ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক

রক্ষক হয়ে ভক্ষক হলে তার আর রক্ষা নেই। জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এমন নীতির বাস্তবায়নের চাইতে শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ আর হতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর এবং সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক আলোচিত সাত খুনের মামলার রায়ে আপাতত এটাই প্রাপ্তি। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের অপূরণীয় ক্ষতি কোন দিন পূরণ হবে না এবং মামলার রায়ের মাধ্যমে তারা কিছুই ফিরে পাবেন না। তবে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষ উপকৃত হবে। জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাদের হাতে অস্ত্র ও আইন দুটোই তুলে দেয়া হয়েছে, তারা হয়ত আগামীতে অর্পিত ক্ষমতা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহারের আগে এই আলোচিত সাত খুনের মামলার রায়ের কথা একবার হলেও মনে করবেন। বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার বাস্তবতায় ২ বছর ৮ মাস ১৯ দিনের মাথায় রায় প্রদান একটি অনন্য উদাহরণ ও আগামী দিনের জন্য মাইলফলক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একবার ভেবে দেখুন, যাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হলো তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন কত ক্ষমতাধর, তাদের হাত কত লম্বা! তাছাড়া ফাঁসির দ-প্রাপ্তদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামি সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সদস্য। এসব সত্ত্বেও এত স্বল্প সময়ে রায় ঘোষণা চাট্টিখানি কথা নয়। তদন্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিচারক সকলেই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এই রায়ের মাধ্যমে যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, যে মাইলফলক সৃষ্টি হলো, এর সুফল পেতে চাইলে মামলার বাকি প্রক্রিয়াগুলো যাতে একই রকম দ্রুততার সঙ্গে শেষ হয় তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রচলিত কথায় আছে শুধু বিচার শেষ করলে হবে না, তা দৃশ্যমান হতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষ খুব একটা ভরসা রাখতে পারে না। আমাদের লিগেসি ভালো নয়। জাতির পিতা, রাষ্ট্রের স্থপতি, যার জন্ম না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, পরিবারসহ তাঁর নির্মম হত্যাকা-ের বিচারসম্পন্ন করা নিয়ে যা ঘটেছে, তারপর কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস রাখা দুষ্কর। সাতটি বছর, ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের শুনানি আপীল বিভাগে হয়নি। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের মুখে এখন গণতন্ত্রের চিৎকার শুনলে মনে হয়, হায়রে! ভজনালয় (রাষ্ট্র) তোমার মিনারে (গণতন্ত্র) চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়। অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের বিচার হয়নি। আর কোন দিন হবে কিনা তা কেউ জানে না। অন্তত সাত খুনের আলোচিত এই রায়টি হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগে যদি স্বল্পতম সময়ে সম্পন্ন ও দ- কার্যকর হয় তাহলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থার পারদ অনেকটাই উপরে উঠবে। আর বর্তমান সরকারের সাফল্য গাথায় নতুন পালক যুক্ত হবে। শেষ হয়েও হলো না শেষ, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো অতৃপ্তিতে ভোগার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রচুর। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সকলের দ- আমরা এখনও কার্যকর করতে পারিনি। অবশ্য আসামিরা বিদেশে পলাতক থাকায় এখানে অন্য রকম সীমাবদ্ধতা কাজ করছে। বর্তমান সরকারের একটানা দুই মেয়াদের এ পর্যন্ত আইন ও সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতির বড় পদক্ষেপ যেমন আছে, তার সঙ্গে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকেও যে সব সময় পার পাওয়া যাবে না, এমন কিছু উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের পূর্বের কোন সরকারের সময় দেখা যায়নি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল এবং দুই সামরিক শাসক ও তাদের সকল কর্মকা-কে অবৈধ ঘোষণা সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিশাল অগ্রযাত্রা। ভেবে দেখুন, যে দেশের প্রধান বিচারপতি অল্পদিনের জন্য হলেও প্রধান সামরিক শাসক হয়েছেন, সেখান থেকে আজ একই আদালত কর্তৃক সামরিক শাসন ও শাসকদের অবৈধ ঘোষণা করা বিশাল অর্জন। দুই সামরিক শাসক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও দেশের যে কত বড় ক্ষতি করেছেন, তা যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত অনেক দেশেই বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকদের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু কোথাও কোন সামরিক শাসক দেশের জন্য ভাল কিছু করেছেন তার নজির নেই। সামরিক শাসকদের কথা উঠলেই আমাদের জেনারেশনের মানুষের মনে পাকিস্তানের কথা মনে পড়ে। জুলফিকার আলী ভুট্টো একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাতে সামরিক বাহিনীর ভয়ার্ত গণহত্যা দেখার পরেও পরের দিন সকালে ঢাকা ত্যাগ করার প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ঞযধহশ এড়ফ চধশরংঃধহ রং ংধাবফ. সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুর আগে সামরিক শাসকদের সম্পর্কে যা বলেছিলেন তার সামান্য একটা উদ্ধৃতি দিই। তিনি তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন, Tin-Pot dictators have ravaged Asia, Latin America and Africa. They have destroyed time honored institutions and treated their People like animals. The dictator is the one animal who needs to be caged. Not a single one of them has made a moment’s Contribution to history.(সূত্র সিয়াম ভাটিয়া- গুডবাই শাহজাদি, পৃ. ৮৩)। নিবন্ধের মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠায় আরেকটি পদক্ষেপ হলো, ২০০৪ সালে জামায়াত-বিএনপি সরকার কর্তৃক পরিচালিত অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং তাতে অর্ধশত মানুষের হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদেরকে বিএনপি সরকার কর্তৃক দায়মুক্তি প্রদান করাকে সম্প্রতি হাইকোর্ট এক আদেশ বলে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন, আইন প্রণয়নে সংসদের হাত সীমাহীন লম্বা নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় বিশাল অগ্রগতি। সরকারদলীয় সিটিং সংসদ সদস্যরা অভিযুক্ত হয়ে জেল খাটছেন, যা এর পূর্বে ভাবাও যায়নি। টাঙ্গাইলের রানা ও কক্সবাজারের বদি এর উদাহরণ। আমার একথা শুনে অনেকে হয়ত বলতে পারেন আরও অনেকে আছেন যারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে একমত হয়ে বলব, ধীরে ভাইয়া, ধীরে! সামরিক শাসক ও ধর্মান্ধ জামায়াতী প্রভাবিত শাসনের মাধ্যমে ল-ভ- হওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বের হওয়া কঠিন কাজ, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি সরকারের এক-দুই মেয়াদে তা সম্ভব হয় না। তবে শুরু হওয়া ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন সব অনাচার থেকে বের হওয়ার প্রত্যাশা অবশ্যই করা যায়। প্রতিবেশী মিয়ানমারের দিকে তাকালে বোঝা যায় দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে আসা গণতান্ত্রিক সরকারের কেমন অসহায় অবস্থা হয়। গণতন্ত্রের নেত্রী, নোবেল পাওয়া আউং সান সুচি বিশ্বের সমস্ত নিন্দা মাথায় নিয়ে ঠায় বোবা হয়ে বসে আছেন, রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে কিছুই বলতে ও করতে পারছেন না। ইন্দোনেশিয়া, নাইরিজিয়া, চিলি, মিসর, ফিলিপিন্স, এরকম সামরিক শাসনের কবলে পড়া দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ তাদের থেকে অনেক এগিয়ে। বাস্তবতা বড় কঠিন। সত্যের সঙ্গে তার লড়াই চিরদিনের। দূরদর্শী নেতারা সত্য ও বাস্তবতার মিশেলের পথে হেঁটে এক সময়ে খাঁটি সত্যে উপনীত হতে পেরেছেন। হঠকারী, একতরফা ও কট্টর পন্থায় কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। সিলেটে শিশু রাজনের নির্মম হত্যায় সৌদি আরবে পলাতক আসামিকে ধরে এনে এক বছরে বিচার সম্পন্ন করে দোষীদের সর্বোচ্চ দ- প্রদান করা গেছে। খুলনায় শিশু রাকিব হত্যার বিচার এক বছরের মধ্যে শেষ হয়েছে। সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজাকে হত্যার চেষ্টায় জড়িত স্থানীয় ছাত্রলীগের বড় নেতা রেহাই পায়নি। মানব জন্মের পর থেকে ভাল-মন্দ অথবা সাফল্য-অসাফল্যের মাপকাঠিতে অ্যাবস্যুলিউট ও একপেশে কোন কিছু ঘটেনি। শুধুই ভাল অথবা শুধুই মন্দ, তা কখনো হয় না। তাই পিছনের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানের পার্থক্যটা বোঝা যায়। ২০০৪ সালে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ছগিরের গুলিতে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সাবিকুন নাহার সনির মৃত্যু এবং ওই সন্ত্রাসী ছগিরের মৃত্যুর পর তার কফিনে বেগম খালেদা জিয়ার পুষ্পস্তবক অর্পণের সঙ্গে তুলনা করলে একটা চিত্র পাওয়া যায়। শুধু তুলনা করার জন্যই এই উদাহরণটা আনতে হলো। বর্তমানে কিছু অগ্রগতির কথা যখন বলছি তখন এর বিপরীতে খুলনায় প্রখ্যাত সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যাকা-ের বিচারের রায় মানুষের কাছে বিচারের নামে প্রহসন মনে হয়েছে। সাংবাদিক সাগর-রুনি এবং কুমিল্লার তনু হত্যার কূল কিনারা এ পর্যন্ত করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য সরকারকে কঠিন ও চরম সমালোচনা সইতে হবে। আর দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অনাগতকাল ধরে এই বোঝা বইতে হবে। অন্যদিকে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মতো একটি মামলায় এত সংখ্যক আসামি ও সাক্ষী, অর্থাৎ মামলার আয়তনের তুলনায় অল্প সময়ে বিচার সম্পন্ন করা এবং এক আদেশে এত বেশি সংখ্যক আসামির মৃত্যুদ- প্রদান বিশ্বে নজির স্থাপন করার মতো ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা উন্মোচনের পর প্রথম দিকে জড়িত অভিযুক্তদের পরিচয় দেখে মানুষের মনে ভয় ছিল এর সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার সময়মতো হবে কিনা? তবে সশস্ত্র বাহিনীর তিনজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে (র‌্যাবে কর্মরত) দ্রুততম সময়ে বরখাস্ত ও আদালতে সমর্পণ মানুষের মনে আশাবাদ সৃষ্টির প্রথম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। তারপর প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে অল্প সময়ে ফিরিয়ে আনায় তাতে মানুষের মনে আরও আশার আলো সৃষ্টি হয়। এই ঘটনা থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নিলে ভাল করবে। নূর হোসেনরা দলের জন্য কখনও এ্যাসেট নয়, বরং এমন বোঝা, যা নামাতে গেলেও ঘাড় ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই নূর হোসেন ছিলেন ট্রাকের হেলপার। শ্রমিক নেতার লেবাসে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজির মাধ্যমে টাকা রোজগার করাই ছিল তার কাজ। এই টাকার জোরেই তিনি জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সব দলের আশ্রয় পেয়েছেন। সে সব সময়ই সরকারী পার্টির লোক ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বরাবরই প্রমাণিত। এবার র‌্যাবের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির পরিচয় পাওয়া গেল। সাজাপ্রাপ্ত ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জন র‌্যাবের সদস্য। আবার ২৬ আসামি ফাঁসির দ-প্রাপ্তদের ভেতরে ১৭ জন র‌্যাবের। এই সংখ্যক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও পুলিশ সদস্যদের একসঙ্গে ফাঁসির আদেশ পূর্বে কখনও হয়নি এবং কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। সুতরাং যে কোন বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিচারের এই রায় জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আগামী দিনের জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ থেকে
×