ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাটির হাঁড়ি

পিঠা বানাতে প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

পিঠা বানাতে  প্রয়োজন

শীত মৌসুমে কুমোর বাড়ির চাকা চলমান থাকে দিনভর। এই মৌসুম পিঠা পুলির। শীতের পরই ফাগুনের হাওয়া টেনে আনে বসন্ত। প্রণয়ের মানব-মানবীদের মিলন মেলার ঋতু। বাড়তি যোগ হয় বাংলার ঐতিহ্যের মেলা। এই মেলা ছুটে চলে বৈশাখী মেলার দিকে। তারপর আরও খানিকটা সময়। এমন টানা মৌসুমে কুমার বাড়িতে ফুরসত থাকে না এক দ-। মাটির হাঁড়ি পাতিল কলসি ঠিলা শিশুদের খেলনা পাতিলসহ নানা কিছু বানানো হয়। বিশেষ করে শীতের পিঠা পুলি বানাতে মাটির হাঁড়ি-পাতিল না হলেই নয়। সিলভারের পাতিলে পিঠা বানানো যায় না। এই জায়গাটিতে সিলভারের তৈজসপত্র বাঙালীর ঐতিহ্যের মৃৎশিল্পের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। কুমাররা অপেক্ষায় থাকে শীত মৌসুমের। পিঠা-পুলির পাতিল বিক্রি বেড়ে যায়। কোন্ মেলার কখন ডাক আসে। বেশিরভাগ কুমার ভর বছর বিক্রির জন্য মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। মেলা বসলে খেলনা হাঁড়ি-পাতিল-পুতুল ও ফুলের টব এবং মাটির তৈরি তৈজসপত্র টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে পসরা সাজায় সেখানে গিয়ে। শীত মৌসুমে পিঠা-পুলির জন্য মাটির হাঁড়ি-পাতিল আজও বেশি বিক্রি হয়। সভ্যতার সূচনা লগ্নের শিল্প মৃৎপাত্র। এই শিল্পই যে সভ্যতা এনেছে তার প্রমাণ মিলছে প্রতœতাত্ত্বিক অধিদফতরের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানের খনন কাজে। সেখানে মিলছে মৃৎপাত্র। এই মৃৎপাত্র যে কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তার প্রমাণ দিচ্ছে বর্তমানের চিকিৎসা বিজ্ঞান। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, মাটির পাতিলে ও খড়ির চুলার উনুনে রান্না করা খাবার যতটা সুস্বাদের হয়, সিলভারের পাতিল, প্রেশার কুকার ওভেনের রান্না ততটা নয়। পিঠা বানাতে দরকার হয় বাষ্পীভূত তাপ নিয়ন্ত্রণের। যে কারণে মাটির পাতিলে চিতই পিঠা বানানোর সময় একধারে ভেঙ্গে ভেন্টিলেশন রাখা হয়। এই পথেই খড়ির চুলার তাপে পিঠার উপকরণ ঢেলে ভাজা হয়। মাটির পাতিল প্রথমে তাপ শোষণ করে নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই তাপকে ধরে রাখতে চুলার খড়ি কখনও পেছনে কখন ভেতরে ঠেলে দিয়ে কখনও খড়ি বাড়িয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই পদ্ধতিকে মনে হবে সেকেলে, তবে পিঠা সুস্বাদের বানাতে এই পদ্ধতির বিকল্প নেই। যিনি পিঠা বানান তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন তাপে পিঠার আকৃতির গঠন থেকে। এক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যার ‘বয়েলস ল ও চার্লস ল’ মেনে চলা হয়। পিঠা বানানেওয়ালী পদার্থবিদ্যার এই দুই ল’ অবচেতনেই নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় প্রয়োগ করে। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কড়াইতে শীতের পিঠা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে সুস্বাদুু করে বানানো যায় সিলভারের পাতিলে তা হয় না। নগর জীবনে (বর্তমানে গ্রামীণ জীবনেও) সিলভারের তৈজসপত্রের সঙ্গে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য যোগ হয়েছে। যেমন ওভেন। বলা হয় ওভেনে কেক বানানো যায়। ইংরেজী কেক অর্থ পিঠা। ওভেনে তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। তারপরও সব পিঠা ওভেনে বানানো যায় না। শীতের কমন পিঠা ভাপা। এই পিঠা সিলভারের পাতিলের পানির বাষ্পে সুস্বাদের হয় না যতটা স্বাদের হয় মাটির পাতিলে বানানো ভাপা পিঠা। কুমার নারায়ণ চন্দ্র পাল বললেন, সেদিন আর নেই, মাটির হাঁড়ি-পাতিলের কদর আর থাকে কোথায়। শীত মৌসুমে পিঠা বানানোর জন্য গাঁও গেরামে তাও অন্তত কিছু হাঁড়ি- পাতিল কলসি টিকে আছে। নগর জীবনে তো উঠেই গেছে। এ্যালুমিনিয়াম সিলভার মেলামাইন প্লাস্টিক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলেছে মাটির জিনিসপত্র। তারপরও শীত মৌসুমে পিঠা বানাতে মাটির পাতিলের কদর বাড়ছে। মেলায় কদর বেড়েছে। যে কারণে কুমাররা আজও টিকে আছে। একটা সময় প্রায় প্রতিটি এলাকায় কুমারদের দেখা মিলেছে। উঠান দেখলেই বোঝা গেছে এটা কুমারবাড়ি। গরুর গাড়ির চাকার মতো দেখতে বিরাট ঘূর্ণিচাকা বসানো হয় মাটি খুঁড়ে প্রায় দুই ফুট নিচে। চাকার মধ্যিখানে থাকে ফরমা। মাটি ভাল করে ছেনে ওই ফর্মার মধ্যে বসিয়ে কয়েক পাক ঘুরিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি হয় মাটির জিনিসপত্র। এরপর শুকানোর পালা। তারপর টেকসই করতে মাটির তৈরি চুল্লিতে পোড়ানো হয় বিশেষভাবে। আগুনে পোড়ানো হয় তার নাম পুইন। এই পুইন সাজানোর প্রক্রিয়াটাও শিল্প। মাটির জিনিস বানানোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই দিতে হয় শিল্পীর নিপূণ হাতের কারুকাজ। এই কারণে কুমার সম্প্রদায় মর্যাদা পেয়েছে শিল্পীর। যে শিল্পীরা আমাদের বানিয়ে দিচ্ছে পিঠা তৈরির মাটির হাঁড়ি-পাতিল। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×