ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

করচের তেলে বায়োডিজেল

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

করচের তেলে বায়োডিজেল

জনশ্রুত আছে- ‘হিজল-করচ-আড়াং বন, হাওড়ের মূলধন’। এশিয়ান উপ-মহাদেশ তথা ভারত এ উদ্ভিদটির উৎপত্তিস্থল বলে জানা যায়। ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাতেও এ উদ্ভিদটি বর্তমানে পাওয়া যায়। উষ্ণ ও অব-উষ্ণম-লের আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে সাধারণত এ উদ্ভিদটি জন্মে থাকে। দীর্ঘ ৫-৬ মাস পানির নিচে থেকেও টিকে থাকতে পারে করচ গাছ। এ প্রজাতিটির লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতা উত্তম। উপকূলীয় অঞ্চলে জমির লবণাক্ততা শোধনে করচ একটি আদর্শ প্রজাতি হতে পারে। তাই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক। জানা যায় হাওড় এলাকার প্লাবনভূমি, খাল-বিল-নদীর পাশে এবং বসতবাড়ির আশপাশে প্রচুর পরিমাণে করচের গাছ ছিল। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ প্রজাতিটির আধিক্য এখনও লক্ষণীয়। অচেনা অবহেলিত বন্ধুবৃক্ষ করচ চিরসবুজ বন করচ। ইংরেজী নাম গরষষবঃঃরধ ঢ়রহহধঃধ; বৈজ্ঞানিক নাম চড়হমধসরধ ঢ়রহহধঃধ । করচ ঘন ডালপালা বিশিষ্ট বহু বর্ষজীবী বৃক্ষ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে বিস্তর গবেষণা চলছে। সুনামগঞ্জ জেলার ১৩৩টি ছোট-বড় হাওড়ে কমবেশি প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া হিজল-করচের গাছ রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় হিজল-করচের বাগ। অতিথি পাখির পরেই টাঙ্গুয়ার হাওড়ের অন্যতম আকর্ষণ হিজল-করচ। দেশের বৃহত্তম হাওড়টাঙ্গুয়া ও হাকালুকিসহ হাওড়াঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য করচ গাছ। কাজে লাগাতে হবে নতুন সম্ভাবনা দেশের জ্বালানি তেলের এ চরম সঙ্কটকালে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে করচ গাছ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব বলে জানা গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্না-বান্না, পাম্প মেশিন চালানো, পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল থেকে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবের তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়। করচের খইল পোল্ট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া খইল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং নেমাটোডের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ছাড়াও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খইল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। এক হেক্টর জমির করচ গাছ বছরে ৩০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুম-ল থেকে শোষণ করে। অন্যদিকে বায়োডিজেল হিসেবে করচের তেল জীবাস্ম জ্বালানির তুলনায় ৭৫ ভাগ কম কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন করে। তাই কার্বন ক্রেডিটের বিবেচনায় করচের গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা একটা উদ্ভিদ। এর শিকড়ে বায়ুম-ল থেকে নাইট্রোজেন জমা করে রাখতে পারে যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এটা মাটির ১০ মিটার গভীর থেকে পানি এবং পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করতে পারে এবং প্রচ- খরা সহ্য করতে পারে। তাই খরাপ্রবণ এলাকায় বনায়নের জন্য এ প্রজাতিটি খুব উপযোগী। এ প্রজাতিটির যেহেতু লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতা রয়েছে এবং এর বিস্তৃত ও ঘন শাখা-প্রশাখামূল মাটিকে আঁকড়ে রেখে মাটির ক্ষয়রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সে কারণে কোস্টাল এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরির ক্ষেত্রে এবং রাস্তার দুই ধারে বনায়ন করার জন্য এ প্রজাতিটি খুবই উপযোগী। কাঠের গুণগত মান উন্নত ও টেকসই না হওয়ায় কাঠ হিসেবে এর ব্যবহার কম। কাঠ ও ডালপালা মূলত জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে নৈমিত্তিক কাজে খুঁটি, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে এ কাঠ ব্যবহৃত হয়। হাওড় এলাকায় বিলে ঝাটা দেয়ার কাজে ডালপালার বহুল ব্যবহার প্রচলিত। বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে বসন্তের শেষ ভাগে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে গাছে ফুল ফোটে এবং মে-জুন মাসে ফল পেকে বীজ পরিপক্ব হয়। পরিপক্ব বীজ বাদামি রঙের। বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৩০-৪০ ভাগ। স্পেলার মেশিন দিয়ে শতকরা ২৫ ভাগ আর ঘানির মাধ্যমে শতকরা ২০ ভাগ তেল সংগ্রহ করা যায়। পরিবেশ অধিদফতরের উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের হর্টিকালচার এক্সটেনশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এতসব গুণাবলী থাকার পরও এ উদ্ভিদ প্রজাতিটি আমাদের দেশে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সরকার সমাজভিত্তিক প্রকল্প হাতে নিয়ে সারাদেশে লাখ লাখ করচের চারা রোপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গ্রীনহাউস গ্যাস কমানোর লক্ষ্যে নানামুখী কর্মকা- হাতে নিতে যাচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে কোস্টাল এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উদ্ভাবন, কার্বন নির্গমন কমানো, অভিযোজন পদ্ধতি উদ্ভাবন ইত্যাদি। অন্যদিকে জ্বালানির অভাবে আজ আমাদের অনেক কল-কারখানা, কৃষি ইত্যাদি মুখ থুবড়ে পরতে বসেছে। সে বিবেচনায় করচ বনায়ন এবং করচভিত্তিক বায়োডিজেলের ব্যবহার এ সমস্যাকে বহুলাংশে লাঘব করতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা ভারতসহ অন্যান্য দেশের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি। করচের তেল জৈব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেক গবেষণা হয়েছে। তারা স্থানীয় কৃষকদের সংগঠিত করে লাখ লাখ করচ গাছ রোপণ করেছে। আমাদের দেশেও এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। উদ্যোগ সফল হলে দেশের জ্বালানি সঙ্কট দূর হবে, অবহেলিত সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত হবে, জ্বালানি খাতে জাতীয় অর্থ সাশ্রয় হবে, হাওড় জনপদের মানুষগুলোর অর্থ উপার্জনের পথ প্রসারিত হবে এবং সর্বোপরি পরিবেশ তথা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশাল অবদান রাখবে।
×