ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীতে বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

রাজশাহীতে বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহী নগরীতে ৫ বছর আগেও বহুতল ভবন ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। কয়েক বছরের ব্যবধানে সমানে বেড়েছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। এখন বিভাগীয় এ শহরে বহুতল ভবন দাঁড়িয়েছে কয়েক শ’র বেশি। এর মধ্যে ১০ তলা ও এর অধিক তলা ভবনের সংখ্যা অর্ধশতের বেশি। নগরায়নের ফলে হু হু করে বহুতল ভবনের সংখ্যা বাড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। অভিযোগ রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অসাধু কর্মকর্তারা বহুতল ভবনের অপরিকল্পিত নকশা অনুমোদন দিচ্ছেন। বিল্ডিং কোড না মেনেই একের পর এক ভবন গড়ে তুলছেন মালিকরা। ফলে ভবন নির্মাণের কারণে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। আরডিএ কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী নগরীতে ২০০৯ সাল থেকে বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর আগে কেবল ১০ তলা ভবন বলতে ছিল নগরীর সিএ্যান্ডবি মোড় এলাকায় জীবন বীমা কর্পোরেশনের ভবনটি। কিন্তু এই কয়েক বছরের ব্যবধানে ১০ তলা ভবনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০টির বেশি। নগর ভবন থেকে শুরু করে আশপাশের আরও চারটি এবং সাহেববাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে ১০টি, আলুপট্টির মোড়, লক্ষ্মীপুর মোড়, সাগরপাড়া, উপশহর, বর্ণালীর মোড়, আমবাগান, তেরোখাদিয়া, সিপাইপাড়া, কাজীহাটা ও পদ্মা আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে এসব ভবন। আর ১০ তলার নিচে এবং পাঁচ তলার উর্ধে ভবনের সংখ্যা এখন কয়েক শ’। আরডিএ সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৩ সালে রাজশাহী নগরীতে মোট ৬০০টি ভবনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত ৫৬৫টি এবং ছয়ের অধিক তলা ভবনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৩৫টি। ২০১৪ সালে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৫০২টি। এর মধ্যে ৪৮৬টি এক থেকে পাঁচতলা এবং ছয়ের অধিক তলাবিশিষ্ট ভবন অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৩৫টি। ২০১৫ সাল থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫৪টি ভবনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৬টি এক থেকে পাঁচতলা এবং ছয়ের অধিক তলার ভবন অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৩৩টি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর প্রতিটি ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য আরডিএর এক অথরাইজড অফিসার থেকে শুরু করে নগর পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দফতরে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। আর টাকা দিলেই জমির শ্রেণী পরিবর্তন করেও মেলে নকশার অনুমোদন। আবার মাস্টারপ্ল্যান লঙ্ঘন করেও কখনও কখনও দেয়া হয় ভবনের অনুমোদন। পরে সেখানে বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে গুনতে হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোটি কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর গৌরহাঙ্গা-সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০১ সালে। এই সড়ক প্রকল্পটি ২০০৫ সালের জুনে অনুমোদিত নগরীর মাস্টারপ্ল্যানেও উল্লেখ করা হয়েছিল। ফলে সড়কপথে নতুন করে কোন আবাসিক ও বাণিজ্যিক ইমারত নির্মাণের নকশা অনুমোদনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু আরডিএর অথরাইজড অফিসার সেখানেও ভবন নির্মাণের জন্য ২০০৫ সালের ২২ ডিসেম্বর ছয়তলার একটি নকশা অনুমোদন করে দেন। পরে আরও পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। রাস্তাটির প্রশস্তকরণ কাজ করতে গিয়ে ২০০৯ সালে ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। তবে ভবন ভাঙ্গতে গিয়ে অতিরিক্ত চার কোটি তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় মালিককে। আবার ইমারত নির্মাণের ক্ষতিপূরণ বাবদ তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা গুনতে হয়। জানা যায়, নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় আটতলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) থেকে নকশা অনুমোদন নেন জমির মালিক সাজ্জাদ হোসেন। ২০১২ সালে এ নকশা অনুমোদন করা হয়। এতে শর্ত ছিল ভবনের সামনে এক দশমিক ৫০ মিটার এবং পেছনে ও উভয়পাশে এক মিটার করে জায়গা ছেড়ে নির্মাণ কাজ করতে হবে। তবে ভবন মালিক সাজ্জাদ হোসেন ভবনের সামনে এক মিটার জায়গাও ছাড়েননি। আরডিএর নিদের্শনাকে উপেক্ষা করে অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে একেবারে ফুটপাথ ঘেঁষে একে একে আট তলার স্থানে তিনি ১১ তলা অট্টালিকা গড়ে তোলেন। ২০১৩ সালের ২৩ জুনের মধ্যে অবৈধ নির্মাণকৃত অংশটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে ফেলার জন্য নির্দেশ দেয় আরডিএ। কিন্তু অদ্যাবধি এই অবৈধ অংশটি ভেঙ্গে ফেলা হয়নি। মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের কারণেই ভবনটি পরে বৈধ করা হয় বলেও নিশ্চিত করেছে আরডিএর একাধিক সূত্র। একই কায়দায় নগরীর শত শত ভবন মালিকের কাছ থেকে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে একের পর এক ভবনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নগরীর দরিখোরবনা এলাকার একজন অভিযোগ করেন, তার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাতায়াতের জায়গা না থাকায় সাত তলা ভবনের নকশা অনুমোদনে বাদ সাধেন আরডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা। পরে অর্থের বিনিময়ে নকশাটির অনুমোদন করে নেন তিনি। তবে ওই অর্থের পরিমাণ জানাতে চাননি ভবন মালিক। সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির পাশ দিয়ে কোনমতে রিকশা চলাচল করতে পারে। অথচ আট ফিটের নিচের রাস্তার পাশে তিনতলার ওপর ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়ার কথা নয় আরডিএর। কিন্তু এই নিয়ম লঙ্ঘন করে নগরীতে অন্তত শতাধিক ভবনের অনুমোদন দিয়েছেন আরডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। গাড়ির পার্কিং, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না রেখেই গড়ে তোলা হচ্ছে নগরজুড়ে একের পর এক বহুতল ভবন। এসব বিষয়ে আরডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নিয়মের মধ্য থেকেই ভবনের নকশার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কোথাও কোন অনিয়ম করা হচ্ছে না। তবে ভবন মালিকরা পরে ভবন করতে গিয়ে হয়ত কোন কোন ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। আরডিএ সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মামলাসহ নোটিস করছে। আরডিএর চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ বজলুর রশিদ জানান, সময় এবং প্রয়োজনের কারণে মানুষ বহতল ভবন নির্মাণ করছেন। এটি নগরায়নের একটি অংশ। তবে বিল্ডিং কোড না মেনে কিংবা নকশা অনুমোদনে ‘কার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেলে সেটি তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×