ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহিদ নবি

কৃতকর্মের পরিণাম সম্পর্কে সাবধান হতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

কৃতকর্মের পরিণাম সম্পর্কে সাবধান হতে হবে

মাইকেল সিমর তার ‘রি থিংকিং ন্যাশনালিজম’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে জাতির সংখ্যালঘিষ্ঠের সমন্বয় সাধন হচ্ছে আধুনিক জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য।’ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্পর্ক তলিয়ে দেখবার সময় এসে গেছে। জাতীয়তা সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারাটা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। ইদানীং সংখ্যালঘিষ্ঠের ওপর হামলা বেড়ে গেছে উদ্বেগজনকভাবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন যে, ১৯৭১ সালের পর এত ব্যাপক আক্রমণ সংখ্যালঘুদের ওপর হয়নি। পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে ১০টি মন্দির তছনছ করা হয়েছে। অসংখ্য হিন্দু বাড়ি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অনেকেই দুঃখের সঙ্গে বলছেন যে ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এটা ঘটল।’ আক্রমণ শুধু স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটেনি, ঘটেছে বিদেশী নাগরিকদের ওপরও। যারা বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এসেছিলেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আমাদের বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশ এখন আর সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর নয়। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশও নয়। আমাদের ঋণ দরকার হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্যও দরকার হয়। এতে আশ্চর্য হবার বা লজ্জা পাবার কিছু নেই। ধনী দেশগুলোও সব সময় বড় বড় কাজের জন্য অন্য দেশের কাছে সাহায্য নেয়। সব দেশে সব ধরনের বিশেষজ্ঞ যথেষ্ট সংখ্যায় থাকে না। বিদেশী বিশেষজ্ঞ তাই প্রয়োজন হয়। এগুলো বাস্তবতা যা অস্বীকার করলে আমাদের ক্ষতি হবে। এমন অবস্থায় বিদেশী হত্যা করলে তার পরিণাম আমাদের জন্য ভাল হবে না। কোন দেশে রাজনৈতিক কারণে বা ধর্মীয় অজুহাতে বিদেশী হত্যা করা হয়েছে বা নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের হত্যা করা হয়েছে এমন খবর বিদেশী পত্রপত্রিকায় বেরোলে সে দেশের পক্ষে বিদেশী সাহায্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এতে করে সেদেশের ভীষণ ক্ষতি হবে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশে কাজ করেন। বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড চলছে এমন খবর বিদেশী পত্রপত্রিকায় বেরোলে প্রবাসীদের ক্ষতি হবে। এতে করে দেশের আর্থিক ক্ষতি হবে। পত্রিকায় বেরিয়েছে যে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। শুধু তাই নয়, খবর বেরিয়েছে যে দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে পুলিশও নাকি সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ভাল খবর এটাই যে ‘ডজন’ ‘ডজন’ দুষ্কৃতকারীর নাকি কোন কোন জায়গায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের এই অত্যাচার আর বিদেশীদের হত্যা যারা করছে তারা কেন এমন সব কাজ করছে? তারা বলতে চায় যে এদের ওপর অত্যাচার করলে এরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে। দেশ ‘কাফেরমুক্ত’ হবে। এখন সবাই বুঝতে পারছে আসল উদ্দেশ্য সেটা নয়। যারা বাংলাদেশকে শতভাগ মুসলিম রাষ্ট্র করবে বলছে, তাদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবনে বা পারিবারিক জীবনে ইসলামের নাম গন্ধ দেখা যায় না। আসল উদ্দেশ্যটা এদের ইহলৌকিক। এরা হিন্দুদের বাড়ি দখল করতে চায়। এরা হিন্দুদের জমি দখল করতে চায়। এই জাতীয় মানুষরা এর মধ্যেই সংখ্যালঘুদের জমি, বাড়ি ইত্যাদি দখল করে বসে আছে। এরা মনে করে হিন্দুদের ভোট তাদের বিপক্ষে চলে যায় এরা হিন্দুদের তাড়াতে চায়। কারণ, তারা মনে করে যে হিন্দুরা না থাকলে তাদের বিপক্ষে যাবে না। কাজেই এতে করে তারা রাজনৈতিকভাবে লাভ হবে। আবার নিজেদেরও লাভ হবে। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে ভারত ও হিন্দুবিরোধী কথা দল হিসেবে বলা হচ্ছে, আবার একই সঙ্গে জমি দখল করছে কিছু নেতা। বড় দুর্ভোগ হচ্ছে এর সঙ্গে কিছু সরকার দলীয় মানুষও জড়িত। ॥ দুই ॥ কয়েকদিন আগে বিলাতের রেডিও ফোর এর ‘ক্রসিং কন্টিনেট প্রোগ্রামে ‘ইন্ডিয়া’জ সিকরেট টেরর’ নামে একটি প্রোগ্রাম প্রচারিত হয়। বিবিসির একজন মহিলা সাংবাদিক প্রোগ্রামটি প্রচার করেন। তার মতে বর্তমান ডানপন্থী সরকার আড়াই বছর আগে ক্ষমতায় আসবার পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনৈতিক অঙ্গ এর জন্য দায়ী। জেএসএস গরুর চোরাচালান বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গরু তাদের কাছে মায়ের মতো পবিত্র। সেই গরুকে মুসলমানরা জবাই করে খাবে এটা তারা হতে দেবে না। ট্রাকে করে গরুর চোরাচালান করে মুসলমানরা। সাংবাদিক জেএসএস কর্মীর ছোট গাড়িতে আরোহী হয়েছিলেন। জেএসএস কর্মী গরুবোঝাই একটি ট্রাককে ধরবার চেষ্টা করছিল। সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, এসবতো পুলিশের কাজ। তাহলে জেএসএস কর্মীরা কেন এসব কাজ করছে? পুলিশও বলে তাদের কাজ কেন জেএসএস কর্মীরা করবে? এসব কারণে তারাই চোরাচালানীদের ধর্মের শত্রুদের ধরবার চেষ্টা করছে। সাংবাদিক একজন মুসলমান ব্যক্তিকে ইন্টারভিউ করেন। তাকে বিনা কারণে পুলিশ গ্রেফতার করে ও জেলে রাখে। খ্রীস্টান কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তারা সাংবাদিককে জানান, পুলিশ তাদের গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করে কেন, তারা জোর করে হিন্দুদের খ্রীস্টান করছে? গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, ব্রিটিশ সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেন। ছাত্রটি ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার কথা বলেন। সাংবাদিক দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা মৃদুলা মুখার্জির সঙ্গেও কথা বলেন। এই শিক্ষিকা যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর “ওহফবঢ়বহফবহপব ঝঃৎঁমমষব ড়ভ ওহফরধ”। বইটি গত ২০ বছর ধরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বইটি বর্তমান সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী কার্যকলাপ চলছে। ভারতেও সংখ্যালঘু বিদ্বেষী কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। যদিও দুটির চরিত্র ভিন্ন। জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন,‘ ঃড়ি বীঃৎবসবং রিষষ মবঃ ঃড়মবঃযবৎ’, আমরা জানি না দুই দেশের সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক কি হবে? একটি সম্ভাবনা এই যেÑ এরা একে অপরের কাজকে ব্যবহার করবে নিজের কাজকে সঠিক বলে চালাবার জন্য। এর পরিণতি হবে আমাদের জন্য ভয়াবহ। যদি বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা হিন্দুদের ভারতে চলে যেতে বাধ্য করে তবে ভারতীয় সন্ত্রাসীরাও মুসলমানদের বাধ্য করবে দেশত্যাগী হতে। বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা দেড় কোটির মতো। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ১৩ কোটির মতো। এই সংখ্যার অর্ধেক যদি বাংলাদেশে চলে আসে তবে বাংলাদেশের অবস্থা কি হবে? আমাদের চরমপন্থীরা যেন এই বিষয়টি মাথায় রাখে। সন্ত্রাসী কাজের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা লাগিয়ে রাখলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশে বাঙালীদের চাকরি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এসব আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের কৃতকর্মের পরিণতি কি হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের সজাগ হতে হবে। লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
×