ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীতে ফুলচাষে বিপ্লব

জার্বেরা ও গ্লাডিওলাসে রঙিন বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

জার্বেরা ও গ্লাডিওলাসে রঙিন বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে ॥ রাজশাহীর বরেন্দ্রের মাঠ এখন এমনিতেই নানা ফসলের কারণে সবুজে সমারোহ। কোথাও হলুদ সরষে ক্ষেত আবার কোথাও আলু, সবজি ও ধানে সবুজ উঁচুনিচু প্রান্তর। চোখ জুড়ানোর এমন প্রকৃতির মাঝে আছে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। ধান, আলু, সবজি, সরিষার পাশাপাশি তপ্ত এ মাটিতে এখন চাষ হচ্ছে হরেক ফুলের। দেশীয় গাঁদা, গোলাপের পাশাপাশি বরেন্দ্রর শক্ত এঁটেল মাটিতেও এখন চাষ হচ্ছে বিদেশী জার্বেরা আর গ্লাডিওলাসের। বাহারি ফুল চাষে সাফল্যও পেয়েছেন অনেকে। যে জমিতে এক সময় বছরে মাত্র একবার ধান ছাড়া কোন ফসলই চিন্তা করা যেত না এখন সেই জমিতে ফলছে নানা জাতের ফসলের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বাহারি ফুল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফুল চাষ করেই লালে লাল হয়েছেন এলাকার অনেকেই। শুধু ফুল চাষ করে সংসারে সচ্ছলতাও ফিরিয়েছেন অনেকে। একজনের দেখাদেখি এ এলাকার আরও কিছু যুবক ও সাধারণ চাষী ফুল চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এমনই এক দম্পতি ফুল চাষ করে সাফল্যের দিশা খুঁজে পেয়েছেন। গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘি গ্রামের কাইউম ও তার স্ত্রী নাদিরা বেগম মিলে প্রথমে ২০০৭ সালে মাত্র তিনকাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ শুরু করেন। সেখান থেকে লাভবান হওয়ায় তিনি পরবর্তীতে এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফুলের চাষ করেন। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে এ দম্পতি এলাকায় ফুলচাষি পরিবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে যশোরের মতো রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ফুল চাষে বিপ্লব ঘটেছে। কৃষকরা ধান, সবজি, গমের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জার্বেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদাসহ বিভিন্ন জাতের ফুলচাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ফলে এ অঞ্চলে প্রতিবছর ফুলচাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল চাষীরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ফুল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া, নাটোরের বাজারে বিক্রি ছাড়াও বিদেশে রফতানি হচ্ছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাদিপুর গ্রামের প্রান্তিক চাষী কাইউম আলী তিন বছর ধরে ফুলচাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। চলতি বছর একবিঘা জমিতে গ্লাডিওলাস চাষে খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেছেন। আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হবে। ফুলচাষি আব্দুল কাইউম বলেন, ধান, গম, শাকসবজি চাষ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেননি তিনি। তবে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলামের পরামর্শে রবি ফসল হিসেবে প্রথমে ১৫ কাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা ও রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেন। প্রথম বছরে ফুলচাষ করে ৭০ হাজার টাকা লাভ হওয়ায় প্রতিবছর ধান, গমের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করে আসছেন। ফুলের পাইকাররা জমি থেকেই তার উৎপাদিত ফুল কিনে নিয়ে যান। উপজেলার সোনাদীঘি গ্রামের মোশারফ হোসেন ১৫ কাঠা জমিতে ফুল চাষ করে গত বছর ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ করেন। আর বগদামারী গ্রামের শেখ ফরিদ ৫ কাঠা জমিতে ফুল চাষ করে সাফল্য পাওয়ায় এবারো ফুল চাষ করেছেন। উপজেলার বিদিরপুর ব্লকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা ধান, গম ছাড়া অন্য ফসল চাষে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু কিছু আগ্রহী কৃষককে অর্থকরি ফসল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফুল চাষের জন্য কয়েকজন চাষীকে যশোরের ঝিকরগাছায় ফুল চাষ পরিদর্শন করানো হয়। এরপর মাঠ পর্যায়ের কৃষি বিভাগের কারিগরি সহায়তায় এ অঞ্চলের কৃষকেরাও ফুল চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। উপজেলার বাউটিয়া গ্রামের আফজাল হোসেন কৃষিতে ডিপ্লোমা করার পর সরকারী চাকরি না পেয়ে কৃষিকাজে নেমে পড়েন। চলতি রবি মৌসুমে ১৫ কাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস ও জার্বেরা ফুলের চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন। আগামী বছর আরও বেশি জমিতে ফুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থকরি ফসল চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এই কৃষক। বাউটিয়া গ্রামে গত ৩ বছর ধরে জাপানের একটি সংস্থা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে জার্বেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা ও দেশী গাঁদা ফুলের চাষ করছেন আধুনিক প্রযুক্তিতে। এ গ্রামের কৃষক মুখলেসুর রহমান মুকুল বলেন, এই গ্রামে উৎপাদিত ফুল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে ফুল জাপানে রফতানি হচ্ছে। মূলত: এ অঞ্চলে এখন ডালিয়া, জিনিয়া, জিনিয়া গাঁদা, চায়না গাঁদা, ক্যাম্বেলুনা, সিলভিয়া, মোরগজটা, হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা, গোলাপ ছাড়াও গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ হচ্ছে। আর গাঁদা ফুলের চাষ তো রয়েছেই। এসব ফুলে জমে উঠেছে শীতকালীন ফুলের কারবার। পুরো মৌসুম জুড়ে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্যের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শীতের প্রকৃতিতে চাষীর বাগানেও উঁকি দিচ্ছে গাঁদা ফুল। হলুদ গাঁদা। কমলা গাঁদা। সোনালী গাঁদা। বেগুনি গাঁদা। গাঢ় লাল রঙের গাঁদা। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে, এমনকি শহরে বাড়ির ছাদে বা বারান্দার টবে- এমন বাহারি রংয়ের গাঁদা চোখে পড়ছে হরহামেশায়। শীতের ও প্রকৃতির সৌদর্য বিকাশে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে নানা রঙ্গের এই গাঁদা ফুল। বাণিজ্যিকভাবে গাঁদা ফুল চাষে নেমেছেন জেলার পবা উপজেলার দামকুড়ার হরিষার ডাইং এলাকার জাফর ইকবাল। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে একবিঘা জমিতে হলুদ গাঁদা ফুলের চারা রোপণ করেছেন। যথারীতি বাগান থেকে ফুল বিক্রি শুরু করেছেন তিনি। এবারের বিজয় দিবসে ফুল ব্যবসায়ীরা তার বাগান থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুলের অর্ডার দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের তুলনায় ফুলচাষে খরচ কম। রোগবালাই নেই বললেই চলে। জমি প্রস্তুতের পরে চারা রোপণ করতে হয়। এক বিঘা জমিতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন ভাল হলে লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, তার ফুল চাষে প্রথমে অনেকে হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু এখন অনেকে ফুলচাষ করার জন্য তার কাছে পরামর্শ নিচ্ছেন। এতে তিনি উৎসাহিত হচ্ছেন বলেও জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, শীতকালীন ফুলের মধ্যে গাঁদা অন্যতম। সাধারণত এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। গাঁদা ফুলের আছে নানান রকম ঔষধি গুণও। এদিকে ফুল চাষীদের চাহিদার কথা ভেবে রাজশাহীতে এগ্রোব্যাক নামের একটি টিস্যু কালচার ল্যাব বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চারা উৎপাদন করেছে। দেশের ফুল চাষীদের আশার আলো জুগিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় এগ্রোব্যাক ল্যাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জার্বেরা, ইউস্টোমা, লিলিয়াম, টিউলিপ, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদন করছে। কৃষকদের মাঝে সেগুলো সরবরাহ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সারাদেশে টিস্যু কালচার ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারত থেকে তারা কোটি কোটি টাকার চারা কিনে থাকেন। এখন দেশে এই প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদন শুরু করেছে তাতে ভবিষতে আর ভারত থেকে চারা আনতে হবে না। এতে দেশের ফুল চাষীরা লাভবান হবে। রাজশাহীতে টিস্যু কালচার ল্যাবের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, আমরা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জার্বেরা, ইউস্টোমা, লিলিয়াম, টিউলিপ, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদন করেছি। কৃষকদের মাঝে সেগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে। গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান বলেন, ফুল চাষের জন্য এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া অত্যন্ত উপযোগী। উঁচু জমিতে ফুলচাষ ভাল হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা ফুল চাষে ঝুঁকছে। আগ্রহী কৃষকদের ফুল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেবে, রাজশাহী অঞ্চলে এ বছর বাণিজ্যিক ফুলের চাষ হচ্ছে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৬ হেক্টর, নওগাঁয় ৩ দশমিক ৩৬ হেক্টর ও নাটোরে ৮ হেক্টার। গত বছরের চেয়ে এ বছর বেড়েছে ফুল চাষ।
×