ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক উপন্যাস

(পূর্ব প্রকাশের পর) বাপ-বেটার বাঘ শিকার (অপেক্ষা পর্ব) বারো বছরের জয়নুল আবেদীনকে নিয়ে সুবেদার সুজা ঢাকা হতে বেশ দূরে আস্তানা গেঁড়েছেন। দুই নদীর মোহনায় ঘন জঙ্গলের তফাতে উপত্যকার মতো উঁচু জায়গায় সুজা তাঁর শিকারের বহর নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এক দিন আগে তাঁরা এই জায়গাতে এসে পৌঁছেছেন। সামনের প্রায় আধ মাইল এলাকাজুড়ে মাথার সমান উঁচু ঘাসের বন। পশু বা কোন শিকার ঐ পথে এলে সহজে নজরে পড়বে। সাত দিন আগেই আগুয়ান অভিজ্ঞ একদল শিকারী পশুদের খেদিয়ে এই পথে ধাওয়া করে আনতে চলে গেছে। তাদের নেতাকে সুজা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, ডোরাকাটা রাজকীয় বাঘ তাঁদের জন্য শিকার হিসেবে তাড়া করে আনতে না পারলে কারো রক্ষা নেই। তিনি চান বালক জয়নুল তাঁর মতো অল্প বয়সে নিজ হাতে বাঘ শিকার করে ‘শের’ উপাধিতে ভূষিত হোক। শুধু পুত্রের কাছে এটা ইজ্জত কা সওয়াল নয় সেইসঙ্গে মুঘল রক্তের ঐতিহ্য বলে কথা! শাহজাহানের ছেলে হিসেবে শাহ সুজা শিকো’র অনেক গর্ব। বাপ-দাদা-পরদাদাদের মতো শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন তাঁর মতো আর কে করতে পেরেছে? শিকারের নেশা ও দক্ষতায় তাঁর ধারেকাছে অন্য ভাইরা কি ঘেঁষতে পারবে? শুনেছেন মাঝে সাঝে মুরাদ এদিকওদিক ঘুরে বেড়ানো দুর্বল সিংহ বা বুনো শূকর মেরে হাতের সুখ মেটায়। এ আর এমন কি? বাংলার বনে-জঙ্গলে হিংস্র পশুর বসবাস। আর সবাই জানে শিকারী হিসেবে তিনিই সেরা। আব্বাহুজুরও জানতেন এই রাজ্য শাসনে সুজা ছাড়া আর কেউ যোগ্য নয়। তা নাহলে সারা হিন্দুস্তানের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী রাজ্যে কি তাঁকে সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দিতেন? দারা নরমসরম মানুষ। মুরাদ বদরাগী। তবে চালাক আওরঙ্গজেব একটু মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সুজা মনস্থির করে রেখেছেন তিনি তাঁর ছোট ভাই আওরঙ্গজেব’কে বাংলা-বিহারের সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেবেন। যদি কোন ভাই কোন বন্দোবস্তে রাজী না হন তবে তাঁদের সবাইকে তিনি জোর করে মক্কায় হজ্বে পাঠিয়ে দেবেন। মহামতি আকবর একই উপায়ে বৈরাম খানকে মক্কা শরীফে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বেচারা বৈরাম খান! যদি সেভাবে ওই যাত্রাপথে খোদা-না-খাস্তা ভাইদের কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আফসোস ছাড়া কি করার আছে? মোদ্দা কথা সুজা মোটামুটি নিশ্চিত, হিন্দুস্তানের পরবর্তী বাদশাহ তিনিই হচ্ছেন। সে অনুযায়ী তাঁর পছন্দের সন্তান জয়নুল আবেদীন হবেন পরবর্তী নতুন মুঘল বাদশাহ। তাই এখন হতেই তাকে প্রস্তুত করতে হবে। হাতীর পিঠে বসে স্বগতভাবে এতসব ভাবতে ভাবতে সস্নেহে ছেলের দিকে তাকালেন সুজা। গরমের রোদের আঁচে জয়নুলের ফরসা মুখটা চকচক করছে। জুলফি’র নিচে জমেছে ঘামের ফোঁটা। মাথার ওপরের সিল্কের কাপড়ের ছাতিটাও যেন রোদের তাপ হতে বাঁচাতে যথেষ্ট নয়। পুত্রের এই কায়িক পরিশ্রমে মনে মনে প্রসন্ন হলেন সুজা। শিকারের এই মামুলি কষ্ট সহ্য করতে না পারলে কিসের মুঘল পুরুষ? - বাদশাহ নামদার! আজ জব্বর শিকার হবে। তুঘরিল মিঞা সুজাকে সবসময় সরাসরি বাদশাহ সম্বোধন করেন। সুজার শুনতে ভালোই লাগে। ওদিকে জয়নুল অধৈর্যের সুরে বলে উঠলেন, - খালি খালি মিথ্যা কথা বলো তুমি তুঘরিল মিঞা। সেই সকাল হতে ঠাঁই বসে আছি আমরা। একটা মুরগীও দেখতে পাচ্ছি না। তার চেয়ে কেল্লার ছাদে পায়রা উড়িয়ে ‘ইশকবাজী’ করলে অনেক মজা হতো। কোথায় তোমার শিকার? সুজা পুত্রকে শান্তনা দিয়ে বললেন, - আরেকটু অপেক্ষা করো ব্যাটা। আজ তো তুমি নিজ হাতে বাঘ শিকার করে তামাম রাজ্যে তোমার নাম ছড়িয়ে দেবে। - আমি পারবো বাঘ মারতে? - কেন পারবে না। তোমার বড় আম্মি মানে আমার দাদীজান নূরজাহান যদি মেয়েমানুষ হয়ে একসঙ্গে দুইটা বাঘ মারতে পারেন তবে তুমি কেন পারবে না ব্যাটা? - তা হলে আমিও আজ একটা বাঘ মেরে তার চামড়া ছিলে কেল্লায় আপনার লটকানো বাঘের চামড়ার পাশে আমারটাও ঝুলিয়ে রাখবো ...। ঘাড় সোজা করে গর্বে গদগদ হয়ে ঘোষণা দিলেন জয়নুল। -সাবাশ ব্যাটা। বাঘ এলে প্রথম গুলিটা তা হলে তোমাকেই করতে দেব। সুজা বসেছেন সবচেয়ে বড় হাতিটার হাওদায়। তার পেছনে পৃথক গদিতে বন্দুক হাতে নির্দেশের অপেক্ষায় বসে আছে এক সৈনিক। সামনে সতর্ক দৃষ্টিতে খালি গায়ে শুধু মাথায় পাগড়ি পরা মাহুত শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটুতে ভর করে আছে। সুজা’র ডান পাশেই জয়নুলের হাতি একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝলমলে কাপড় আর অলংকারে সাজানো হাওদা। বাম পাশের হাতিতে অতিরিক্ত বন্দুক নিয়ে মাহুতসহ বসে আছেন প্রধান শিকারী বর্ষিয়ান তুঘরিল মিঞা। শিকারের যাবতীয় নিয়ম-কানুন তার নখদর্পণে। তাদের দুই পাশে অর্ধবৃত্তাকারে আরো নয়টা হাতি উজির-অমাত্যসহ নানা রসদপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে শুঁড় তুলে তারা তাদের অস্থিরতা প্রকাশ করছে। মাহুতরা দক্ষ হাতে তাদের সামলে শান্ত রাখছে। - হুজুর, ওই দেখেন পাখির দল আসছে এদিকে। তুঘরিল উত্তেজিত কণ্ঠে আঙ্গুল তুলে সারিবেঁধে উড়ে আসা সাদা বকের ঝাঁক নির্দেশ করলেন। - হ্যাঁ তাই ... কিন্তু আমাদের খেদানো দলের ঢোল-কাঁসার শব্দ তো শোনা যাচ্ছে না’। সুজা চোখের ওপর হাত দিয়ে সূর্য আড়াল করে দিগন্তের দিকে তাকালেন। তুঘরিল ঠিকই আবহাওয়া আঁচ করতে পেরেছেন। প্রথম যৌবনে বাদশাহ আকবরের সঙ্গে বাঘ শিকারে গিয়ে তিনি বাঘের থাবায় আহত হয়েছিলেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর ও বাদশাহ শাহজাহানের সঙ্গেও অনেকবার শিকারে শামিল হয়েছেন। তাঁর মতো শিকারের অভিজ্ঞতা ভারতবর্ষে খুব কম লোকের আছে। এ জন্যই সুজা সব সময় তাকে বিশেষ ইজ্জত দিয়ে শিকারযাত্রায় সঙ্গে রাখেন। - বাদশাহ হুজুর, আমার ধারণা আমাদের অগ্রিম দল অন্তত আধা ক্রোশ দূরে আছে। বেশ বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। - সবাই প্রস্তুত থাকো। যেন যুদ্ধ ঘোষণা দিলেন শাহ সুজা। পুরো দল একসঙ্গে নড়েচড়ে উঠলো।
×