ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

(গতকালের পর) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে সচিব সভাপতি। আছেন অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক), অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক), অতিরিক্ত সবিচ কারিগরি) অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা), যুগ্ম সচিব (কলেজ), যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক-১) যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক-২). মাউশি অধিদফতরের মহাপরিচালক, নায়েমের মাহপরিচালক, কারিগরি অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদ্রাসা অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, এনসিটিবির চেয়ারম্যান, ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির সদস্য কারিকুলাম (মাধ্যমিক)। এছাড়া আছেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জান. ড. সিদ্দিকুর রহমান, শাহীন কবির, অধ্যাপক কায়কোবাদ, এনামুল হক এবং এসইএসইপি প্রকল্পের পরিচালক’ [জনকণ্ঠ ১০.১.১৭] এদের যেখানে পাবেন সেখানেই জিজ্ঞেস করবেন, হেজাবিরা কি দিয়েছে যার কারণে পাঠ্যবইয়ের পাকিস্তানীকরণে তারা সায় দিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে কোন সমালোচনা বা অভিযোগ কেউ করেন না ভয়ে। সবাই জানেন, শিক্ষামন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে পছন্দ করেন। এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কে কিছু বললে প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা বিলক্ষণ। যেচে কে আর প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হতে চায়। মন্ত্রণালয়ের কাজে ভুল থাকতে পারে, কিন্তু সেটি উল্লেখ করলে মন্ত্রী, সচিব বা কর্মকর্তারা তা ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে করেন। এতসব জেনেও বলছি শিক্ষা ক্ষেত্রে তুঘলকি কান্ড চলছে এক কথায় যাকে অরাজক বলা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরুন। মঞ্জুরি কমিশন একটি আছে বটে কিন্তু তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। অনেকটা মানবাধিকার কমিশনের মতো। পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোন দায়বদ্ধতা নেই। রাজনৈতিক বিচারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং এত বয়োকনিষ্ঠদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যে, শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রেও তথৈবচ। এ রাজনৈতিক কানেকশনের কারণে সব আমলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অরাজক অবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টারগুলোও তাদের থেকে খারাপ নয়। যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোন নিয়মকানুন মানছে না, মঞ্জুরি কমিশন বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা নেয়ার আগ্রহও নেই। কলেজগুলোর অবস্থাও ভাল নয়। যেসব কলেজে অনার্স খোলা হয়েছে সেখানে যথেষ্ট শিক্ষক বা উপযুক্ত বই বা ল্যাবরেটবি নেই। কলেজ শিক্ষকদের একটি বড় অংশকে প্রশাসনে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এদের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের আত্মীয়। যে যে বিষয়ের সে সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ না হয়েও প্রেষণে আছেন। দর্শনের শিক্ষক ইংরেজীর, ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ বৌদ্ধধর্মের- এ রকম আরবী! পদায়নের এই হরিলুটের জন্য অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়ী। মাদ্রাসায় সরকারী খরচে সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী পাঠক্রম চালু করা হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসাতেই। কওমি তো সত্যিকারের আজাদ। মাদ্রাসার প্রতি গভীর এক ভালবাসা পোষণ করেন শিক্ষামন্ত্রী। অনেক বক্তৃতায় সেটি বলেছেনও। অথচ তাঁর কাছে বারংবার ধরনা দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য করাতে পারেনি। এ সরকারের সবাই কোন্ ধরনের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা মুক্তিযুদ্ধ বলতে তারা কী বোঝেন তা স্পষ্ট নয়। স্কুলগুলোর অবস্থাও এর চেয়ে ভাল নয়। প্রাথমিক শিক্ষা যতই বাধ্যতামূলক করা হোক না কেন প্রাথমিক স্কুলগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। সরকার শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করেছেন বটে, কিন্তু কারা নিয়োগ পাচ্ছেন সে নিয়েও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে শিক্ষার হার বাড়ানো এবং মান উন্নত হচ্ছে এটি প্রচারের জন্য জিপিএ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ ও পাসের হার বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে কালের কণ্ঠ ৮ জানুয়ারি এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় ভুল উত্তরেও নাম্বার দেয়া হয়েছে। আমি সেখান থেকে কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করছি- ১. ‘গত বছর জেএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রশ্ন ছিল, ‘কুনো ব্যাঙকে কেন উভচর প্রাণী বলা হয়?’ উত্তরে একজন লিখেছে, ‘কুনো ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে চলে বলে একে উভচর প্রাণী বলা হয়।’ আরেকজন লিখেছে, ‘কুনো ব্যাঙ ঘরের কোনে থাকে বলে একে উভচর প্রাণী বলা হয়।’ উত্তর ভুল হলেও পরীক্ষক উভয় শিক্ষার্থীকেই ২ নম্বরের মধ্যে ১ করে দিয়েছেন।’ ২. ‘বাঘ ও কুমির প্রাণিজগতের কোন্ শ্রেণীভুক্ত?’-এ প্রশ্নের উত্তরে জেএসসির এক শিক্ষার্থী লিখেছে, ‘বাঘ ও কুমির মাংসাশী প্রাণী। তারা উভয়েই ভয়ঙ্কর প্রাণী। সামনে পেলেই মানুষ খেয়ে ফেলে।’ উত্তর ভুল, তবু ৪-এর মধ্যে ২ নম্বর দিয়েছেন পরীক্ষক।’ ৩. ‘বিজ্ঞানে আরেকটি প্রশ্ন ছিল, চাঁদে গেলে বস্তুর ওজন কেমন থাকে?’ একজন পরীক্ষার্থী লিখেছে, ‘চাঁদে গেলে বস্তুর ওজন শূন্য হয়ে যায়। কারণ আমরা চাঁদে গেলে সবাই বাটুল হয়ে যাব।’ আরেকজন লিখেছে, চাঁদে গেলে আমরা সবাই ডরিমনের মতো হয়ে যাব।’ দুটি উত্তরই ভুল। তবু পরীক্ষক ৩-এর মধ্যে ১-২ করে নম্বর দিয়েছেন।’ একজন পরীক্ষক জানিয়েছেন- ‘অনেক প্রশ্নের উত্তরই ডাহা ভুল লিখেছে পরীক্ষার্থীরা। তাদের ফেল করার কথা। কিন্তু প্রধান পরীক্ষক বলে দিয়েছেন, কাউকে ফেল করানো যাবে না। তাই উত্তর ভুল হলেও নম্বর দিতে বাধ্য হয়েছে।’[ঐ] শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ করেনি কারণ, পত্রিকাটি খাতা যোগাড় করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আমরা এ ধরনের অভিযোগ করলে সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আপনারা আমাদের বিরুদ্ধে লেখেন অথচ বিএনপি পক্ষের লোকজন বিএনপির বিপক্ষে লেখে না। সমর্থক হওয়া মানে দাসখত দেয়া নয়। বিএনপি-জামায়াত ভুল করলে যদি প্রতিবাদ করতে পারি তাহলে বর্তমান সরকার ভুল করলেও প্রতিবাদ করা শ্রেয়। কেননা, আমরা এ সরকারকে সমর্থন দিয়েছি। ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছি। ভুলের কারণে সরকার তার সমর্থকদের ভুল বার্তা দেবে। জনপ্রিয়তা বা সমর্থন হ্রাস করাবে সেটি আমাদের পক্ষে মানা কষ্টকর। তাছাড়া, প্রায় পাঁচ দশক আমরা অনেকে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনাচার প্রতিরোধ আমাদের কর্তব্য। আজকের দুইমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনীতিতে পোক্ত হয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে যা হচ্ছে সে পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নীরবতায় সবাই বিস্মিত। শুধু তারা কেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রিসভার অধিকাংশ ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনীতিতে এসেছেন। এবং সে আন্দোলনে বড় অংশ ছিল শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন। সেক্যুলার শিক্ষাকে মাদ্রাসাকরণে তাদের নীরবতা তাদের সমর্থনই ব্যক্ত করে। আমরা এ কথা বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং বঙ্গবন্ধুর মূল আদর্শের বিরোধী কাজ করছে। সরকার নানাক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্ট চালাতে পারে কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে এক্সপেরিমেন্ট করা উচিত। পঞ্চম শ্রেণিতে পরীক্ষা নেয়া বা ১ তারিখ বই পৌঁছে দেয়া কৃতিত্ব বটে তবে বড় কৃতিত্ব নয়। এগুলো মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজ। কৃতিত্ব হলোÑ একটি জাতিকে শিক্ষিত ও অসাম্প্রদায়িক করে তোলা। বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্কাইস্ক্রাপার উন্নতির একমাত্র মাপকাঠি নয়। শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতিই সভ্যতার মাপকাঠি। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা হচ্ছে আর কিছুদিন পর সরকারের সমর্থন ধরে রাখা কষ্টকর হবে। আত্মসন্তুষ্টি রেখে আমরা কী বলছি তা বোঝার চেষ্টা করুন। জী হুজুর আমলা, জী হুজুর পার্টনার ব্যবসায়ী, জী হুজুর কর্মিদল, জী হুজুর মাঝারি গোছের নেতাÑ বিপদে কেউ থাকে না, থাকেনি। ১/১১ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজ যে সব পত্রিকা এবং টেলিভিশনে এসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলো বিএনপি-জামায়াতের পক্ষের নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। এ বারের সরকারের হাঁটু গেড়ে বসা দেখে সবাইর ঘেন্না জাগছে। সে কারণেই ক্ষোভের উদগিরণ। স্বদেশ রায় যা লিখেছেন জনকণ্ঠে সেটি প্রত্যাখ্যান করা কি সহজÑ “সমাজের অন্যতম উপাদান রাজনীতি আজ অনেকাংশে দুর্বৃত্তদের হাতে। শিল্পায়নের থেকে শিল্পায়নের নামে পাবলিক মানির নয়-ছয়ই বেশি হচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সংবিধানের মৌলনীতিগুলোকে রাষ্ট্রের এমন এমন স্থান থেকে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে তা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এমনকি সংবিধান সবটুকু না মেনেও দেশে রাজনীতি করছে অনেক রাজনৈতিক দল, তাদের জনপ্রিয়তাও কম নয়। কোন কোন রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সংবিধানে মূল চরিত্র বদল করার কর্মসূচী দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষার মান প্রতিদিন নেমে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে, আন্তর্জাতিক মান তো দূরে থাকুক এশীয় মানের গ্র্যাজুয়েটও দেশে তৈরি হচ্ছে না। তাছাড়া শিক্ষার ভেতর দিয়ে এমন একটি শ্রেণী বের হয়ে আসছে নাÑ যে শ্রেণী জাতির জন্য যুগোপযোগী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনবে এবং ওই পরিবর্তনের নেতা হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি করতে পারছে না সমাজ ও রাষ্ট্র। ফলে সমাজের নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে, প্রাচীন সভ্যতার চিন্তা-চেতনার দিকে। যার ফলে সমাজ ক্রমেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তথাকথিত ধর্মীয় চেতনা দিয়ে। সমাজ যে চেতনা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে ওই সমাজের সবকিছুতে তার প্রভাব পড়বে। তাই শিশু শিক্ষার বই এ সমাজে এমন হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং বলা যায়, সমাজ যেভাবে চলছে তাতে এমন বই শিশুদের হাতে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা এবং এখানে প্রতিবাদকারীর সংখ্যাও অতি কম হবে।”[ঐ] ॥ চার ॥ পাঠ্যবই কেলেঙ্কারি নতুন নয়, প্রতি বছরই হচ্ছে। কোন বছর না হলে সেটি অস্বাভাবিক। এর আগে পাঠ্যবইয়ে যা হয়েছে অর্থাৎ ভুল বা কেলেঙ্কারি তার জন্য কেউ শাস্তি পায়নি। এবারও পাবে না। এবং কমিটির যারা ছিলেন তারাই থাকবেন। কর্তৃপক্ষের আশা, খুব শীঘ্রই নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ মারামারি লেগে যাবে, সাংবাদিকরা সেদিকে ছুটবেন। ফলে একঢিলে দু’পাখি মারা হলো। হেজাবীদের মন রক্ষা করা হলো, অন্যদিকে, যেসব মেরুদ-হীন চামচারা জড়িত তাদেরও রক্ষা করা গেল। এ সমাধান সাময়িক। তারপর? সমাজ যে রকম সচেতন হয়ে উঠছে তাতে ইচ্ছাকৃত এই অপরাধের জন্য এক সময় না একসময় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সম্পূর্ণ শিক্ষা সেক্টরে যে অরাজকতা চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য মন্ত্রণালয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা বাঞ্ছনীয়। জাশিপাবোকেও। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক। বিশেষজ্ঞ ছাড়াও যে পর্যায়ের পাঠ্য সে পর্যায়ের শিক্ষককে রাখতে হবে। জাশিপাবোতে যদি আজীবন প্রেষণে রাখতে হয় তাহলে তার জন্য আলাদা ক্যাডার করাই ভাল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলা দিয়ে জাশিপাবো কমিটি করা যান্ত্রিক ও বাঞ্ছনীয় নয়। পাঠ্য বইয়ে ভুলের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষকদের দিয়ে নম্বর বৃদ্ধি করে জিপিএর সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে এসব ‘ব্রিলিয়ান্ট’ ছাত্র-ছাত্রীদের ৩ থেকে ১০ ভাগ মাত্র পাস করছে। এ ধারা চলতে থাকলে এ হার আরও কমবে। এবার পাঠ্যবইয়ে যা হলো তার দুটো দিক আছে। এক. বানান ভুল ও পরিবর্তন। এত বানান ভুল পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারে না। যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়ে দক্ষ প্রুফ রিডার রাখা যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনি যে বিশেষজ্ঞের দায়িত্বে থাকা বইয়ে এমনতর ভুল পাওয়া যাবে তাকে তার জন্য কাফফারা দেয়ার বিধান রাখতে হবে। জাশিপাবোর সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরী। যারা মূল পাঠে পরিবর্তন এনেছেন তাদের অযোগ্যতা, অজ্ঞতা ও অহমিকা সীমাহীন। একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। দুই. হেজাবি বা হেফাজতিদের নির্দেশ মানা। যেসব কমিটি এ নির্দেশ মেনেছে তাদের কৈফিয়ৎ দাবি করতে হবে এবং চিহ্নিত করতে হবে। সেটি করতে ব্যর্থ হলে ধরে নিতে হবে এটি মন্ত্রী বা আরও ওপরের নির্দেশে করা হয়েছে। সেটির দায় তাহলে তাদেরও নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্য এবং আমাদের জেনারেশন পাকিস্তান আমলে পাঠ্যবই পড়ে বড় হয়েছি। সেখানেও সংশোধন পরিমার্জন ছিল কিন্তু এ রকম নয়। এতটা সাম্প্রদায়িকীকরণও হয়নি। হলে তো আমরা বিএনপি-জামায়াত করতাম। প্রতিবছর পাঠ্য বই নিয়ে এত কেলেঙ্কারি হয়নি। প্রতিবছর পাঠ্যবইয়ে রাশি রাশি বানান ভুল থাকেনি। এখন কেন তা হচ্ছে তা পুরো মন্ত্রিসভায় আলোচনা হওয়া উচিত। অবশ্য মন্ত্রী হতে হলে অমেরুদন্ডী হতে হয়। পাকিস্তান আমলে কবিতা বা পাঠ সংশোধনের জন্যও আন্দোলন হয়েছে। পাকিস্তান ও কৃষ্টি বইয়ের কারণে শুরু করা আন্দোলন পরে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। বিএনপি-জামায়াতের ইতিহাস বিকৃতির ব্যাপারে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি, ১৪ দলের নেতাকর্মীরা তেমনভাবে রুখে দাঁড়ায়নি। এমন কী আমি শুনেছি, গুজব কিনা জানি না, শেখ হাসিনা দু’একজন দলীয় সদস্যকে বলেছিলেন বিষয়টি তুলতে সংসদে, কেউ রাজি হননি। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পায় যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের কোন অনুরোধ করেও একটি বিবৃতি দেয়া যায়নি। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ হলেও বলি। সে সময় পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে একটি বই লিখেছিলাম। কিন্তু অর্থের অভাবে প্রেস থেকে তা আনা যাচ্ছিল না। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ আমার কাছ থেকে তা জেনে সেই সামান্য অর্থ দিয়ে বইগুলো আনিয়ে বিলি করেছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এলে এই বিকৃতি দূর করার জন্য যে কমিটি হয় তাতে আমিও কাজ করেছি। আর আজ, শেখ হাসিনার আমলে পাঠ্য বইয়ের সাম্প্রদায়িকীকরণ হবে সেটি আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এটিও কি মানা সম্ভব যে, আহমেদ শফির দাবি অনুযায়ী মাদ্রাসার বইতে মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্রের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের এটি কীভাবে করলো? সংবিধানে যেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা মূল উপাদান হিসেবে শেখ হাসিনা এনেছেন সেখানে এটি কীভাবে সম্ভব? আজ রাজনীতির বা রাজনীতিবিদদের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্ত্রিত্ব পাওয়া। আজ যারা কেবিনেটে আছেনÑ তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনু থেকে স্বয়ং শেখ হাসিনা সবাই ছাত্র আন্দোলনের ফল। পাঠ্যবইয়ের হেজাবীকরণের বিরুদ্ধে তারা একটি কথাও বললেন না। আশ্চর্য! নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাত্র জীবনে আমাদের নেতা ছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন কিন্তু তিনিও মনে হয় মন্ত্রিত্ব রক্ষায় হেজাবীদের নির্দেশ মানতে রাজি, নিজের বিবেক অনুযায়ী কাজ করতে রাজি নন। তিনি মুক্তমনা মানুষদের শুধু বিস্মিত করেননি, হতাশ ও দুঃখিত করেছেন। তার কাছ থেকে এটি কেউ আশা করেনি। তিনি শেখ হাসিনার স্নেহধন্য হতে পারেন। যতদিন বেঁচে আছেন মন্ত্রী থাকতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তমনা মানুষের কাছে তিনি বিতর্কিত থাকবেন। তার সারা জীবনের ত্যাগ তিতিক্ষার পরিণতি হলো এই! ১৪ দলের সবাই এখন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। সমস্ত বৃহৎ স্থাপনার নাম তার নামে। তার জন্য কয়েকটি দিবস পালিত হয়। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কি ছিল সাম্প্রদায়িকতা, মূর্খতা, হাঁটু গেড়ে বসা? তার আদর্শেই যদি ১৪ দল বিশ্বাস করে, সরকার বিশ্বাস করে, তাহলে তো এমন হতে পারে না। তাহলে কি তাঁকে বিক্রি করা হচ্ছে? ভোটের রাজনীতিতে সমঝোতা করতে হয়, আপোস করতে হয়, কিন্তু কতটুকু? এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল রাজাকরদের বিরুদ্ধে কথা বলে, নানা আদর্শের কথা বলে। আদর্শের বিষয়টা এখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ, মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে আদর্শ নিয়ে বাঁচলে। রুশ কবি ইভতেশেঙ্কো লিখেছিলেন, আদর্শ হচ্ছে রুটির মতো। মানুষের জীবনের জন্য যা অপরিহার্য। সরকার শক্তিশালী কোন সেক্টরের স্বার্থ রক্ষা করছে না? আজ স্থল, স্থল বাহিনীর, জলে যা আছে নৌবাহিনীর, আকাশের সব বিমান বাহিনীর, এমনকী মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা সবখানে সেনাবাহিনী, সিভিলিয়ান থেকে কেউ সেনাবাহিনীতে যাবার যোগ্য নয়, কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে সবাই সবখানে যাওয়ার যোগ্য। এভাবে যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি হচ্ছে। অথচ জিয়া ও এরশাদের সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে পুরো সিভিল সমাজ যার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোও ছিলÑ সবাই ছিল সোচ্চার। তাদের পতনের অন্যতম কারণই ছিল সামরিকীকরণ। চলবে...
×