ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন সন্তানের মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে আবেদন!

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

তিন সন্তানের মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে  আবেদন!

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ এক দুরারোগ্য ব্যাধির নাম ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি। এ রোগের কোন চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি আজও। মেহেরপুরে আপন দুই সহোদর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবা তোফাজ্জেল হোসেন এখন নিঃস্ব। দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া যেন কোন উপায় নেই আর। নাতনিরও ধরা পড়েছে এই রোগ। তাই সর্বশান্ত হয়ে এখন দুই সন্তান আবদুস সবুর (২৪), রায়হানুল ইসলাম (১৩) ও নাতনি সৌরভের (৮) মৃত্যু কামনা করেছেন তিনি। মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনও করেছেন তোফাজ্জেল হোসেন। বৃহস্পতিবার মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহের কাছে এ লিখিত আবেদন করেন তিনি। ছেলে ও নাতনির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় অসহায় বাবা তোফাজ্জেল হোসেন আবেদনপত্রে বলেন, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত দুই ছেলে ও নাতনির মৃত্যুর অনুমতি দেয়া হোক। না হলে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা হোক। জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মেহেরপুর শহরের বেড়পাড়ার ফল ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন। আর পাঁচটি মানুষের মতো অনেক স্বপ্ন নিয়ে ৩০ বছর আগে সংসার জীবন শুরু করেন তিনি। একে একে তিন সন্তানের জন্ম হয় তাদের কোল জুড়ে। এদের মধ্যে বড়টি মেয়ে আর ছোট দু’টি ছেলে। ছেলে দু’টিকে নিয়ে তাদের মনে অনেক স্বপ্ন উঁকি দিতে থাকে। বড় ছেলে সবুর ৬ বছর বয়স থেকে পাড়ার শিশুদের সঙ্গে স্কুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু আট বছর বয়সে পৌঁছার পর হঠাৎ করেই দু’পায়ের শক্তি হারাতে থাকে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে ভারতের কেয়ার হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ গৌরাঙ্গ ম-ল, কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ স্বপন মুখার্জিও সবুরের মল-মূত্র, রক্ত, কফ পরীক্ষা করে ‘ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ রোগটি সম্পর্কে নিশ্চিত হন। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মাহাবুবুল আলম জানান, সবুর দুরারোগ্য ব্যাধি ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই। এখন ধীরে ধীরে চলাফেরা, কথা বলা ও খাওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলবে। এগিয়ে যাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। সবুরের বয়স এখন ২৪ বছর। সবুরের অনেক বন্ধুরাই এখন কর্মজীবনে রয়েছে, অনেকে পড়াশোনা করছে কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে দেখাও করতে পারে না সবুর। কোন রকমে কথা বলতে আর হাত দুটি নাড়াতে পারলেও খাওয়া, গোসল ও প্রাকৃতিক কাজ করার কোন শক্তি নেই তার। ছেলের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত ঘুরেও কোন লাভ হয়নি। তাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন বাবা-মা। তোফাজ্জেল হোসেনের বড় ছেলে জানান, সবুরের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। প্রতিবেশী দুরন্ত শিশুদের ছাটোছুটি আর দুরান্তপনা দেখে খুব কষ্ট হয় তার। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আবদুস সবুরের মা শিরিনা বেগম জানান, ছেলে কিছুই করতে পারে না, সব কাজ তাকেই করতে হয়। নিজের শরীরও ভেঙ্গে পড়েছে। তবুও এ কষ্টের কোন শেষ নেই। বাবা তোফাজ্জেল হোসেন আবেগ আপ্লুত হয়ে জানান, ছেলের চিকিৎসা করাতে সঞ্চিত সব অর্থই শেষ হয়ে গেছে। এরপরও আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়েও চিকিৎসা করান হয়েছে। তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন একেবারেই নিঃস্ব। তাই সন্তান আর নাতনির একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় নেই তার কাছে। এদিকে তোফাজ্জেল হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের বেড়পাড়ায় তার নিজ বাড়িতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সন্তানদের শারীরিক খোঁজ-খবর নিতে ছুটে যান জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) খাইরুল হাসান। এ সময় বিত্তবানদের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সন্তানদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্নভাবে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান।
×