ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৌশল পাল্টেছে জঙ্গী সংগঠনগুলো

ভার্সিটির সুন্দরী মেধাবী ছাত্রীদের দলে ভেড়ানোর টার্গেট

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

ভার্সিটির সুন্দরী মেধাবী ছাত্রীদের দলে ভেড়ানোর টার্গেট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। জঙ্গী তৎপরতা থাকার বিষয়ে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বেসরকারী নর্থ সাউথ, ব্র্যাক ও মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে জঙ্গী সংগঠনগুলো টার্গেটের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। তারা দলে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে ছাত্রদের চেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত, মেধাবী, সুন্দরী ও আধুনিক পোশাকধারী ছাত্রীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। কারণ সুন্দরী মেধাবী ছাত্রীদের দিয়ে সহজেই ছেলেমেয়ে উভয়কেই টার্গেট করা, তথ্য আদানপ্রদান, চাঁদা আদায়সহ অন্যান্য সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো সহজ হয়। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গী সংগঠনগুলোর কৌশলী টার্গেট থেমে নেই। তাদের সেই টার্গেটে পড়েই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিল গুলশানে হলি আর্টিজানের মতো ভয়াবহ হামলার সঙ্গে জড়িতরা। তাদের প্ররোচনায়ই শেষ পর্যন্ত হলি আর্টিজানে ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গী হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলার সঙ্গে জড়িতদের সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ। হামলকারীদের স্ত্রী ও বান্ধবীরাও স্বামী বা বন্ধুর কারণে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। তার প্রমাণ মিলে গুলশানে জঙ্গী হামলার পর সেখানে সেনাবাহিনীর চালানো কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গীর পরিচয় প্রকাশের পর। নিহতরা সবাই শিক্ষিত। এরমধ্যে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের, মীর সামেহ মোবাশ্বের দেশের অন্যতম খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলাসটিকার ছাত্র ছিল। আর নিহত নিবরাজ ইসলাম ছিল মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারাদেশে জঙ্গী বিরোধী ধারাবাহিক অভিযানে গুলশান হামলায় জড়িত পলাতক বাসারুজ্জামান চকলেটের স্ত্রী শায়লা আফরিন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নুুরুল ইলাম মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি ও আত্মহত্যা করা তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা এবং তানভীর কাদেরীর ছেলে আজিমপুরের একটি জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃত তিন নারীই উচ্চ শিক্ষিত। অভিযানকালে আত্মহত্যা করা উচ্চ শিক্ষিত জঙ্গী তানভীর কাদেরী বেসরকারী ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। ধারাবাহিক অভিযানে গত বছরের ২১ জুলাই জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমীর মোঃ মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসান (২৭) গাজীপুরের টঙ্গী থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। হাসানের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, নব্য জেএমবির টার্গেট উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী উচ্চবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে তারা নারীকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কারণ নারীদের দলে ভেড়ানো সম্ভব হলে, ছেলেদের ওই নারীদের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে নানা কৌশলে দলে ভেড়ানো সহজ হয়। নব্য জেএমবির কার্যক্রমে উচ্চ শিক্ষিত নারীরা কাজ করছে। মূলত টার্গেটকৃত নারীদের দলে ভেড়ানোর পর, তাদের দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হয়। এতে করে দ্রুত জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়। এসব নারীদের মধ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বেশি ফান্ড কালেকশন করা। নারীদের মাধ্যমে সহজেই বেশি ফান্ড গঠন করা সম্ভব হয়। ওইসব নারীরাও নিয়মিত চাঁদা দিয়ে থাকে। নারীরা চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি তথ্য আদান প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের দিয়ে তথ্য আদান প্রদান করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়ানো অনেকটাই সহজ হয়। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যের পর গত বছরের গত ১৫ আগস্ট গ্রেফতার হয় নব্য জেএমবির নারী নেত্রী মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী আকলিমা বেগম, একই বিভাগের অনার্সের শেষ বর্ষের সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্রী মৌ ও একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মেঘনা এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশী। ঐশীর পিতা ডাঃ বিশ্বাস আকতার হোসেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং মা ডাঃ নাসিমা সুলতানা, ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগে কর্মরত। তাদের কাছ থেকে নব্য জেএমবির চাঁদা আদায়ের রশিদ থেকে শুরু করে জিহাদী বইপুস্তক, অডিও, ভিডিও, প্রশিক্ষণের নানা সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা থেমে নেই। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও তৎপর রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা কিছুটা কম। এর অন্যতম কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের টার্গেট বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের সুন্দরী ছাত্রীরাই জঙ্গী সংগঠনগুলোর এখন প্রধান টার্গেট। কারণ ছাত্রীদের দিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা, চাঁদা আদায়, তথ্য আদানপ্রদান, তরুণদের দলে ভেড়ানো সহজ। হালে ফেসবুকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। আর সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ তরুণীরা। তাদের মাধ্যমেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিটিআরসি অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারপরেও থেমে নেই তাদের তৎপরতা। র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক লুৎফুল কবির জানান, উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত আধুনিক তরুণ-তরুণীদের জঙ্গীবাদে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি অনেকটা ভাইরাসের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। এরজন্য প্রযুক্তির সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। গ্রেফতারকৃত নব্য জেএমবির চার নারী সদস্য যার যার প্রতিষ্ঠানে দলের কার্যক্রম বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। তারা সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা দেয়ার পাশাপাশি চাঁদা আদায়, তথ্য আদানপ্রদান, দলে নতুন নতুন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের ভেড়ানোসহ নানা সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিল। তাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেসব নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও জঙ্গী সংগঠনগুলো একইভাবে কাজ করছে। পুলিশ ও র‌্যাবের উর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জঙ্গী তৎপরতা থেমে নেই। জঙ্গী সংগঠনগুলো ইদানীং কাদের কর্মকা- অশিক্ষিতদের কাছ থেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। তারা উচ্চশিক্ষিত তরুণ তরুণীদের টার্গেট করে এগুচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান টার্গেট বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণীরা। দেশের কিছু মাদ্রাসায়ও তাদের আস্তানা রয়েছে। তবে তা খুবই সীমিত আকারে। বাইরে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর তাদের সেসব মাদ্রাসার নিরাপদ আস্তানায় রাখা হয়। প্রশিক্ষিত তরুণ জঙ্গীদের বিভিন্ন মাদ্রাসায় থাকা আস্তানায় অপারেশন চালানোর আগে জমায়েত করা হয়। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা ও ঘিঞ্জি এলাকায় তাদের আস্তানা গড়ে তোলা হয়ে থাকে। আর প্রশিক্ষিত তরুণী জঙ্গীদের সাধারণত কোন অপারেশনাল কর্মকা-ে ব্যবহার করা হয় না। সম্প্রতি জঙ্গী সংগঠনগুলো নারী জঙ্গীদের দিয়েও অপারেশন চালানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।
×