ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দুটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে দুই তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

সরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

সরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর দুটি সরকারী হাসপাতালে অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। জাতীয় কিডনি হাসপাতাল এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কিছু অব্যবস্থাপনা নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় মন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিগুলোকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ছয় মাস ধরে এক্স-রে মেশিন নষ্ট পড়ে থাকার কারণ ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে এই ব্যাখ্যা জমা দেয়ার জন্য তিনি বলে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে হৃদরোগ হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (প্ল্যানিং) প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিডনি হাসপাতালের জন্য আজ রবিবার কমিটি গঠন করা হবে। সরকারী হাসপাতালসমূহের বিরুদ্ধে অভিযোগ ॥ সরকারী হাসপাতালগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে পারছে না সরকার। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সিন্ডিকেট সদস্যদের পরিকল্পনায় চলে সরকারী হাসপাতাল। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাসমূহ। বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ, জনবল ও চিকিৎসা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ, মজবুত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও সরকারী হাসপাতালগুলোর সেবার মান তেমন বাড়েনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকার পরিবর্তন হলে সিন্ডিকেট সদস্যদের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু পুরনো স্টাইলেই চলে সব অপকর্ম। রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসক ও নার্সদের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রাজধানীর প্রায় সব ক’টি হাসপাতালে পাওয়া গেছে। নিজ স্টাইলে চলেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালে তাদের প্রবেশ ও বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কেউ বলতে পারেন না। সিট বার্ণিজ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে ব্যস্ত থাকেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা। নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের মাধ্যমেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী ওষুধসমূহ বাইরে পাচার হয়ে থাকে। মেডিক্যাল যন্ত্রাংশ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিনামূল্যের চিকিৎসায় ফি দিতে হয় সরকারী হাসপাতালে। জরুরী বিভাগ থেকে রোগীর শয্যা পর্যন্ত পৌঁছার চিকিৎসা ব্যয় (ট্রলিম্যান ও শয্যা যোগানদাতা) লিখিত থাকে না। শয্যায় ওঠার পর চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলা। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কোন ফ্রি নেই। ইউজার ফি আদায়ের নামে এখানে রোগীদের ফি প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক পরীক্ষা বাইরে গিয়ে করাতে হয়। উচ্চ মূল্যের ওষুধ এবং চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে লেখা কোম্পানির ওষুধ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাওয়া না গেলেই রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। শুধু চিকিৎসককে এবং রোগীর খাবারের ক্ষেত্রে কোন টাকা দিতে হয় না। তবে চুক্তিবদ্ধ বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা জন্য রোগী পাঠিয়ে সরকারী হাসপাতালে ফ্রি রোগী দেখার টাকা উঠিয়ে নেন অনেক চিকিৎসক। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে ট্রলিম্যানদের টাকা দিতে হয়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ফ্রি বেড বলে কিছু নেই। টাকা ও তদ্বির না হলে ফ্রি বেড পাওয়া যায় না। সার্জারি ও আইসিইউ রোগী হলে তো খরচের শেষ নেই। এভাবে পদে পদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ মেটাতে গিয়ে সরকারী ফ্রি চিকিৎসা যেন সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে! সরকারী স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় অংশই জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। আর দালালদের মাধ্যমে অর্থ লুট ও সীমাহীন হয়রানি সরকারী হাসপাতালের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারী হাসপাতালে কেবল হৃদরোগই নয়, ক্যান্সার, কিডনি, লিভারসহ অধিকাংশ রোগের চিকিৎসার পেছনেই বেশ অর্থ ব্যয় করতে হয়। পরীক্ষা ফিও বেশি। একটি সিটিস্ক্যান ও এমআরআই করাতে লাগে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। হতদরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে পরীক্ষাগুলোর সুযোগ থাকলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। যত গরিব রোগীই হোক না কেন, ওসব পরীক্ষা করাতে ভর্তি হতে হয়। এরপর রেডিওলজি বিভাগে পরীক্ষার সিরিয়াল পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১৫ থেকে ২০ দিন। সরকারী হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসারও ব্যয় অনেক। এ খরচ বহন দুঃসাধ্য হওয়ায় বিনা চিকিৎসাতেই মারা যান গরিব ও দুস্থরা। অবশ্য কেউ কেউ ধার-কর্জ করে চিকিৎসা করান। দায়িত্ব পালনে অবহেলা ॥ সরকারী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়টি দীর্ঘ বছর ধরে বেশ আলোচিত হয়ে আসছে। বর্তমান সরকারও এ সমালোচনা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারী চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার ফের বেড়েছে। তাদের কেউ কেউ কর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর দিয়েই চলে যান। অনেকে আসেন দিনের শেষ বেলায়। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসকদের দেখা পায় না রোগীরা। তবে নিজেদের আবাসিক কক্ষে গড়ে তোলা অবৈধ চেম্বারে অফিস সময়ে চড়া ফি নিয়ে রোগী দেখতে ভোলেন না চিকিৎসকরা। কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত পরিদর্শন টিমের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। থানা পর্যায়ে টিমের সদস্যরা যান না। নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেও উপস্থিতির হার প্রত্যাশিত পর্যায়ে নিতে পারছে না সরকার। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে পালাক্রমে ছুটি কাটানোর ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ॥ হাসপাতালের কর্মকর্তা, কর্মচারী, চিকিৎসক ও নার্সসহ বাইরের রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের থাকে আলাদা সিন্ডিকেট। তাদের সঙ্গে আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা সম্পৃক্ত থাকেন। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক থাকে হাসপাতালের কর্মকর্তা ও নার্সদের। চিকিৎসকদের থাকে পৃথক একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের চিকিৎসকদের আসা-যাওয়ার বিষয়টি কেউ বলতে পারেন না। পুরো সপ্তাহের একদিন স্বাক্ষর করলেও অনেক চিকিৎসকের কোন অসুবিধা হয় না। সিট বাণিজ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে তৎপর থাকেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা। নার্সদের একটি অংশও সিট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকেন। বাইরে ওষুধ সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন অনেক নার্স ও স্টোর রুমের দায়িত্বে থাকা লোকজন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে থাকে। সরকারী হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যের এবং ৩০ শতাংশ বেডের জন্য সামান্য ভাড়া নির্ধারিত আছে। এছাড়া রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীকে স্বল্প পরিমাণ ইউজার ফি বহন করতে হয়। ভাড়ায় বেডে থেকে এবং ইউজার ফি প্রদানের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিলেও কোন রোগীর মোট খরচের ১৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। সরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর আউটডোরে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা আর ভর্তি হতে ১৫ টাকা। ভর্তির পর থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সব ব্যয় সরকারই বহন করে থাকে।
×