ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে বর্ণাঢ্য আয়োজন

অসাম্প্রদায়িক লোক মানসের জয়, মঙ্গলের বার্তা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

অসাম্প্রদায়িক লোক মানসের জয়, মঙ্গলের বার্তা

মোরসালিন মিজান ॥ বৈশাখের এখনও বাকি। অনেক বাকি। কিন্তু শনিবার ঢাকার রাস্তায় নেমে অবাক হলেন অনেকেই। মাঘ মাসে দেখলেন বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা! এদিন বিশাল শোভাযাত্রা থেকে উর্ধে তুলে ধরা হয় বাংলার লোকঐতিহ্যকে। হাজারও মানুষের আনন্দ মিছিলে যুক্ত হয় কাগুজে বাঘ, ঘোড়া, পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণী। বাদ যায়নি মুখোশ। ছিল কাল্পনিক বিভিন্ন চরিত্রের উপস্থাপনা। সব দেখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বলেই মনে হয়েছে। আসলে ঘটনা অন্য। বাংলাদেশের মঙ্গল শোভযাত্রা লাভ করেছে বিশ্বস্বীকৃতি। পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’র মর্যাদা দিয়েছে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইউনেস্কো। হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন আগের কথা। তবে সীমাহীন আনন্দের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটল গতকাল বিকেলে। এবার আনন্দঘন উদযাপন করল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আয়োজনের শুরু শিল্পকলা একাডেমি থেকে। এখানে সমবেত হয়েছিলেন শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারী। শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম আখতারী মমতাজ ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ। মঙ্গল শোভাযাত্রার খুব পরিচিত অবয়বগুলো বহন করেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মূল সড়কে নেমে আসেন তারা। শোভাত্রাটি মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, শিশুপার্ক, শাহবাগ হয়ে চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়। স্বাভাবিক কারণেই অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, আনুষ্ঠানিক শুরুর পর কেটে পরবেন মন্ত্রী ও সচিব। কিন্তু উচ্ছ্বাস এত ছিল যে, দুজনই পুরোটা পথ হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন। পাশাপাশি হেঁটেছেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেনসহ কয়েকটি অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। উৎসবমুখর আয়োজনের সঙ্গে যোগ দেন অনেক সাধারণ মানুষ। আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজনও আগ্রহ নিয়ে তাকান। চমৎকার আয়োজনের মাধ্যমে নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয় মঙ্গলের বার্তা। অশুভ, অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার কথা আরও একবার জানিয়ে দিয়ে যান সংস্কৃতিকর্মীরা। অসাম্প্রদায়িক লোক-মানসের জয় ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পর্বের আয়োজন ছিল চারুকলার বকুলতলায়। এখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার পূর্বাপর ইতিহাস, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমেই চারুকলা অনুষদের পক্ষে বলেন ভারপ্রাপ্ত ডিন শেখ আফজাল। তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। এটি চারুশিল্পীদের অনেক বড় অর্জন। ১৯৮৬ সালে যশোরে এটি শুরু হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আয়োজন করা হয়। চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথম শোভাযাত্রা আয়োজনের স্মৃতি রোমন্থন করে শহীদ আহমেদ মিঠু বলেন, একটি বিরুদ্ধ সময়ে শুরু করেছিলাম আমরা। স্বৈরশাসক এরশাদ তখন ক্ষমতা দখল করে আছে। ফলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় অনুষদের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে কাজ করেছিলাম। পরবর্তিতে আমাদের এক শিক্ষককে নির্যাতন করা হলে প্রতিবাদী কর্মসূচী পালন করি আমরা। সেই ঐক্য মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনে সহায়ক হয়েছিল বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বৈরাচার সরকারের আমলে কথা বলারও স্বাধীনতা ছিল না। সেই সময় আমাদের তরুণরা সৃজনশীল চিন্তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে তারা সত্যকে প্রকাশ করেন। তাদের সেই সাহসী পদক্ষেপের কারণে আজকের এই স্বীকৃতি। একই কথার প্রতিধ্বনি করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আক্তারী মমতাজ বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অশুভর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। আমরা যে সৃমদ্ধ মানবিক বোধসম্পন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সেই বাংলাদেশের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর পর কথা বলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি মঙ্গল শোভাযাত্রার অর্জনে বাংলা একাডেমির ভূমিকা ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, নমিনেশন ফাইলটি তৈরি করেছিল বাংলা একাডেমি। এটা খুবই জটিল কাজ। বাকি নমিনেশন ফাইলগুলোও একাডেমি তৈরি করতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, কাজটা আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। আমরা যদি করি তাহলে নব্বই ভাগ নিশ্চয়তা থাকে সাফল্য পাওয়ার। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ‘নবিশগীরি পর্যায়ে’ আছে দাবি করে তিনি বলেন, তারা (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অধীন অন্য সব প্রতিষ্ঠান) করলে আর কোন স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না। এর পর আলোচনা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলা একাডেমির মহারিচালকের বক্তব্য তেমন আমলে না নিয়ে তিনি বলেন, কাজটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করছে। সবার প্রচেষ্টাতেই স্কীকৃতি। মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যান্য দিক উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান আমল থেকেই নববর্ষ উদযাপন আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন জঙ্গীবাদের বিস্তার দেখছি, হলি আর্টিজানের হামলায় আমাদের তরুণদের সম্পৃক্ততা দেখছি। এই তরুণদের বিপথগামিতা রুখতে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বাউল গান, জামদানি বুনন শিল্প ইউনেস্কোর মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। আরও কিছু সাংস্কৃতিক উপাদান স্বীকৃতিপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। সব শেষে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ পর্বের শুরুতেই দীপা খন্দকারের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করে দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের নৃত্যশিল্পীরা। তারা ‘মঙ্গল হোক এই শতকে মঙ্গল সবার...’ গানের সঙ্গে মঙ্গল নৃত্য পরিবেশন করেন। নির্মল কুমার দাসের পরিচালনায় ছিল দোতরার পরিবেশনা। ‘লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি বালা না আমার’, ‘সোনার বান্দাইলেনও’সহ কয়েকটি লোকজ গানের সুর বাজিয়ে শোনান তারা। ঢাক-ঢোলের লড়াই ও ঢাকী নৃত্য বিশেষ উপভোগ করেন দর্শক। ছিল কিশোরগঞ্জের ওসমান লাঠিয়াল ও তার দলের লাঠিখেলা। মঞ্চে আরও ছিলেন কুদ্দুস বয়াতী। তিনি গেয়ে শোনান ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো’সহ কয়েকটি জারি গান। এরপর শিল্পকলার রেপার্টরি যাত্রাদল মঞ্চস্থ করে যাত্রা ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’র চুম্বক অংশ। অন্তর দেওয়ানের পরিচালনায় রাঙ্গামাটির বম সম্প্রদায়ের শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল বাঁশনৃত্য। সব মিলে দারুণ একটি উদযাপন।
×