ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতে ভাংচুর- নেপথ্যে চট্টগ্রামের বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

আদালতে ভাংচুর- নেপথ্যে চট্টগ্রামের বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ চট্টগ্রাম আদালতে মানব পাচার মামলায় সন্দিগ্ধ এক আইনজীবী ও তার স্ত্রীর জামিন না দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার যে নজিরবিহীন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে তা বিচারিক প্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পরিকল্পিত বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, আইনজীবী আসামিকে স্ত্রীসহ গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর এলাকা থেকে মানব পাচারের অভিযোগে সন্দিগ্ধ হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন বুধবার এ আইনজীবী দম্পতিকে আদালতে চালান দেয় পুলিশ। আদালত তাদের জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় হট্টগোল এবং একপর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুরের ঘটনা। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে এসেছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে নতুন একটি ভবন উদ্বোধন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী আইনজীবীদের সংগঠন বিজয়া সম্মিলনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে। তাঁর সঙ্গে বিশেষ অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী নতুন ভবন উদ্বোধন করে আইনজীবীদের বিজয়া সম্মিলন অনুষ্ঠান বর্জন করে চলে যান। নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আইনজীবীদের দ্বারা সৃষ্ট ঘটনায় অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে সে কমিটি বৃহস্পতিবারই কাজ শুরু করেছে। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার আদালত প্রাঙ্গণে সৃষ্ট এ ঘটনার পর অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায়, আটককৃত আইনজীবী জামাল উদ্দিন বিএনপির একজন সক্রিয় সমর্থক। তার জামিনের জন্য ওই দিন শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন আওয়ামীপন্থী ছাড়া সকলেই ছিলেন বিএনপি ঘরানার। আওয়ামী ঘরানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বার কাউন্সিলের নবনির্বাচিত এক সদস্য। চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের দ্বারা সংঘটিত এ ঘটনা কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিচারালয়ে আইনজীবীদের আদালতের একটি অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সকল প্রকার মামলা নিয়ে আইনজীবীরা আদালতকে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। এটাই রেওয়াজ। অথচ একজন সহকর্মী আইনজীবীর জামিন না হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নেতৃত্বে অনেকটা সন্ত্রাসী কায়দায় যে মিছিল, সমাবেশ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে তা অতীতে দেশের কোথাও ঘটেনি বলে এখন আলোচনায় উঠে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বারের সিনিয়র সদস্যদের অনেকে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা পরিস্থিতিকে অবনতির দিকে নিয়ে যেতেই তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা নিয়ে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে আইনজীবীদের মধ্যে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা দু’ভাগে বিভক্ত। অথচ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা এক শিবিরে চলে আসেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামীপন্থী হাতেগোনা কিছু আইনজীবীকে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। চট্টগ্রাম আদালতের এ ঘটনা দেশজুড়ে প্রচার হওয়ার পর এখন এর চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। অনেকে বিষয়টিকে আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য উস্কানিতেও লিপ্ত ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন, যা ছিল সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের এ ঘটনার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় দেখে এতই ক্ষুব্ধ হন যে, একপর্যায়ে তারা ঢাকা থেকে না আসার চিন্তা করেন। কিন্তু আদালতের বিষয়টি চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত তারা চট্টগ্রামে আসেন। এসে শুধুমাত্র আদালত প্রাঙ্গণের নতুন ভবন উদ্বোধন করেন এবং এতে বক্তব্যদানকালে ঘটনা নিয়ে তাঁর রক্তক্ষরণের কথা প্রকাশ ছাড়াও আইনজীবীদের উদ্দেশ করে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। এরপর তিনি ও আইনমন্ত্রী সনাতন সম্প্রদায়ভুক্ত আইনজীবীদের সংগঠন বিজয়া সম্মিলনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান বর্জন করে ঢাকায় ফিরে যান। আদালতের বিভিন্ন সূত্রে বিষয়টিকে ন্যক্কারজনক হিসেবে উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সরকারকে বিব্রত করতেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এটি এমন কোন ঘটনা ছিল না যে, এ ধরনের কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হবে। যে আইনজীবীর জামিন এক আদালত নাকচ করেছে, পরক্ষণেই কিন্তু অন্য আদালত মঞ্জুর করেছে। অথচ মধ্যবর্তী সময়ে যা ঘটে গেল তা শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য স্থানের জন্যও একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সহকর্মী আইনজীবী আসামি ও তার স্ত্রীকে জামিন না দেয়ায় এজলাসে ভাংচুর এবং পরে প্রভাব খাটিয়ে জামিন আদায়ের ঘটনাটি মর্মাহত করেছে খোদ প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীকেও। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আইনজীবী মহলে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা ঘটেছে তাতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিচারালয়ের আইনজীবীদের ভূমিকা। চট্টগ্রাম আদালতে মানব পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপি সমর্থক আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোঃ জামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রীকে র‌্যাব সদস্যরা গত ১৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে আটক করেছিল। সেদিন ওমরা হজের নামে সৌদি গমনকালে আটক করা হয় ১৪ জনকে। ইমিগ্রেশন পুলিশ রোহিঙ্গা সন্দেহে তাদের আটক করে। আটক একজনের পকেটে পাওয়া যায় মোঃ জামাল উদ্দিনের ভিজিটিং কার্ড। ফলে দায়িত্বরত র‌্যাব সদস্যরা সেখানে ওই দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জবাবে এ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন জানান, তারা এক আত্মীয়কে বিদায় দিতে বিমানবন্দরে এসেছেন। আটক কারও সঙ্গে তার কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সস্ত্রীক ওই আইনজীবীকেও আটক করে আদালতে চালান করা হয়। পরদিন বুধবার ওই আইনজীবী ও তার স্ত্রীর জামিন আবেদনের শুনানি হয় মুখ্য মহানগর হাকিম মোঃ শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়ার আদালতে। জামিনের পক্ষে শুনানিতে উপস্থিত হন শতাধিক আইনজীবী, যার বেশিরভাগই বিএনপিপন্থী। শুনানি শেষে বিচারক জামিন আবেদন নামঞ্জুর করলে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্য থেকে প্রথম হট্টগোলের সূত্রপাত হয়। আইনজীবীরা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, তারা এজলাসের জানালার কাঁচ ভাংচুর করার মধ্য দিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, নির্বাচিত আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বিক্ষুব্ধরা মুখ্য মহানগর হাকিম মোঃ মাসুদ পারভেজের আদালতে বিশেষ আবেদন পেশ করেন। সন্ধ্যা ৭টার পর খুবই সংক্ষিপ্ত এক শুনানিতে অভিযুক্ত আইনজীবী দম্পতির জামিন মঞ্জুর হয়। প্রভাব খাটিয়ে জামিন আদায়ের বিষয়টি সমালোচিত হয় আইনজীবী মহল এমনকি সাধারণ মহলেও। জামিন আদেশে আদালত এই বলে মন্তব্য করে যে, বিষয়টি অত্যন্ত ছোট। অধিকসংখ্যক আইনজীবী জামিন শুনানিতে এসেছেন। আসামি নিজেও একজন আইনজীবী। অপর আসামি তার স্ত্রী। মামলার এজাহারে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। সন্দিগ্ধ হিসেবে আটক করে আদালতে চালান দেয়া হয়েছে। তাদের জামিন মঞ্জুর করা হলো। জামিনের শুনানি সম্পন্ন করতে সময় নেয়া হয় মাত্র পাঁচ মিনিট। এরপর বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নেতৃত্বে আদালত অঙ্গনে উল্লাস ও আনন্দ মিছিল হয়। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায় উৎসবমুখর একটি দিন হওয়ার কথা ছিল। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নতুন ভবনের উদ্বোধনকে ঘিরে আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কিন্তু ঠিক আগের দিন বুধবার বিচারালয়ে ঘটে যায় নজিরবিহীন এক ঘটনা। আদম পাচারের এক মামলায় অভিযুক্ত হন চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী মোঃ জামাল উদ্দিন এবং তার স্ত্রী। বৃহস্পতিবার নির্ধারিত ছিল চট্টগ্রামে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের উদ্বোধন। এতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান অতিথি এবং আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। অতিথিরা আদালতের এ নতুন ভবন উদ্বোধনের পর সনাতন ধর্মাবলম্বী আইনজীবীদের সংগঠন বিজয়া সম্মিলন অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই ঢাকা ফেরেন। নতুন আদালত ভবনের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি যা বলেন তাতেই বেরিয়ে আসে ক্ষোভ ও মনোকষ্ট। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম আদালতে যা ঘটেছে তাতে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আদালতের মতো জায়গায় আইনজীবীরাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাবেন তা অবিশ্বাস্য এবং নজিরবিহীন উল্লেখ করে তিনি আদালতের সম্মান রক্ষার আহ্বান জানান। সে দিনের ঘটনা তদন্তে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনাও রয়েছে। চট্টগ্রামে আইনজীবীদের সংগঠন বিজয়া সম্মিলনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথির যোগ না দেয়া প্রসঙ্গে এ্যাডভোকেট রনি কুমার দে জানান, আমরা তাঁদের খুবই আশা করেছিলাম। তাঁদের যোগদানের কথাও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন যোগ দেননি তা একান্ত নিজস্ব ব্যাপার হতে পারে। তবে এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। এ্যাডভোকেট রনি বলেন, আমরা সব সময়ই চাই বেঞ্চ এবং বারের মধ্যে ভাল সম্পর্ক, যা বিচারালয়ের সামগ্রিক পরিবেশকে সুন্দর রাখে। সেদিন যে ঘটনা ঘটেছিল তা অপ্রত্যাশিত এবং অনভিপ্রেত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সমিতির নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হলে অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনা এড়ানো যেত বলে তিনি অভিমত রাখেন। এদিকে, বিজয়া সম্মিলনের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এবং আইনমন্ত্রীর যোগ না দেয়ার বিষয়টি ব্যক্তিগত বিষয় বলা হলেও এর নেপথ্যে যে আগের দিনের ঘটনাটিই কাজ করেছে তা অনেকটাই পরিষ্কার। কেননা, ওই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক ছাড়াও মহানগর দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজসহ বিচারকদেরও অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু তারা কেউই আসেননি। ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে এখন আলোচনায় মুখর আইনজীবীসহ সচেতন মহল। তবে আইনজীবী নেতাদের পক্ষ থেকে শুক্রবার ধারণা পাওয়া গেছে, তাদের বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব মিটমাট করা যায় তা নিয়ে তৎপরতা চালানো হবে। নেতাদের পক্ষ থেকেও ঘটনাটি ঠিক হয়নি বলেও মত ব্যক্ত করা হচ্ছে।
×