ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পযুগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আমেরিকা ফাস্ট’ নীতি গ্রহণ

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

ট্রাম্পযুগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আমেরিকা ফাস্ট’    নীতি গ্রহণ

নাজিম মাহমুদ ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পযুগের যাত্রা শুরু হলো। ওয়াশিংটনে বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভের মধ্যে কংগ্রেসের ক্যাপিটল ভবনে শপথ নিলেন তিনি। ডান হাত উপরে তুলে আর বাঁ হাত আব্রাহাম লিঙ্কনের স্মৃতিধন্য বাইবেলে হাত রেখে শপথবাক্য পাঠ করেন ট্রাম্প। প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস তাকে শপথ করান। এ সময় ট্রাম্পের পাশে ছিলেন স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প। সাবেক অনেক প্রেসিডেন্ট ও গণ্যমান্য ব্যক্তি আর হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তিক্ত নির্বাচনী প্রচারের পর জনমতের বিভক্তির মধ্যে শপথ নিয়ে দেশকে ঘরে-বাইরে একটি নতুন ও অনিশ্চিত পথে দাঁড় করালেন ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প। এই রিয়েল এস্টেট টাইকুন ও রিয়েলিটি শোর এক সময়কার তারকা ট্রাম্প মার্কিনীদের ঘরে নিরাপদ রাখা এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান, কমান্ডার ইন চীফ ও সরকারের শীর্ষ নির্বাহী হলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাবিহীন প্রথম প্রেসিডেন্ট। ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ে কঠোর বক্তব্য, রাশিয়ার সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের অভিপ্রায় ও ন্যাটোর সমালোচনা- সব কিছু মিলিয়ে এক নতুন ধরনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে বিশ্ব। হোয়াইট হাউসে তার পদার্পণ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ঘরে-বাইরে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আরও বিচ্ছিন্œ, আরও সুরক্ষিত করা, ‘আমেরিকা ফাস্ট’ নীতি নেয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কারোপের অঙ্গীকার করেছেন। ওভাল অফিসে পা ॥ ১৯ মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়ন লড়াইয়ে নামেন তখন অনেকেই ঠাট্টা করেছিলেন। অনেকে বলেছিলেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ট্রাম্প ব্যবসার মারপ্যাঁচ ভাল বুঝতে পারেন, তবে রাজনীতির অঙ্কে তিনি কাঁচা। কিন্তু সবার অনুমান ভুল প্রমাণ করে গত ৮ নবেম্বরের মার্কিন নির্বাচনে ঝানু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে ঠিকই ধরাশায়ী করেন এই ধনকুবের। এখন তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। মনোনয়ন লড়াইয়ে নামার প্রথম থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন ট্রাম্প। দেশে-বিদেশে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভের মুখে সেই ট্রাম্পই ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ট্রাম্পই প্রথম ৭০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওভাল অফিসে পা রাখলেন। ২০ জানুয়ারি শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল হিলে স্থানীয় সময় দুপুর বারোটায় তাকে শপথ পড়ান দেশটির প্রধান বিচারপ্রতি জন রবার্টস। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বাইবেল হাতে নিয়ে শপথ পাঠ করেন ট্রাম্প। এর আগে বেলা সাড়ে এগারোটায় শপথ নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। ৩৫ শব্দের শপথ বাক্য পাঠের পর ফের যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষ অবস্থানে আনার অঙ্গীকার করেন ট্রাম্প। তার শপথপূর্ব ভাষণে আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে জন এফ কেনেডি যেসব বাগধারা ব্যবহার করেছিলেন তার কিছু অংশ স্থান পায়। খবর এএফপি, বিবিসি, আলজাজিরা ও ওয়াশিংটন পোস্ট অনলাইনের। ট্রাম্পের এই শপথ অনুষ্ঠান সরাসরি অন্তত দশ লাখ লোক প্রত্যক্ষ করেছে। এই শপথ অনুষ্ঠানে বিল ক্লিনটনসহ একাধিক রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ অংশ নেন। পাশাপাশি রূপালি পর্দা ও ক্রীড়াঙ্গনের একঝাঁক তারকারও শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য তার পূর্বসূরি বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছিল অন্তত ১৮ লাখ লোক। এই শপথ অনুষ্ঠানের বাইরে হাজার হাজার ট্রাম্পবিরোধী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায়। অনেকে ট্রাম্পকে মানি না বলে সেøাগান দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর রাসায়নিক ছিটায় পুলিশ। এদিকে শপথ নেয়ার আগের দিন বৃহস্পতিবার সমর্থকদের আশ্বস্ত করে ট্রাম্প বলেন, তার কেবিনেটই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সেরা হতে চলেছে। এমন দক্ষ মানুষদের নিয়ে এর আগে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কেবিনেট তৈরি হয়নি। আর তার ফলে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জিতবে রিপাবলিকানরাই। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগের ভাষণে ট্রাম্প আরও বলেন, এমন কেবিনেট যুক্তরাষ্ট্র এর আগে কখনও দেখেনি। শপথ নেয়ার আগ মুহূর্তে তার সম্মানে আয়োজিত ‘ক্যান্ডেললাইট ডিনার’-এ ট্রাম্প বলেন, যারা আমার ভোট প্রচারের বৈতরণী পার হতে সাহায্য করেছেন, অর্থ যুগিয়েছেন, প্রচার কৌশলের রূপরেখা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেছেন, তাদের কথা আমি ভুলতে পারব না। তাদের সাহায্য ছাড়া আমি এতটা দূর পর্যন্ত আসতে পারতাম না। ওদিকে ট্রাম্পের শপথের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার বাজারের দাম কোথাও বেড়েছে, আবার কোথাও কমেছে। খবরে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শেয়ার বাজারের শেয়ারের দাম বেড়েছে। আর কমেছে এশিয়ার কয়েক দেশের শেয়ারের দাম। ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৃহস্পতিবার থেকেই রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিকে কার্যত দূর্গে পরিণত করে। শপথের আগের রাতেই হাজারও বিক্ষোভকারী নিউইয়র্কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল থেকে বিক্ষোভ শুরু করে ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেয়। শুক্রবার ২৮ হাজার নিরাপত্তাকর্মী ওয়াশিংটনের কেন্দ্রস্থলের তিন বর্গমাইল এলাকাজুড়ে নিরাপত্তার দেয়াল গড়ে তোলে। আরও ছিল কাঁটাতারের বেড়া, রাস্তা ও সড়ক অবরোধের যন্ত্রপাতি এবং বালুভর্তি শতাধিক ট্রাক। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটাল হিলের শপথ অনুষ্ঠান শেষে ট্রাম্প তার সমর্থকদের নিয়ে পেনসিলভানিয়া এভেনিউ ধরে শোভাযাত্রা করে হোয়াইট হাউসে যান। এ সময় রাস্তার দুইপাশে ভিড় করে মানুষ। ট্রাম্পের শপথের পর দিন শনিবার ওয়াশিংটনে অন্তত ২ লাখ নারী জড়ো হয়ে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবে। তারা ট্রাম্পের প্রতি জাতিবিদ্বেষ নিরসন ও লিঙ্গ বৈষম্য অবসানের দাবি জানাবে। প্রায় ৩০টি সংগঠন ওয়াশিংটনে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ দেখানোর অনুমতি পেয়েছে। আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বোস্টন থেকে লস এ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত বিভিন্ন শহরেও বিক্ষোভ হয়। দেশ ছাড়িয়ে ট্রাম্পবিরোধী এ প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাইরেও। লন্ডন, ম্যানিলা ও সিডনির মতো শহরেও শুক্রবার বিক্ষোভ হয়েছে। শপথের আগে নিউইয়র্কে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনীতিবিদ, অধিকার আন্দোলন কর্মী ও খ্যাতিমান শিল্পীরা। এদের মধ্যে আছেন নিউইয়র্ক মেয়র বিল ডি ব্লাসিয়ো ও অভিনেতা এ্যালেক বল্ডউইন। বিল ডি ব্লাসিয়ো বলেন, ট্রাম্প হয়তো ওয়াশিংটন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিন্তু আমেরিকার জনগণই তাদের পথ ঠিক করবে। তিনি বলেন, আমরা ভবিষ্যতকে ভয় করি না। আমরা জানি ভবিষ্যত উজ্জ্বল, যদি মানুষের আওয়াজ আরও শক্তিশালী হয়। শপথের পর দিন থেকেই যেসব কাজ করবে ট্রাম্প প্রশাসন ॥ হোয়াইট হাউসে প্রথম দিনেই অভিবাসননীতি কঠোর করা, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নীতিগুলোর রাশ টেনে ধরার কাজ শুরু করে দেবেন ট্রাম্প। শপথ নেয়ার পর উল্লিখিত বিষয়গুলোতে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ দিন থেকেই হোয়াইট হাউস পর্ব শুরু হবে ট্রাম্পের। ট্রাম্পের সহযোগীরা জানিয়েছেন, ব্যাপক ক্ষমতার প্রেসিডেন্সিয়াল কলমটি ব্যবহার করতে দেরি করবেন না ট্রাম্প, কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই বাস্তবায়ন করা যায় এমন বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন তিনি। ট্রম্পের মুখপাত্র শন স্পিসার বলেন, তারা শুক্রবার পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির সময় এবং আগামী সপ্তাহে ‘তৎপরতা’ আশা করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘শুধু প্রথম দিনেই না, দ্বিতীয় দিনে, তৃতীয় দিনেও সত্যিকার পরিবর্তনের বিষয়গুলো শুরু করার বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার ধারণা আগামী কয়েকদিন এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আপনারা এগুলো দেখতে যাচ্ছেন।’ শনিবার ভার্জিনিয়ার ল্যাঙলিতে সিআইএ সদরদফতর পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ট্রাম্পের। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থা ও এর বিদায়ী প্রধানের কঠোর সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারের সময় রাশিয়া সাইবার হামলা চালিয়েছে, সিআইএ’র এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রথমে প্রশ্ন তোলেন তিনি। পরে আবার অভিযোগটি মেনে নেন। যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গেও তুলনা করেন ট্রাম্প। স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু নীতি, অভিবাসন, জ্বালানি ও অন্যান্য বহু বিষয়ে দুই শ’রও বেশি সম্ভাব্য নির্বাহী আদেশ পুনর্নিরীক্ষা করে ট্রাম্পের বিবেচনার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন তার উপদেষ্টারা। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই, ট্রাম্প টিমের এমন একজন সদস্যের ভাষ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে কতগুলো আদেশ তিনি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন করবেন তা পরিষ্কার নয়। ‘তিনি দেখাতে চান, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, ওয়াশিংটনের প্যাঁচে আটকা পড়ে থাকবেন না বলে জানিয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট বিষয়ক ইতিহাসবিদ জুলিয়ান জেলিজার। তার আগে ওবামাসহ অন্যান্য প্রেসিডেন্টরাও হোয়াইট হাউসে তাদের প্রথম সপ্তাহগুলোতে এই কৌশল কাজে লাগিয়েছিলেন।
×