলে বুঝবেন কত ধানে কত অন্ন। হেজাবিরা যখন ঢাকা দখল করতে এলো কে ছিল না তাদের পক্ষে। সরকারের মিত্র এরশাদও তাদের পানি খাইয়েছেন। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যখন এদের রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করেছিলেন তখন ঢাকা শহর জেগে উঠেছিল। শেখ হাসিনা রুখে দাঁড়াবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হেজাবিরা সেই যে ঢাকা ত্যাগ করেছিল আর ফেরেনি, তারপরও হেজাবিদের এত তেল দেয়ার সেইসব মন্ত্রণাদাতা কারা? শোনা গেছে তারা বলেছিলেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইসলামী ভোট’ নষ্ট করেছেন, অতএব বিদায়। এরাতো হেজাবিদের হয়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে। আজ শেখ হাসিনার দলে কি এমন লোকদের অভাব যে সৈয়দ আশরাফের ভাষায়, ‘রাজাকারের বাচ্চারা’ যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। আজ হেজাবিদের নির্দেশে যখন পাঠ্যবই বদল হয় তখন হেফাজতি, চরমোনাইর পীর বা ধর্মব্যবসায়ীরা সাধুবাদ জানান। সরকার হয়ত ভাবেন, আহা বেশ বেশ, সবাই দলে এলো। এটাও তারা বোঝেন না, এটি এক ধরনের পরাজয়, আদর্শের পরাজয় যে আদর্শ আওয়ামী লীগ ধারণ করছে ৭০ বছর ধরে। ॥ পাঁচ ॥ আজ এ লেখা লিখছি প্রতিবাদ বা নিন্দা জানানোর চেয়ে দুঃখ বোধ থেকে। শেখ হাসিনা পরম শক্তিশালী বিশ্বব্যাংক ও হিলারি ক্লিনটনকে উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু বানালেন, আমেরিকা, পাকিস্তান ও ইসলামী দেশসমূহের চাপ উপেক্ষা করে মানবতাবিরোধী অপরাধের শুধু বিচার নয় দ-ও কার্যকর করলেন, বিএনপি-জামায়াতের আগুন লাগানো ও বোমা মারার রাজনীতির বিরুদ্ধে অটল রইলেন, ২৩ বার হত্যার হামলা থেকে বেঁচেও নিজ লক্ষ্যে অটল রইলেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে এলেন, সেই শেখ হাসিনা কেন হেজাবিদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? কয়েকটি ভোটের আশায়? তারা কি ভোটের বাক্স ভরে দেবে বলেছে? তাহলে প্রগতিশীল বা যারা অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে তাদের ভোটের দরকার নেই? বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে মুক্তমনা মানুষের সহযাত্রা অনেক দিনের। এ পরিবারের জন্য প্রগতিবাদী ও একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা অতুলনীয়। এ পরিবারও ত্যাগ স্বীকার করেছেন যথেষ্ট এবং এ কারণে দু’পক্ষের মধ্যে এক বন্ধন তৈরি হয়েছে। এ বন্ধনের ভিত্তি বিশ্বাস, কিছু আদর্শের প্রতি ভালবাসা। শেখ হাসিনার জন্য কত মানুষ মারা গেছেন, আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, জেল খেটেছেন। তারা কেউ কখনও নিজের জন্য কিছু চাননি। শুধু চেয়েছেন তিনি যেন ধর্ম নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র, অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ গড়ে তোলেন। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেন। উন্নয়নের লক্ষ্য তিনি পূরণ করেছেন। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ বোধ আমরা হারাচ্ছি। আজ সারা বাংলাদেশে যে ইসলামীকরণের ঢেউ উঠেছে, দুঃখের কথা তা এ সরকারের মাদ্রাসাপ্রীতি, বিনা কারণে ধর্ম নিয়ে মাতামাতি, বাঙালী সংস্কৃতি বিকাশে অনীহার কারণে। হেফাজতের দাবি মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানীকরণের দিকে বরং ঝোঁক বাড়ছে। অথচ, আমরা এতদিন বলে আসছি, শেখ হাসিনা বিপাকিস্তানীকরণ করছেন। ভোট দরকার তার অর্থ কি হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বসা? দুঃখের কথা আমরা যারা তার জন্য লড়াই করলাম তাদের আজ হাঁটু গেড়ে বসিয়ে স্বার্থরক্ষা করা হচ্ছে। সামরিক বেসামরিক আমলাদের, দুর্বৃত্তপরায়ণ ব্যবসায়ীদের, ধর্ম ব্যবসায়ী পাকিস্তানীদের যারা বিএনপি-জামায়াত আমলেও একই সুবিধা পেয়েছিল। এ কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। হেফাজতিরা দাবি জানিয়েছে, শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে বা ২৩টি সংশোধনী আনতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী এ প্রসঙ্গে মৃদুকণ্ঠে বলেছেন, শিক্ষানীতি আইন করার জন্য কেবিনেটে গেছে। কেবিনেট পাস করলে শিক্ষা নীতি কার্যকর হবে। তিনি কুণ্ঠাভরে এ কথা জানিয়েছেন। কারণ তিনি নিশ্চিত নন, কেবিনেটে তার সহকর্মীরা আইনের পক্ষে না হেজাবিদের পক্ষে রায় দেবেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে এক হেজাবি নেতা জানিয়েছেন, সরকারকে তাদের দাবি মানতে হবে। না হলে কীভাবে দাবি মানাতে হয় তা তারা জানে। অর্থাৎ সরকারকে তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কয়েক বছর আগে যখন ঢাকা ছেড়ে তারা লেজ তুলে পালাল সে কথা তারা এখন বিস্মৃত। সরকার ও দলের হেজাবিদের সঙ্গে আঁতাতের ফলে তারা পাঠ্যবই বদলাতে পেরেছে। আর শিক্ষানীতি তারা বাতিল করতে পারবে না, ভোট যেখানে সামনে। আমি নিশ্চিত এরপর দাবি আসবে জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর। কারণ তা অমুসলিম রচিত। সরকার কি এই দাবি বাতিল করতে পারবে, আমরা নিশ্চিত নই। হেফাজতীদের কাছে আমাদের জিম্মি করা হলো। ১৪ দলকে এখন কান ধরানোর বাকি হেজাবিদের। বঙ্গবন্ধুকে একসময় প্রতিক্রিয়াশীলরা ঘিরে ফেরেছিল। যাদের বন্ধু বলেছিলেন তারাই তাকে খুন করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও আজ প্রতিক্রিয়াশীলরা ঘিরে ফেলেছে। মুখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান দিয়ে তারা স্বার্থ হাসিল করছে। আজ প্রতিক্রিয়াশীল হেজাবি আদর্শের কাছে মুক্তবুদ্ধি বলে পরিচিত ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করেছেন শুধু দু’টুকরো রুটির জন্য। হ্যাঁ, আমরা সামান্য হতে পারি, কিন্তু আমাদের যে অপমান করা হলো, সেটি আমরা ভুলব না। যেসব সম্পাদক প্রতিবাদ করেননি, যেসব বিশেষজ্ঞ এ কাজটি করেছেন এবং যে দুটি কমিটির নির্দেশনায় এসব কাজ হয়েছে সমাজে তাদের চিহ্নিত করবে হেজাবিদের ছুপা এজেন্ট হিসেবে। অপমানের প্রতিশোধটা এভাবেই হবে। ১৩ জন সম্পাদক অবশ্য এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছেন, তাদের এসব বিষয় জানানো হয়নি। তারা প্রতিবাদ জানাতে পারেন কিন্তু বইয়ে সম্পাদক হিসেবে তাদের নামই থাকবে। পাঠ্যবই থেকে তাদের নাম প্রত্যাহারের দাবি তারা জানাননি। তাদের নাম প্রত্যাহার না হলে প্রতারণার জন্য আদালতে যাবেন। এ কথাও বলেননি। এ সমাজে এখনও একটা বিষয় রয়ে গেছে, গরিব মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে আমি মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। রাজাকার বড় লোক, মন্ত্রী বা রাজাকার এজেন্টের পুত্র বুক ফুলিয়ে বলতে পারে না আমি রাজাকারের সন্তান বা আমি রাজাকারের এজেন্ট। হেফাজতিদের কৌশল ঠিকই আছে। তারা বুঝেছে, জোর প্রয়োগ করে দেশকে মৌল জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে না। মৌল জঙ্গীবাদী ধারণা মানস জগতে প্রোথিত করতে হবে। বর্তমান সরকার যতই লম্ফঝম্প দিক। তারা তাদের আদর্শ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মানস জগতে প্রোথিত করতে পারেনি। অবশ্য পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির পর মনে হয়, হেজাবি আদর্শ প্রোথিত করাই তারা শ্রেয় মনে করছে। বাজারে গুজব দু’জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি হেজাবিদের এজেন্ট হিসিবে কাজ করছে। দু’জনই ১৯৭১-এর মুজাহিদ আহমদ শফীর একান্ত ভক্ত। তবে, গুজব গুজবই। সত্যি না জেনে গুজবে কান না দেয়াই ভাল। পাকিস্তান আমল থেকে হেজাবি আমল পর্যন্ত আমরা পাঠ্য বইয়ের সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এলাম। আর আমাদের সরকারের আমলে সেই সাম্প্রদায়িকীকরণ হলো এ দুঃখ, লজ্জা রাখা দায়! মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে কান ধরাতে বাকি রাখলেন! শক্তির এতই গরিমা! যে নরেন্দ্র মোদির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তার দল এখন মনে করছে গান্ধী থেকেও মোদি বড়। কারণ, গান্ধী দিয়ে কী হবে? টাকা ও ভোট আসবে না। এ সরকারেও কি মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করে কী হবে? ব্র্যান্ডিং দরকার এখন আহমদ শফীর। তাতে ভোট [আশা] আসবে। ক্ষমতায় থাকলে টাকাকড়ি আসবে। বিষয়টা ছেলেখেলা নয়। এটি মনে রাখবেন। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে কথা দিয়েই শেষ করি, সারা বিশ্বে এখন প্রতিক্রিয়াশীলরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, লিবারেলদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য। আর প্রতিক্রিয়াশীলতা যখন শক্তিশালী হয় তখন এর নেতারা মনোবিকারে ভোগে এবং তা ছড়িয়ে দিতে চায় রাষ্ট্রে। ট্রাম্প যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে। সন্ত্রাসবাদ যেমন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে, বাংলাদেশেও। কিন্তু শেখ হাসিনা তা রুখছেন। তা হলে, প্রতিক্রিয়াশীলতা তিনি রুখবেন না কেন? বঙ্গবন্ধু তো রুখেছিলেন সারাজীবন। আমরা চাই না হেজাবি সংস্কৃতির বিকাশ হোক, আমাদের সন্তানরা হেজাবি হোক। তা’হলে আর স্বাধীন হয়ে লাভ কি হলো? তা হলে তো পাকিস্তান প্রত্যয়েরই জয় হলো। তাহলে বঙ্গবন্ধু, চার জাতীয় নেতা, ৩০ লাখ শহীদ, ৫ লাখ নারীর অমর্যাদা এ সবই মূল্যহীন? এখনও এ বিশ্বাস রাখি প্রধানমন্ত্রী সবার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবেন। দারিদ্র্য, অপপ্রচার, সন্ত্রাস সব নির্মূলের প্রচেষ্টার কারণে তিনি যে সম্মান পাচ্ছেন, বাংলাদেশেও যদি প্রতিক্রিয়াশীলতার জোয়ার তিনি রুখে দিতে পারেন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি প্রগতির প্রতীক হয়ে উঠবেন, যেমন হয়ে উঠেছিলেন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু বা ক্যাস্ট্রো। উন্নয়ন কাম্য, আদর্শবিহীন উন্নয়ন নয় কারণ তা সভ্যতা সংস্কৃতির মাপকাঠি নয়। সভ্যতা এগিয়েছে, সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে প্রগতিবাদীদের জন্য। প্রতিক্রিয়াশীলরা শুধু সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। আর ইতিহাস প্রগতিবাদীদের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু এর উদাহরণ। (সমাপ্ত)
×