ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অসম প্রতিযোগিতার মুখে মৃৎশিল্প

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

অসম প্রতিযোগিতার  মুখে মৃৎশিল্প

লোক সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত অন্যতম প্রধান শাখা হলো মৃৎশিল্প। কৃষিনির্ভর বাঙালী সমাজ থেকে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি। মৃৎশিল্পের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে সমাজভুক্ত মানুষের প্রয়োজনে। প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা পূরণের জন্যই মৃৎশিল্প বিকাশ লাভ করেছে। মাদারীপুর জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে এ জেলার শত শত মানুষ। এরা কুম্ভকার বা কুমার নামে পরিচিত। পাল বংশের কিছু লোক এ পেশায় নিয়োজিত। কাদামাটি দিয়ে কুমাররা বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির হাঁড়ি-পাতিল-বাসন-কোসনসহ গৃহস্থালি কাজের উপযোগী নানা সামগ্রী তৈরি করে। হাত এবং চাকার সাহায্যে কাদামাটি দিয়ে তৈরির পর কাঁচা থাকতে তাতে কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও রেখাদির নক্সা করা হয়। কখনও আবার পোড়াবার পর এতে নানা রঙের সমাবেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ আকর্ষণীয় নক্সা করা হয়। খেলার পুতুল ও ঘর সাজানোর শৌখিন দ্রব্যও কুমাররা তৈরি করে। পাল বা কুমাররা হিন্দুদের দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে। বাঁশ, খড়কুটো, মাটি, কাপড় ও রং নির্মিত তাদের এ মূর্তি অসাধারণ শিল্পকর্ম। কুমার শ্রেণীর সাধারণ মেয়েরা মৃৎশিল্পের নানা দ্রব্য তৈরিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করে। এতে রয়েছে তাদের সুনিপুণ দক্ষতা এবং কুশলতা। এসব পণ্যের প্রধান উপকরণ মাটি। মাদারীপুর জেলা মৃৎশিল্পের জন্য এক সময় বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে কারখানা থেকে উৎপাদিত দৈনন্দিন গৃহস্থালি সরঞ্জাম বা তৈজসপত্রের সর্বাপেক্ষা ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে মাটির তৈরির তৈজসপত্রের আবেদন কমে গেছে। তবে এখনও গ্রামের মধ্যবিত্ত, নিম্নœবিত্ত শ্রেণীর মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করে। যেমন হাঁড়ি, কলসি, মটকা, ব্যাংক, ফুলদানি, সানকি, বদনা, দইয়ের ভাঁড়, ঘটি, মালসা, পাতিল, ছাইদানি ইত্যাদি। এ থেকেই মাদারীপুরের লোকায়ত মৃৎশিল্পের বিমূর্ত পরিচয় ফুটে ওঠে। বংশ পরম্পরায় পাল সম্প্রদায়ের মানুষ এ শিল্পের কারিগর। মৃৎশিল্পীরা শুধুমাত্র হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে না তারা খেলনা সামগ্রী, ফুলদানি, পটারি তৈরি করে। এসব জিনিসপত্র ছাঁচে তৈরি করা হয়। সাধারণত মেলা উপলক্ষে এসব সামগ্রী বেশি সংখ্যক তৈরি হয়। এছাড়া মৃৎশিল্পীরা মাটি দিয়ে পশুপাখি তৈরি করে। মাটির তৈরি ব্যাংক আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রচলিত। মাটির তৈরি সামগ্রীতে সাধারণত নক্সা করা হয় কাঁচা অবস্থায়। এরা বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃদ্ধ, ছেলেমেয়ে সকলেই মৃৎশিল্পের কাজ জানে। মৃৎশিল্পীরা মাটির দ্রব্য উৎপাদনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ‘চাক্’। কুমার সম্প্রদায়ের রুজি-রোজগারের প্রধান উৎস ‘চাক’। এই চাককে কেন্দ্র করে কুমার সম্প্রদায় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। বৈশাখ মাসে এ অঞ্চলের কুমাররা চাকের কাজ করে না। এ মাসের প্রথম দিনই চাক্ পূজা করা হয়। এই একটি মাস চাকের ওপর শিবের মূর্তি বসিয়ে রাখা হয়। পূজার জন্য তারা ডালসহ আমপাতা, সিঁদুর ইত্যাদি ব্যবহার করে। কুমাররা এই এক মাস চাকের কাজ না করলেও মাটি সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং হাত দিয়ে তৈরি মৃৎশিল্পের কাজ করে। তারা শীত মৌসুমেও এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে। এ কাজের সঙ্গে নারীরাই প্রধানত বেশি জড়িত। মৃৎশিল্পীরা রঙের ক্ষেত্রে প্রকৃতির রং ব্যবহার করে। যেমন চকের গুঁড়া, তেঁতুল বিচি, ইটের গুঁড়া ইত্যাদি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজারের কৃত্রিম রংও ব্যবহার হয়। দৈনন্দিন জীবনে মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র হিসেবে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা আছে। যেমন ফুলদানি, ছবির স্ট্যান্ড, ওয়ালম্যাট, গহনা, শো-পিস ইত্যাদি। মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় কুমারদের মধ্যে অনেকেই এখন রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, গার্মেন্টস শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বর্তমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে যারা মাটির শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে কাঠামো অনুযায়ী ছঁাঁচ ব্যবহার করছে তাদের পরিবারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। অতীতে কুমার সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল কম। তারা প্রায় সকলেই নিরক্ষর ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পেশার পরিবর্তন করছে। পাল সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার পাশাপাশি বাড়িতে মা বাবার সঙ্গে মাটির কাজ করে। মাদারীপুর জেলার কয়েক মৃৎশিল্পী তাদের বৈশিষ্ট্য এবং মানসম্পন্ন শিল্পকর্মের জন্য এতদাঞ্চলে বিখ্যাত। এরা হলেনÑ ঘটুপাল, কালিদাস পাল, পাগলা পাল, জগদীশ পাল, অতুল পাল প্রমুখ। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×