ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বটতলার ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের তিন মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

বটতলার ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের তিন মঞ্চায়ন

সাজু আহমেদ ॥ ঢাকার মঞ্চে অন্যতম তারুণ্য নির্ভর নাট্যদল বটতলা। উদ্যোমী এই নাট্যদলের নতুন নাটক ‘ক্রাচের কর্নেল’ গত বছরের ডিসেম্বরে মঞ্চে এসেছে। দলের ৯ম এই প্রযোজনাটির এ পর্যন্ত দুটি মঞ্চায়ন হয়েছে। কর্নেল তাহেরের জীবনভিত্তিক এই নাটকটি ইতোমধ্যে প্রশংসিত প্রযোজনাগুলোর মধ্যে গণ্য হয়েছে। কারণ এই নাটকের মাধ্যমে বটতলা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অস্থির সময়কে উন্মোচন করতে চেয়েছে। অনেক তর্ক-যুক্তি এবং জানা-অজানা অনেক বিষয়ের বিশ্লেষণাত্মক উপস্থাপনার মাধ্যমেই মূলত নাটকটির গল্প এগিয়ে চলে। নাটকের গল্প এবং শিল্পীদের সাবলীল অভিনয় প্রযোজনাকে ঋদ্ধ করেছে। যা সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করে। দল সুত্রে জানা গেছে ঢাকায় মঞ্চায়নের পর চলতি জানুয়ারি মাসে ঢাকার বাইরে নাটকটি তিনটি মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামা ক্লাবের বাৎসরিক নাট্যোৎসবে স্থানীয় করোনেশন নাট্য মঞ্চে গত ১৮ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় নাটকটির তৃতীয় মঞ্চায়ন হয়। আগামী ২৭ জানুয়ারি ৭ম কুমিল্লা সংস্কৃতি উৎসবে চতুর্থ এবং ৪ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকের পঞ্চম মঞ্চায়ন হবে। শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা ও সৌম্য সরকার। নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। ‘ক্রাচের কর্নেল’ প্রযোজনায় দেখানো হয়েছে নানা দুঃখ, কান্না, সাহসের গল্প থেকে একটি নাটকের দল এক কর্নেলের গল্প বলতে শুরু করে। এক বা একাধিক স্বপ্নবাজ, পাগল, মৃত্যুর নেশায় পাওয়া মানুষদের গল্প। একটি সময় ও দুঃসময়ের গল্প। একটি স্থানের ও কালের গল্প হয়েও যেটি কেবল একটি স্থানের ও কালের গল্পমাত্র নয়। লোকে বলবে ঐতিহাসিক গল্প কিন্তু যারা জানে ইতিহাস মানুষের হাতে রচিত হয়Ñ অনেক সময় কিছু মানুষের প্রয়োজনে, যে মানুষগুলো ক্ষমতাধর তাদের কাছে ইতিহাস একটি জটিল বিষয় আর যেহেতু সময়ের বদলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা বদল হয়। নাটকের দলটি তাই তাদের গল্প তাদের মতো করে বেছে নেয় আর তাদের মতো করে বুঝবার ও বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু, এই দলটি যেহেতু সমকালের অংশ তাই সেও সঙ্কটমুক্ত নয় তাদের সঙ্কট তারা এখনও নায়ক খুঁজে পায়নি, নায়ক বুঝেও পায়নি তারা আবার এমন এক দেশের গল্প বলে যে দেশটিও নায়ক খুঁজে পায়নি, বুঝে পায়নি। কিন্তু নায়ক কেন লাগবে? নায়ক ছাড়া চলবে কেন? গ্যালিলিও নাটকের চরম সঙ্কটকালে শিষ্য আন্দ্রেয়া বলে বসে : সেই দেশই দুর্ভাগা যে দেশ কোন নায়কের জন্ম দেয় না। গ্যালিলিও মৃত্যুর ভয়ে এইমাত্র তার সত্য বিক্রি করে এসেছে চার্চের কাছে আন্দ্রেয়া তাই গভীর মর্মবেদনায় উচ্চারণ করে এই বাক্য গ্যালিলিও যে তার নায়ক ছিল! গুরু গ্যালিলিও জবাব দেয় মর্মপীড়ায় : না আন্দ্রেয়া, সেই দেশই দুর্ভাগা যে দেশের একজন নায়কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ তো আর রবীন্দ্রনাথের আইডিয়াল রাজ্য নয় যেখানে আমরা সবাই রাজা! নাটকের দলটি সেই অর্থে দুর্ভাগা, বাংলাদেশ সেই অর্থে দুর্ভাগা। কর্নেল তাহেরের জীবনের প্রস্তুতি, প্রেম, সংগ্রাম ও মৃত্যুর গল্প বলতে গিয়ে নাটকের দলটিকে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বিস্তৃত ঘটনারাশির কথা বলতে হয় তখনই সঙ্কট! মিডিয়ার দখলে থাকা সংস্কৃতির ভাগিদার হয়ে, পরস্পরবিরোধী ইতিহাস ব্যাখ্যার অংশ হয়ে দলটির সদস্যদের কাছে ইতিহাস জটিল হয়ে ওঠে, কেউ না কেউ ইতিহাস খেলে বলে মনে হয় কিন্তু এত বড় জাল ছিঁড়ে কে নায়ক বনবে? কে হবে যোগ্য কর্নেল তাহের? অথবা কর্নেল তাহেরই কি সেই আরাধ্য নায়ক যাকে দেশ খুঁজে পায়নি? অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের নায়করা ও খলনায়করা, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নায়করা ও খলনায়করা, মুক্তিযুদ্ধের পরের নায়করা ও খলনায়করা কি তাদের পরিচয়ে স্থির থেকেছেন? এসব প্রশ্ন অবধারিত। সবাই না হলেও অনেকেই আসেন মঞ্চে, চলে যান। মঞ্চের বাইরে থাকেন কেউÑ থিয়েটারের ভাষা এভাবে তৈরি হয়। মূল কথা সময়। সামষ্টিক সময়। একটি দল যেমন দেশের সঙ্কটকে মূর্ত করে, দেশও তেমনি বিশ্বের বাইরের নয়। একটি কাল কাউকে নায়ক হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়, আবার কালই পথ ভেঙে ফেলে। এক কাল অতিক্রান্ত হলে সেই কালের ব্যাখ্যা দাঁড় করায় মানুষ। নায়ক ও খলনায়ক বেছে নেয় তারাই। ক্রাচের কর্নেলও একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা। এমনটাই মত নাট্য সংশ্লিষ্টদের। নাটকের নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন,কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের লেখা আমার ভাল লাগে। ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’ ছোট গল্পের বইটি একসময় আমি খুব চর্চা করতাম। আমাদের ‘দি ট্রায়াল অফ মালাম ইলিয়া’র মহড়ায় পড়েছি ‘ক্রাচের কর্নেল’ রাজনীতির কূটকৌশল, হত্যা, ক্যুর রাজনীতি বোঝার জন্য। উপন্যাসটি পড়ে অনেক লোভ হয়। এই রকম বৃহৎ ক্যানভাস কিভাবে মঞ্চে আসবে? বাংলাদেশের রাজনীতির পরিচিত মুখগুলোর মুখোশ কিভাবে উৎপাটন হবে। রাজনীতির ইতিহাস বড় গোলমেলে। একেক জন একেকভাবে গল্প-ব্যাখ্যা-বিশেষণ দাঁড় করায়। ইতিহাসের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের বয়ানও গোলমেলে ঠেকে বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতিতে নতুন ভূমিকার প্রেক্ষাপটে। সাহসী মানুষ যে শত বিপদে নিজের মতো ও সত্যে থাকেন নির্ভীক, সেই রকম রাজনীতির মানুষ এই দেশে বিরল। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর মতো নির্ভীক ও সত্যবাদী রাজনীতিক এই দেশের মানুষ আর কোনদিন পাবে না। মৃত্যুর সামনেও সহজে টলেননি, থেকেছেন সাহসের দৃপ্ততা নিয়ে। তাহেরও তেমনি এক নির্ভীক মানুষ। নিজের দৃঢ় মনবলে পথ চলেছেন, মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান রাজনীতিতে সিলিকন মেরুদে র মানুষের আধিক্য। সৎ সাহস নিয়ে কথা বলার, মতামত প্রকাশের মানুষ নেই। পৃথিবীর সব বিপ্লবীদের মতো তাহের আমাদের দীক্ষা দেন নির্ভীক হবার সত্য বলার, মৃত্যুতে টলে না যে বীর। বটতলার সবাই অনেক আগ্রহ ও ভালবাসা নিয়ে ব্রতী হয়েছেন ইতিহাসের গহ্বর উন্মুক্ত করতে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিশেষ করে সামিনা লুৎফা নিত্রা, রোকসানা রুমা ও ইমরান খান মুন্নার প্রতি আমার অশেষ ভালবাসা-কৃতজ্ঞতা। ‘ক্রাচের কর্নেল’ নতুন ভাবনা, নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করবে এবং তা খ ন করবে পরবর্তী প্রজন্ম এই আশাই পরিশেষে বটতলার সবার। ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ইমরান খান মুন্না, কাজী রোকসানা রুমা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, তৌফিক হাসান ভূঁইয়া, বাকীরুল ইসলাম, পংকজ মজুমদার, ইভান রিয়াজ, ম. সাঈদ, নাফিজ বিন্দু, সবুজ সরকার, মনজুরুল ইসলাম রনি, গোলাম মাহবুব মাসুম, নাফিউল ইসলাম প্রমুখ। নাটকের নেপথ্য কর্মীরা হলেন সহকারী নির্দেশনা ও মঞ্চ পরিকল্পনায় ইমরান খান মুন্না, পোশাক পরিকল্পনায় হুমায়রা আক্তার, কোরিওগ্রাফি সামিনা লুৎফা নিত্রা, আলোক পরিকল্পনায় খালিদ মাহমুদ সেজান, আলোক প্রক্ষেপণে এটিএম মহিবুল্লাহ, দ্রব্য সামগ্রী পরিকল্পনায় ম. সাঈদ, আবহ সঙ্গীত পিন্টু ঘোষ, আবহ সঙ্গীত নিয়ন্ত্রণ নীলাঞ্জনা সেজুতি, পোস্টার ডিজাইন জাহেদুল হক রনি, প্রযোজনা তত্ত্বাবধান তৌফিক হাসান ভূঁইয়া, মঞ্চ ব্যবস্থাপক মনজুরুল ইসলাম রনি, রূপসজ্জায় আবদুল কাদের।
×