ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

(বৃহস্পতিবারের সম্পাদকীয় পাতার পর) “মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। যা ‘মুজিবনগর’ সরকার নামে পরিচিত। ... এ সরকারের অন্যতম সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী) ও এএইচএম কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী)।” প্রথম সরকারের সরকারী নাম বাংলাদেশ সরকার। তবে বলা হতো প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার। ব্যাখ্যাটি এভাবে দিলে ভাল হতো। ওই সরকারের অন্যতম সদস্য ছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। এর উল্লেখ না থাকা এক ধরনের বিকৃতি। তার নাম দিয়ে বলা যেত, পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন ও জাতির পিতার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাহলে মোশতাকের আসল পরিচয় সবাই জানত। এখন যদি বলা হয় যে, মোশতাক ১৯৭১ সালে সরকার পরিচালনায় ছিলেন না তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? খুব সম্ভব খোন্দকার মোশতাকের নাম বললে সরকার যদি ক্ষুব্ধ হয়, এ কারণেই তা উল্লেখ করা হয়নি। ঐতিহাসিক এভাবে ইতিহাস রচনা করতে পারেন না। মোঃ শাহনওয়াজ খান চন্দন একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন দেখে শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বৈঠক করে এবং কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, ভারতীয় পাঠক্রমে বাংলাদেশের কবিদের কখনও অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।’ (ডেইলি স্টার, ১৩.১.১৭)। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, তাহলে আমরা কেন ভারতীয়দের রচনা আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করব? তাহলে প্রশ্ন দুই ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের কবিতা যথাক্রমে কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও রণসঙ্গীত? চন্দন লিখেছেন, ‘নবম ও দশম শ্রেণীর অঙ্ক বইয়ে কমপক্ষে ৭৬টি বানান ভুল আছে।’ [ঐ] ॥ তিন ॥ এবার মাধ্যমিক পর্যায়ের কথা আলোচনা করা যাক। শরিফুজ্জামানের একটি তদন্তভিত্তিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ১৫ জানুয়ারির প্রথম আলোয়। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর দুটি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর দেখা যায় হেফাজতে ইসলাম যে ২৯টি বদল বা দাবির কথা বলেছিল তার মধ্যে ভুলক্রমে দুটি দাবি মানা হয়নি। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘রামায়ণ-কাহিনী’ ও শরৎচন্দ্রের লালু। এদিকে ১৫ লাখ বই ছাপা হয়ে গেছে যার মূল্য চার কোটি টাকা। হেফাজতের দাবি মানার জন্য এই বইগুলো করা হয়েছে। বা বলা যেতে পারে হেফাজতের দাবি যাতে নিখুঁতভাবে মানা হয় সে কারণে এ কাজটি করা হয়েছে প্রতিবেদন অনুযায়ী- “হেফাজতের ২১জন কেন্দ্রীয় নেতার যৌথ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বর্তমানে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের পাঠ দেয়া হয়ে থাকে। তাদের পড়ানো হয় গরুকে মায়ের সম্মান দিয়ে ভক্তি করার, পাঁঠাবলির নিয়মকানুন, হিন্দু বীরদের কাহিনী, দেব-দেবীর নামে প্রার্থনা এবং হিন্দুদের তীর্থস্থান ভ্রমণ করার বিষয়।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে ১৭টি লেখা বাদ পড়েছে। ওই ১৭টি লেখা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করার দাবি জানায় হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে নতুন করে যুক্ত ১২টি লেখা বাদ দিতে বলে তারা। এই ১২টি লেখা ২০১৩ সালে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছিল। এনসিটিবির সূত্র জানায়, এই ২৯টি লেখার বিষয়ে হেফাজতের বক্তব্য মেনে নেয়া হয়েছে। কিন্তু দুটি লেখা ‘লালু’ ও ‘রামায়ণ-কাহিনী’ ভুলক্রমে বাদ দেয়া হয়নি। এই ভুল যখন ধরা পড়ে, তখন বইয়ের একটি বড় অংশ ছাপা হয়ে যায়। বাকিগুলো ছাপা বা বাঁধাই পর্যায়ে ছিল।” [ঐ] এ পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতের আমির জনাব মোহাম্মদ শফি বলেছেন, সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়ায় ‘প্রশংসনীয় এবং ইতিবাচক।’ এ কারণে ‘ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর গায়ে জ্বালা ধরেছে’। তিনি আরও বলেন- ‘দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও প্রতিবাদের ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টির গুরুত্ব ও নাজুকতা বুঝতে পেরে সিলেবাসে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৬ সালে ৮ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম স্কুল পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে দেশের স্কুল কলেজগুলোতে মুসলমানের সন্তানদের নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়ে পড়ানোর অভিযোগ তোলে। ২০১২ সাল পর্যন্ত চলে আসা সিলেবাস পাল্টে ২০১৩ সাল থেকে স্কুল পাঠ্যবইয়ে এমন ১৭টি রচনা বাদ দেয়া হয়েছে, যেগুলো নৈতিকতা ও আদর্শিকভাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে কয়েক যুগ ধরে। তার পরিবর্তে এমন ১২টি নতুন রচনা সংযোজন করা হয়েছে, যেগুলো তাত্ত্বিকভাবে সরাসরি হিন্দুত্ব ও নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে যুক্ত।’ [মানবকণ্ঠ, ১৫.১.১৭] আমি জানি না, শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে কী বক্তব্য দেবেন। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যে কী বিপদে ফেলেছেন সবাইকে তা আর বলার নয়। সামাজিক মাধ্যম বা ফেসবুক যদি না থাকত তাহলে এ বিষয়গুলো এড়ানো যেত। স্বদেশ রায় দৈনিক জনকণ্ঠে লিখেছেন, প্রিন্ট মিডিয়া এখন হেরে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে তা একেবারে মিথ্যা নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও মিথ্যাচার হয় তার কারণে দাঙ্গা ফ্যাসাদও হচ্ছে। কিন্তু পাঠ্যবই সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে মিথ্যা নয়। এবং এ কারণেই সাধারণ মানুষ জানতে চায় এই বিষয়টি কী? ফলে মন্ত্রীকেও প্রেস ব্রিফিং করতে হয়, সচিবরাও নানা কথা বললেন। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দায়বদ্ধতার ব্যাপার চলে আসছে। গণতন্ত্র বিকাশেও প্রযুক্তি ভূমিকা রাখছে। এ কারণে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ, বারংবার তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজ/রাষ্ট্র তিনি চান। প্রাথমিক শিক্ষার বইয়ের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। দায়বদ্ধতার কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। যদিও তিনি ভাল করে জানেন যে, সে ক্ষমতা তার নেই। কারণ, যারা এ কাজটি করেছেন [এবং মাধ্যমিকের] তারা জাশিপাবোর কর্মকর্তা। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্রাথমিক শিক্ষার অতিরিক্ত সচিব মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন- ‘এনসিটিবি যে পরিমাণ বই ছাপে তার প্রায় অর্ধেকই প্রাথমিকের। কিন্তু এনসিটিবিতে আমাদের বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কেউ নেই।’ তিনি বলেন, ‘এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার ২৪টি পদের মধ্যে ২০টিই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দখলে। আমাদের যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতার কারণে তারা সেখানে স্থান পান না। এ অবস্থায় ভুলের দায়ভার আমরা কেন নেব? তবে বইয়ের যেসব ভুল ধরা পড়েছে আমরা তাতে বিব্রত।’ [সমকাল, ১২.১.১৭] শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেরি করে পা-ুলিপি দেয়াতে ভুল হয়েছে। তাই বলে এত ভুল! শিক্ষার মান নিয়ে কথা বললে সরকারে সবাই ক্ষুব্ধ হন। এখন যদি বলা হয়, পা-ুলিপি দেরিতে জমা দিলেও এত ভুল থাকবে কেন? মূল প্রশ্ন বানান ভুল থেকেও হচ্ছে, হেফাজতের ২৯টি দাবি। এ দাবি হুবহু মানা কি ভুল ছিল? ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে গেল না। জাশিপাবো যে একটি সিন্ডিকেটের ঘাঁটি এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়া মোটামুটি সবাই জানেন। যাদের রাজনৈতিক খুঁটি আছে এবং ঢাকায় থাকতে হবে তারাই এখানে আছেন। এখানে যারা আছেন তাদের অধিকাংশ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের। এই ক্যাডারের সবাই বদলি হন। জাশিপাবোর কেউ হন না। কবে কোন কলেজে তারা ছিলেন তাও নিজেরা ভুলে গেছেন। ‘দৈনিক সমকাল’ ছাড়া ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ ও এই সিন্ডিকেটের কথা বারবার উল্লেখ করছে। সমকাল লিখেছে- ‘সাতজনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট এনসিটিবি তো : একাধিক সূত্র জানায়, এনসিটিবিতে শক্ত একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। সাতজনের এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করছে এনসিটিবিকে। দুর্নীতির শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে তারা। ফলে এনসিটিবির সকলের মূল নজর পাঠ্যবই মুদ্রণের টেন্ডার, কাগজ ক্রয় আর বাণিজ্যিক খাতগুলোর দিকে। শিক্ষাক্রমের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে। কাজের কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদে অনেক কর্মকর্তা বছরের পর বছর এখানেই নিযুক্ত রয়েছেন। শুধু ঢাকায় থাকতে চান বলে এনসিটিবিতে ওএসডি বা প্রেষণে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তা ডজনখানেক তাদের কোন কাজ নেই, অথচ তারা পদ দখল করে রাখায় কাজে দক্ষ কর্মকর্তাদের এখানে পদায়ন হচ্ছে না। এবার বইয়ের ভুলের দায়ে প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ সরকার ও উর্ধতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে ওএসডি ও আটিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলেও অধ্যাপক প্রীতিশ সরকার ও লানা হুমায়রা এখানে নিযুক্ত রয়েছেন। এমন আরও ডজনখানেক কর্মকর্তা আছেন, যাদের কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও বহাল তবিয়তে ঢাকায় পোস্টিং পেয়েছেন।’ [সমকাল, ১৬.১.১৭] সমকাল আরও জানিয়েছে দুর্নীতির দায়ে প্রীতিশের বিরুদ্ধে আগে অভিযোগ করেছেন এক এমপি। যার তদন্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে, তাকে ওএসডি করা হয়েছিল। জনকণ্ঠের মতে- ‘পাঠ্যপুস্তুক বোর্ডে আরও অন্তত ১৫ কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বোর্ডের সচিব থেকে গবেষণা কর্মকর্তা পর্যন্ত অনেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের বিরুদ্ধেই শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রগতিশীল শিক্ষকরা।’ এদিকে এনসিটিবির বড় কর্মকর্তাদের পার পেয়ে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে জানা গেছে, ‘পাঠ্যপুস্তকের কারিকুলাম (পাঠ্যক্রম) ওলটপালোট ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মীয় বিষয়বস্তু ছাপতে বাধ্য করেছেন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিব। তাদের একজন একটি পর্যটন জেলার ডিসি ছিলেন এবং আরেকজনের গ্রামের বাড়ি সিলেট। এই দুই কর্মকর্তাই পাঠ্যক্রম তৈরি থেকে বই মুদ্রণ পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন।’ [ঐ] এতক্ষণ সচিব, মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বাদানুবাদের বিবরণ দেয়া হলো। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বানান বা বাক্য ভুলের জন্য দায়ী পরিমার্জনা যারা করেছেন এবং যেসব কর্মকর্তা এগুলোর প্রিন্ট অর্ডার দিয়েছেন তারা। যারা এগুলোর সঙ্গে যুক্ত, ব্যবস্থা নিলে তাদের বিরুদ্ধেই নিতে হয়। কোন মন্ত্রণালয় তা পারবে না বা করবেও না। এর অন্য অনেক কারণ থাকতে পারে। দুটি কারণ হতে পারে এক. উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। কিন্তু সে নির্দেশ দেয়া হতে পারে হেফাজতের দাবি মানার। বানান ভুলের নির্দেশ নিশ্চয় মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়নি। পাঠ্যবইয়ে বানান ভুলের এত ছড়াছড়ি শিক্ষার মান তুলে ধরে। অর্থাৎ গত দু’দশকে এর ক্রমাবনতি হচ্ছে। কারণ যারা আছে জাশিপাবোতে তারা গত কুড়ি বছরের মধ্যেই হয়ত পাস করেছেন। দুই. হেজাবি পক্ষের লোকজনের এই সংস্থায় নিয়োগ। এই নিয়োগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া। জনকণ্ঠ এই অভিযোগ তুলেছে যে ওই সংস্থায় শিবিরাশ্রয়ী অনেকে আছেন অর্থাৎ হেজাবিরা। এই বিষয়ে দৈনিক ভোরের কাগজ প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। কোন এক শ্রেণীর ইংরেজী বইয়ের একটি চরিত্রের নাম ছিল উত্তম। হেজাবিদের দাবিতে তা করা হয় অলিউল। সূত্রমতে, এর কারণ জানতে চাইলেÑ ‘উত্তম’ হিন্দু শব্দ হওয়ায় বাদ দিতে হবে। এরপরে উত্তম নামটি রাখার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে কথা বললেন রতন সিদ্দিকী। একপর্যায়ে তা মানেনও ইসলামী নেতারা। কিন্তু ওই সময় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকীকে বলে ওঠেন, ‘স্যার হুজুরদের বক্তব্য ঠিক আছে। হুজুরদের বক্তব্য অনুযায়ীই পাঠ্যবই রচনা হওয়া উচিত।’ রতন সিদ্দিকী ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, এনসিটিবির কর্মকর্তার ওই কথা বলার পর হুজুরদের আর কোন যুক্তি দিয়ে আটকানো যায়নি। পরে হেফাজতে ইসলামও তালিকা দেয়। একপর্যায়ে হুজুরদের কথা অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনকে তিনি ১৯৬৯ সালে পাঠ্যবই পরিবর্তনের ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, ৪৮ বছর আগে যা হয়েছিল, এত বছর পরে এসে ২০১৭ সালে তা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতার জন্য যতটা না হেফাজত কিংবা অন্যরা দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা। যারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হলেও মননে হেফাজতপন্থী। [ভোরের কাগজ, ১৯.১.১৭] একইভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে’Ñ কবিতা/গানটিতে ‘মন্দির’ শব্দ থাকায় গত বছর তা বাদ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী প্রভুদের নির্দেশনায় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সেই বিখ্যাত কবিতাÑ ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে’ রূপান্তরিত হয়েছিল এভাবেÑ ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/সারাদিন আমি যেন ইমান মেনে চলি।’ সেই সময় এ নিয়ে প্রবল আন্দোলন হয়েছিল এবং আজকে ১৪ দলের নেতৃত্বে ও মন্ত্রিসভায় যারা আছেন তারা অনেকেই সেই আন্দোলনে ছিলেন। হেজাবিদের বি টিম হওয়ার জন্য বিবেক বলি দিতে হবেÑ এ যদি হেজাবি ভোটের আশায় নতুন যুক্তি হয় তাহলে সমষ্টিগতভাবে তাদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। আমি আগেই বলেছি, ভুল থাকতে পারে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে হেফাজতের দাবি কেন মানা হবে? হেফাজত কি বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষ? তাই যদি হয় তাহলে জনাব নাহিদ ও জনাব ফিজারকে বাদ দিয়ে জনাব শফিকেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে চলে। আর হেফাজতের দাবি মানা হলে আমাদের দাবি কেন মানা হবে না তার ব্যাখ্যাও চাই। এখন ক্ষমতার জোরে ব্যাখ্যা না দিতে পারেন, কিন্তু এক সময় তা দিতেই হবে। পত্রিকা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বানান ভুল ও ভুল বাক্য গঠন এবং পরিবর্তনকে। পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু তা হেফাজতের কারণে হবে কেন? মন্ত্রণালয় কিন্তু এ মূল বিষয়ে নীরব। যদি মন্ত্রণালয় স্বীকার করে হেফাজতের দাবিতে এ পরিবর্তন হয়নি, তাহলে যে দুটি কমিটির সদস্যরা এ ধরনের পরিবর্তন আনতে বলেছিলেন তাদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। কিন্তু, এই দুই কমিটির সদস্যরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া এ কাজ করেছেন তা বলা কতটা যুক্তিযুক্ত জানি না। আর নির্দেশ পেলেও তারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ ধরনের নোংরা কাজ কেন করবেন? আমরা জানি তাদের কিছু হবে না। কিন্তু যারা একটি জেনারেশনকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলজঙ্গীবাদের পক্ষে নিয়ে যেতে চাইছেন তাদের নাম সবার জানা উচিত। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদন অনুযায়ী- ‘মূলত এনসিটিবিতে প্রাথমিক মন্ত্রণালয় তাদের কাজ করুক সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় চায়নি। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল পাঠ্যক্রম তৈরির পেছনে কাজ করেছে দুই মন্ত্রণালয় কমিটি। কোন্ লেখা বাদ দেয়া হবে- তার অনুমোদন দিয়েছিল দুই মন্ত্রণালয়ের দুটি কমিটি। একটি কমিটি গত ১৬ সেপ্টেম্বর এক সভায় অনুমোদন দেয় কোন্ বইয়ে কোন্ কবিতা লেখা থাকবে? কোনটা বাদ যাবে। সে অনুসারেই ছাপা হয় বই। জানা গেছে, প্রাথমিকের কমিটিতে আছেন সচিব। আছেন ড. আবু হেনা মোঃ মোস্তফা কামাল (অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর), প্রফেসর মোঃ এলিয়াছ হোসেন (পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর), প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র পাল (চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড), মোঃ ফাইজুল কবীর (যুগ্ম-সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়), মোঃ আবদুল ওয়াহাব, (উপ-পরিচালক), জাতীয় শিক্ষা একাডেমি), একেএম ছায়েফ উল্যা (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড), প্রফেসর মোঃ আবদুল মান্নান (সদস্য, এনসিটিবি), সরদার মোঃ কেরামত আলী (উপ-সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়), মুহম্মদ আবদুল জাব্বার (পরিচালক (অব), নায়েম), সেলিনা হোসেন (সভাপতি, শিশু একাডেমি), প্রফেসর কফিল উদ্দিন আহাম্মদ (সাবেক চেয়ারম্যান, এনসিটিবি), ড. আলী আসগর (ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়), প্রফেসর ড. এমএ মান্নান (উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়), লানা হুমায়রা খান (উর্ধতন বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি), খ. মোঃ মঞ্জুরুল আলম (বিশেষজ্ঞ এনসিটিবি), মোঃ মোস্তাফা সাইফুল আলম (বিশেষজ্ঞ এনসিটিবি), মুর্শীদ আকতার (গবেষণা কর্মকর্তা, এনসিটিবি), বাবুল আকতার (সংযুক্ত কর্মকর্তা, এনসিটিবি)। চলবে...
×