ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অরূপ তালুকদার

গল্প ॥ নীল কুয়াশা

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

গল্প ॥ নীল কুয়াশা

গাড়ি চালাতে চালাতেই শেখর টের পেল পকেটের মধ্যে মোবাইলের রিংটোন বেজেই চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই হাত সেদিকে যাবার কথা। কিন্তু সে ইচ্ছেটাকে দমন করল শেখর। যে-ই হোক, গাড়ি না থামিয়ে ফোন ধরা যাবে না। বায়তুল মোকাররম ছাড়িয়ে মতিঝিলের অফিস পাড়ায় গাড়ি ঢুকছে। ফাঁকে আশপাশে একবার চোখ বুলিয়েই শেখর বুঝে নিল দুনিয়ার যত ঝুট ঝামেলা এখন এই অফিস আওয়ারে এখানেই উপস্থিত হয়েছে। এসব পাশকাটিয়ে পিঁপড়ের মতো এগোতে হবে সামনের দিকে। বিরক্তির একেবারে একশেষ। কারুর কোন জরুরী কাজ থাকলে এ সময়ে মেটাবার কোন চান্সই থাকে না। এর মধ্যে ফোন ধরে কথা বলা! এক কথায় অসম্ভব। শিল্প ব্যাংকের পাশ দিয়ে একটু সুযোগ পেয়েই শেখর ঢুকে পড়ল দিলখুশায়। এখানটায় আরেক যন্ত্রণা। রাস্তাটার দু’পাশ ধরে আধাআধি প্রায় বন্ধ করে রেখেছে গাড়ির পর গাড়ির সারি। এই অবৈধ পার্কিং নিয়ে কেউ কিছু বলে না। কিছু এগিয়ে শেখরও খুঁজতে লাগল একটু ফাঁক-ফোকর, যেখানে সে-ও তার গাড়ি ঢোকাবে। কপাল ভালো। পেয়েও গেল। গাড়ি বন্ধ করে দোতলায় উঠতে উঠতে মনে পড়ল ফোন কলটার কথা। অফিসের ভেতরে ঢুকে চলে এলো শেখর নিজের চেম্বারে। তারপর বসতে বসতে খুলল মোবাইল। মিসডকল চেক করে পেয়ে গেল আকাশের কল। নাম্বারটা দেখেই বুঝেছিল দেশের বাইরের কল। পনের বিশ মিনিটের মধ্যে অফিসে একটু গুছিয়ে বসেই আকাশকে ধরল শেখর। দু’বার চেষ্টা করতেই পেয়ে গেল। হ্যালো... ইয়েস্... আকাশ হিয়ার... হ্যালো... হ্যা, আমি শেখর বলছি- ... ইয়েস মাই গুড ফ্রেন্ড- শেখর, আমি আগামীকাল ব্যাঙ্গালোর লিভ করছি... একদিন মাদ্রাজ... তারপর ঢাকা। তারপর? শেখর জানতে চায়। ঢাকায় একটা কনফারেন্স এ্যাটেন্ড করতে হবে। তারপর ব্যাক টু কোলকাতাÑ সবমিলিয়ে তিনদিন ঢাকায় থাকব। ওয়েলকাম... আমার কাছে কবে আসবি? দেখাই বা হবে কবে? মাঝখানের দিন বিকেলে। রাতে তোর ফ্ল্যাটে থাকব। সারারাত চুটিয়ে গল্প করব। চমৎকার! শেখর খুশি হয়ে প্রায় লাফিয়ে ওঠে। কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয় নি, বল তো? আকাশ বলে, চার বছর তো হয়েই গেল বোধ হয়- নাহ্, শেখর বলে, বছর তিনেক হবে তুই এখান থেকে চাকরি ছেড়ে বিদেশে চলে গেলি। তারপর... বাদ দে এখন এসব... এসে সব কথা হবে। সারারাত আর ঘুমাবো না, ঠিক আছে...? ওকে, বাই..., শেখর লাইন কেটে দেয়। চারদিনের দিন ঢাকায় এসে পৌঁছল আকাশ। যোগাযোগের পরে মাঝখানের তিন চারটা দিন নিজের কাজগুলো মোটামুটি গুছিয়ে নিল শেখর। কথা হলো আকাশের সাথে। উঠেছে এসে গুলশানের একটা হোটেলে। সেখানেই তার থাকার ব্যবস্থা করেছে আয়োজকরা। প্রথম দিন দিনে রাতে আর কোন খবর হলো না। দ্বিতীয় দিনের বিকেলে আকাশের কল পেলো শেখর। হ্যালো-হ্যালো... শেখর- আকাশ! ইয়া, শেখর লোকেশনটা বল্।... তুই বনানীতে থাকিস্, তাইতো বলেছিলি? আকাশ বলে, এবারে নম্বর টম্বর বল্... রাইট। শেখর লোকেশন আর ফ্ল্যাটের নম্বর জানায় আকাশকে। এই??বে চলে আয়, আমাদের রাস্তায় ঢুকে কল দিস্... ঠিক আছে? ইয়াহ্... ওকে... আকাশ বলে, সন্ধ্যার পরে আসব। ছাড়ছি। আকাশ সবসময়ই ঐ রকম। সদাহাস্য, প্রাণচঞ্চল আর উইটি। সবকিছু নিয়েই ও মজা করতে ভালোবাসে। বুয়েটের সহপাঠীদের মধ্যে আকাশ ছিল সবচাইতে উজ্জ¦ল। তার জন্য অনেক মেয়েই মনে মনে ওর দিকে ঝুঁকে থাকত। আকাশ যে এটা জানত না, তা নয়। বরং জানত বলেই অনেক মেয়েকে সময় অসময় জব্দ করেছে নানাভাবে। তারপরেও নিকিতার মতো মেয়ে শেষ পর্যন্ত ওকে হাতের মুঠোয় আনতে পেরেছিল। আধুনিকা নিকিতার ধারে কাছে ঘেঁষত না সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা। নিকিতা ????কে সহজে পাত্তা দিত না। তবে আকাশের ব্যাপারটা হয়েছিল উল্টো। তার কাছে পাত্তা না পেয়ে একসময় তাকেই টার্গেট করেছিল সে। শেষ পর্যন্ত আকাশও পরাজিত হয়েছিল তার মোহজালে। একসময়ে বিয়ে করে আকাশ নিকিতাকে। আর বিয়ের মাস তিনেক পরেই এমএস করার স্কলারশিপ পেয়ে আকাশ আমেরিকায় চলে যায়। এর মধ্যে নিকিতাও আর্কিটেক্ট হয়ে বেরিয়েছে। মাস ছ’য়েক পরে সেও আকাশের কাছে চলে যা?। এই ঘটনাগুলি মোটামুটি জানা আছে শেখরের। এরপরে মাঝে মাঝে যা জেনেছে সবটাই শোনা কথা বন্ধুবা???বদের কাছ থেকে। আকা?ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কম হয়েছে। কালেভদ্রে কখনো কখনো, তাও ব্যস্ততার মধ্যে। কারণ তখন শেখরও ?ড়ি?েছে মিলির সাথে। বিদেশ যাওয়া হয়নি। চাকরি নিয়েছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। তারপর সারাদিনরাত পরিশ্রম করে উঠেছে উপরে। তাতে দায়িত্ব যেমন বেড়েছে তেমনি স্বাভাবিক জীবনের অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছে। দাম্পত্য জীবনযাত্রারও চিড় ধরে গেছে অনেকটা তার অজান্তেই। কর্পোরেট লাইফে যেটা স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মেনে নিতে হচ্ছে এখন অনেককেই। রাত আটটার দিকে শেখর তার পাঁচতলার ফ্ল্যাটে আকাশের ফোনকল পেয়ে গেল। একটু পরেই নিচের রিসেপশন থেকে জানাল আকাশের আসার খবর। মিনিট দশেক পরে আকাশ চলে এলো উপরে। দরজা খুলেই দু’বন্ধু মুখোমুখি হলো দীর্ঘদিন পরে। আকাশকে প্রায় জড়িয়ে ধরেই ভেতরে নিয়ে এলো শেখর। উৎফুল্ল শেখর আকাশকে বসিয়ে দি? ড্রইংরুমের সোফার ওপরে। যাহ্ বাব্বা, চেহারাখানা যা বানিয়েছিস্ না, ভাবা যায় না। কেন, কী হলো। আকাশ একটু অবাক হয়। ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি আর টকটকে ফর্সা রংয়ে তোকে তো বিদেশী বলেই মনে হচ্ছে। ভেতো বাঙালীর চেহা???? একেবারে উধাও। ফিগারটাও চমৎকার। তাই নাকি!... আর তুই তো দেখছি বেশ ভালোই ওয়েট ??ইন করেছিস্- এই বয়সে খাওয়াটা একটু কমাও- চেষ্টা ?? করছি, শেখর বলে, যা খাচ্ছি সব শরীরে লেগে যাচ্ছে। সঙ্গে আবার বিদেশী পানীয়, না লেগে উপায় আছে! আকাশ হাসে। চারিদিকে তাকায় একবার। বলে, ভেতরের দিকটা তো এখনো অগোছালোই মনে হচ্ছে। আরেকটু গুছিয়ে গাছিয়ে- কে করবে এসব! শেখরের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের আবহ যেন উঠে আসে। আমার কি এত সময় হয়! না হবারই কথা, আকাশ বলে, মিলিকে তো তাড়ালি, তারপর আর কাউকে কি আর পেলি না! তাড়ালাম মানে! শেখর তাকায় আকাশের দিকে, সে তো নিজেই চলে গেল। আমি কি যেতে বলেছি, মেয়েটাকে পর্যন্ত নিয়ে গেল। ভালোই করেছে, মেয়েটার দেখাশুনো কে করত? আকাশ বলতে থাকে, তাকে সময় দেবার মতো সময় তোর তো ছিল না, তাহলে! লেখাপড়া কিছু কি হতো? তোর তো সময়ই নেই- শেখর চুপ করে থাকে। আকাশের কথার কোন প্রতিবাদ করে না। যাক্গে, এসব থাক। সেলার খোল্, জিনিসপত্র নিয়ে আয়- মন খারাপ করা কোন কথা শুনতে চাই না- আমিও না, তার চে’ লেট আস সেলিব্রেট, এতদিন পরে দেখা হলো- আকাশ জোরে হেসে ওঠে, ইয়েস্, নিয়ে আয় তোর সেই ফেবারিট অরেঞ্জ ফ্লেভার্ড হুইস্কি- আছে তো, না আবার ব্রান্ড চেঞ্জ করেছিস্? তোর সব মনে আছে দেখছি! শেখর এগিয়ে যায় সেলার-এর দিকে। মনে থাকবে না। স্টেটস্-এ থাকতে ওটা দেখলেই তোর কথা মনে পড়ত। তবে বাঙ্গালোরে ওটা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। শেখর বলে, তবু তো মনে রাখার মতো একটা কিছু পেলি। না হলে হয়তো ভুলেই যেতি। কথা বলতে বলতে শেখর কিচেন থেকে দুটো প্লেট আর দুটো প্যাকেট নিয়ে আসে। সব টেবিলে রেখে প্যাকেট দুটো খুলে ফ্যালে। বোতলটাও খুলে রাখে পাশে। এবার নে, ফ্রাইড চিকেন আর তোর সল্টে? বাদাম ছাড়াও আরো কিছু আছে। শুরু কর। শেখর সামনের সোফাটায় বসে পড়ে। হাত বাড়িয়ে রিমোটটা নিয়ে ডান দিকের ওয়ালমাউন্টেড বড় টিভিটা চালু করে দেয়। সাউন্ড একেবারে কমিয়ে গ্লাশ তুলে নেয় হাতে। কেউ কোন কথা বলে না কিছুক্ষণ। একসময় আকাশ তাকায় শেখরের দিকে, একেবারে বোবা হয়ে গেলি যে! এবারে বল্ মিলির ব্যাপারটা কী হলো? বলছিলিতো মিলি খুব ভালো মেয়ে, শান্তশিষ্ট চুপচাপ ধরনের ঘরোয়া মেয়ে। শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারলি না! ঠিকই বলেছিলাম। তোর নিকিতাকে দেখে ঠিক করেছিলাম ঠাঁটবাটঅলা দাপুটে মেয়ের চাইতে আমি এমন মেয়ে বিয়ে করব যে হবে ধীরস্থির, সহনশীল, যে আমার সংসার দেখবে, ছেলেমেয়ে মানুষ করবে। তাহলে? তাহলে এমন কী হলো যাতে তোকে তার ছেড়ে যেতে হলো? জানি না! হয়তো আমার কাজের ব্যস্ততা ওকে একেবারে বিরক্ত আর ধৈর্যহীন করে তুলেছি?। বছর দেড়েক পর থেকে আমার জন্য তার টানটা তেমন আর ছিল না, চলেই গিয়েছিল প্রায়। তারপর? তারপর আর কি? দিনে দিনে অবিশ্বাস আর দূরত্ব বেড়েছে। তুই এতসব বুঝেও নিজেকে শোধরাতে পারলি না কেন? কেন একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে গেলি? তুই আসলে একটা হামবাগ... আকাশ টিপসি মুডে কথা বলছিল, কথাও কিছুটা জড়িয়ে আসছিল। বোতলটা প্রায় শেষ। নতুন আরেকটা আনবে কিনা ভাবছিল শেখর। এক সময় উঠতে গিয়ে টলে যাওয়া মাথাটা সোজা করে সোফার ব্যাকটা ধরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর একুট সময় নিয়ে বলে, নিশ্চয়ই তোর মনে আছে আকাশ, একসময় আমরা জীবনের ভ্যালু, ইথিকস আর সার্থকতার মাপকাঠি নিয়ে অনেক কথা বলেছি- রাইট। আকাশ বলে, ঠিকই তো, একটা মানুষ জীবনের ভ্যালুজ আর ইথিকস্ নিয়ে বোধহয় ততদিনই মাথা ঘামায় যতদিন পর্যন্ত না বাস্তব জীবনে ওপরে ওঠার সিঁড়িটার ধাপে পা রাখার সুযোগ পায়। তাহলে তুই কি বলতে চাস, শেখর বলতে থাকে, আমি কি এখন সেই ফাঁদে আটকে গিয়েছি? তোর কি তা-ই মনে হয়? না হলে তোর এত ব্যস্ততা কেন? কেন এত উদয়াস্ত পরিশ্রম আর টেনশন? আরো ওপরে ওঠার জন্যই তো এসব, কত সত্যিমিথ্যার জোড়াতালি আর চাকচিক্যের ঘেরাটোপ। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড-এ কেউ কারুর দিকেই তাকায় না শেখর, বরং একজনকে টপকে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে। কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। কখনো কখনো এদের মধ্য থেকে জন্ম নেয় কোনো হোয়াইট-কলার ক্রিমিনাল। তেমন কাউকে কি আমরা দেখিনি শেখর? তুই কি মি. চৌধুরীর কথা বলছিস, আকাশ? ঠিক ধরেছিস্, আকাশ বলে, আমার কর্মক্ষেত্রে মি. চৌধুরী কলকাঠি না নাড়লে আমার কি দেশ ছাড়তে হতো? তুই দেশ না ছাড়লে তেমন আর কি হতো? আমাকে হয়তো মরতে হতো অদৃশ্য আততায়ীর হাতে। আকাশ থামে। পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, থাক এসব শেখর... টেবিল থেকে পানীয় ভর্তি করে হাতে তুলে নেয় গ্লাস, বলে, আরো আছেÑ শেখর তাকায় আকাশের দিকে। আমার ধারণা, নিকিতার আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পেছনেও আছে মি. চৌধুরীর খেলা। স্টিল আই বিলিভ ইট। তোর নেশা হয়ে গেছে আকাশ, তাই এসব কথা বলছিস্। আগে তো এসব শুনিনি। আগে বলিনি, আজ বলছি কারণ আমি এখন আর এখানে থাকি না। তাই কাউকে ভয়ও পাই না। আর আজ রাতটা তোর সঙ্গে আছি। কাল বাদে পরশু আমি চলে যাবো এ দেশ ছেড়ে। আবার কবে এখানে আসব, তার কি কোন ঠিক আছে? একটু থামে আকাশ, কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে। পরে মাথা তুলে তাকায় শেখরের দিকে, তোর সঙ্গেই বা আবার কবে দেখা হবে কে জানে! .. আজকে বলে যাচ্ছি তোকে, স্টিল আই অ্যাম অন দি লাইন অফ ফায়ার... মি. চৌধুরীকে আমি ছাড়ব না। মি. চৌধুরী আগামী বছর রিটায়ার করবেন এন-টি-এ থেকে। তারপর যতদূর জানি উনি আমেরিকায় চলে যাবেন ছেলের কাছে। দেন লেট মি নো দ্য এ্যাড্রেস অব হিজ সান, শেখর তুমি আমার এই উপকারটুকু করবে নিশ্চয়ই। এটা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। যাক্গে, এসব থাক্। নিকিতা কোথায় আছে, কেমন আছে বল্। শুনেছিলাম সে-ও নাকি উড়ছে- শেখরের কথা কতটা শুনতে পেলো আকাশ বোঝা গেল না। তাকালো টেবিলের দিকে। আরে শেষ হয়ে গেলো তো! স্টক কি শেষ সেলারে! আনছি। শেখর নতুন বোতল আনতে যায়। যেতে যেতে বলে, ওটাই আনব নাকি নতুন কোন ব্র্যান্ড, ইফ ইয়ু লাইক- না, ককটেল করার দরকার নেই,... ক’টা বাজে এখন? শেখর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, এগারোটা- মাত্র! আকাশ মাথা ঝাঁকায়, নাইট ইজ স্টিল ইয়াং... হ্যাঁ, শোন্্, নিকিতার কথা জানতে চাইছিলি না? তবে শোন্, নাউ শি ইজ নট উইথ মি। ওখানে গিয়েই তার চাওয়া পাওয়ার লিস্ট আরো বড়ো হয়ে গিয়েছিল। সেটা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না অন্তত: ঐ সময়ে, এ্যান্ড সো শি লেফট আকাশ চৌধুরী। মাই গড! শেখর বোতল নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বসতে বসতে বলে, এতটা আপস্টার্ট হয়ে গিয়েছে! মাথার দু’পাশটা চেপে ধরে সোফার ব্যাকে হেলান দিয়ে বসে আকাশ। বলে, আমার এখন মনে হয় কি জানিস্, মনে হয় স্টুডেন্ট লাইফে আমি ওকে যে পাত্তা দিতাম না, এইভাবে সে তার শোধ নিয়ে নিল। শেখর তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। অমন করে তাকিয়ে আছিস্ কেন? আকাশের কথা শুনে কিছুটা চমকে ওঠে শেখর। আসলে তার চোখের সামনে তখন ছাত্রজীবনের অতি উজ্জ্বল আকাশের চেহারাটা ভেসে উঠছিল বারবার। বলে, ভাবছিলাম সেই ছাত্রজীবনের আকাশ আর আজকের আকাশের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই। যদিও সেদিনের সেই চেহারার সঙ্গে আজকের চেহারার তেমন মিল নেই। কিন্তু ছটফটে ভাবটা রয়েই গেছে। কেন, তাতে কী হলো? আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায় শেখরের দিকে, তাতে আমি মানুষটা তো আর পাল্টাই নি। বেসিক ব্যাপারটা তো আর পাল্টায় না মানুষের, যতই সে নিজেকে অন্যকিছু দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করুক না কেন। এই যেমন ধর না তোর কথাই, তুই বেসিক্যালি পাল্টাতে কি পারলি কখনো? তাহলে তো মিলিকে ধরে রাখতেই পারতি। ঠিক কিনা? হয়তো তুই ঠিক কথাই বলেছিস্, শেখর গা এলিয়ে দেয় সোফায়, আমারই হয়তো ভুল হয়েছে কোথাও মিলিকে বুঝতে। হ্যাঁ, আকাশ থামায় শেখরকে, একথাটাই ঠিক যে বোঝার ভুলের কারণেই হয়তো আজকাল আমরা পারিবারিক জীবন নষ্ট করে ফেলছি। আগে এমন ছিল না, স্বামী স্ত্রী, দু’জনার মধ্যের বন্ধনটা দৃঢ় থাকত। কথায় কথায় হুট করে একজনকে ছেড়ে চলে যেতো না। ঠিক, শেখর বলে, চলে যেতে পারতোও না কারণ সেখানে পারিবারিক সমঝোতা বা বন্ধন যা-ই বলি না কেন, সেটাকে সহজে কেউ অস্বীকার করতে পারত না। আর, এখন হয়েছে কি? বিয়ে টিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া বা এখনকার ভাষায় সোজা ডিভোর্সড হয়ে যাওয়া যেন কোনো ব্যাপারই নয় জামাকাপড় বদলানোর মতো। প্রেমট্রেম-এর ব্যাপারটাও তো তেমনি হয়ে গেছে। আকাশ বলতে থাকে, বিদেশের মতো আমাদের দেশেও আজকাল দেখছি যখন তখন এ ওর সঙ্গে প্রেম করছে, ক’দিন পরেই আবার একে অপরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেÑ শোন্, এখানে আমার একটা কথা বলার আছে, সেটা হচ্ছেÑ থেমে যায় আকাশ, মাথাটা একটু নুয়ে আসে। শেখর ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে বারোটার মত বাজে। উঠে এসিটা চালু রেখে ফ্যানটা বন্ধ করে দেয়। নেশাটা জমেছে আকাশের। বলে, এবারে ওঠ, আর নয়। বাকী কথা আবার কালকে বলিস্... না, না, আকাশ উঠতে উঠতে বলে, বলছিলাম কি, সব ক্ষেত্রেই এখন একটা স্বার্থের ব্যাপার আছে। আর গোলমালটা সেখানেই হবে হয়তোÑ। শেখর আকাশকে নিয়ে এসে বসায় ডাইনিং টেবিলে। কিছু পরে খাওয়া দাওয়া সেরে দু’জনে এসে শুয়ে পড়ে পাশাপাশি দুটো বেডরুমে। চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলেও শেখরের গাঢ় ঘুম হয় না। প্রথমে কিছুটা তন্দ্রার মতো এলেও একসময় তা-ও চলে যায়। ঘরে থাকলেও কখনো ড্রিংক করাটা তেমন এনজয় করে না শেখর। স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য যতটা প্রয়োজন ততটাই করে। তাও হয়েছে মিলির জন্য। এসব মিলি যতটা পারে এড়িয়ে যেতো। আকাশের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। আসলে ও কাউকে কখনো মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে এমন ছিল না কোনদিন। কিছুদিন পরপর গার্লফ্রেন্ড পাল্টে যেতো। সেটা, এখন শেখর ভাবে, সেটাও হতো মেয়েদের কারণেই। মেয়েরা যে যার কাজে ওকে ব্যবহার করত। আকাশের চাকরি জীবনেও তেমন ঘটেছে বেশ কয়েকবার। ফলে অনেকবার নানাধরনের জটিল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে আকাশকে। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই ‘ইনফোটেক ওয়ার্ল্ডওয়াইড’-এ চাকরি নিয়ে চলে গেছে আমেরিকায়। নানা রকম চিন্তাভাবনা আর একাকীত্বের কারণে এখন আর সহজে ঘুম আসে না। অনেক রাত অবধি জেগে থাকে শেখর। দিনে দিনে নিঃসঙ্গতা তাকে যেন পেয়ে বসেছে। আর সেজন্যই আজ আকাশ আসায় খুব ভালো লাগছিল। আকাশ যদি আরো কিছুদিন থাকত তাহলে আরো ভালো লাগত। একাকীত্ব কাটাতে কোন কোন রাতে বেশি করে ড্রিংক করে দেখেছে কিন্তু তেমন কোন কাজ হয়নি। কিছুটা সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থেকেছে ঠিকই কিন্তু পরে আবার নির্ঘুম কেটেছে গভীর রাত পর্যন্ত। তারপর শেষ রাতের দিকে টায়ার্ড হয়ে নিজের অজান্তেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের কাছে নিজের জীবনই যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। একসময় অস্বস্তি কাটাতে বিছানা ছেড়ে বেডরুম লাগোয়া ছোট বারান্দাটায় এসে দাঁড়ায় শেখর। মধ্যরাতের ঢাকা শহর ঘুমের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। যদিও একটু দূরের রাস্তায় মাঝেমাঝেই গাড়ি চলাচল করছে। এটা কমবে রাত দুটোর পরে। মাথার ওপর আকাশের দিকে তাকায়। রাতের আকাশের নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে পেছন দিকে। আকাশের গায়ে দূরে ঢাকার স্কাইলাইন চোখে পড়ে অনেকটা আলো-আঁধারির ভেতরে ছবির মতো। আকাশে এখন মেঘ নেই। স্বচ্ছ নীল আলোয় যেন ভরে আছে তারার চুমকি জ্বালিয়ে। বুকের ভেতর থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শেখর কি তাহলে কোন ভুল করেছে? এই প্রশ্নটার সত্যিই কোন উত্তর পায় না শেখর নিজের দিক থেকে। মিলিকে কি সে ভুল বুঝেছে সেই প্রথম থেকেই? আকাশের কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যায় : আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ শেখর, তোর কি কোন ভুল নেই? কেন থাকবে না? মানুষতো আর রোবট নয়। ভুলে ভরাই তো মানুষ, এমন কথা বলেছেন বিজ্ঞজনেরা। তাহলে সে ভুল শোধরানোর দায়িত্বটাও তো শেখরের। সব চিন্তুা ভাবনা শেখরের যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। প্রায় কিছু না ভেবেই, কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা এনে মিলির নম্বরে কল করে। ... হ্যাঁ, কল হচ্ছে, রিং টোন পাওয়া যাচ্ছে, শেখর যেন রুদ্ধশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খোলা বারান্দায়। হ্যালো... হ্যালো... মিলি? বলছি। শেখর একটু সময় নেয়। কী বলবে এই মুহূর্তে ভেবে পায় না। কিছুটা সময় পরে বলে, আমার কিছু কথা বলার ছিল- বলো। মিলি বলে, এত রাত হয়ে গেল। এখনো জেগে আছো? তুমিও তো ঘুমাওনি। তুমিওতো জেগে আছো। গলায় একটুও ঘুমের জড়তা নেই। কী বলছিলে, বলো- তুমি কেমন আছো? শর্মি কেমন আছে? এই কথা জানতে এতরাতে ফোন করেছো? আজকে আকাশ এসেছে আমাদের এখানে। দু’দিন হয় ঢাকায় এসেছে সেমিনার এ্যাটেন্ড করতে। তাই? হ্যাঁ, তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারপর- নিকিতা কেমন আছে? সেও কি এসেছে? মিলি অন্য কথা বলে। না। আর, নিকিতা তো নেই ওর সঙ্গে। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শেখর বলে, সে আমেরিকাতেই আছে। আকাশ এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে। লস এ্যাঞ্জেলস্ ছেড়ে আকাশ ইনফোটেক’-এর ব্যাঙ্গালোর অফিসের দায়িত্ব নিয়ে চলে এসেছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লিয়াজোঁ অফিস এটা। ... মিলি কি শুনছ? শুনছি।... কত যে পরিবর্তন হয়ে গেলো! মিলির দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ঠিক শুনতে পায় শেখর। মিলির দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা শেখরকে যেন নতুন করে কষ্ট দেয়। বলে মিলি, বলছিলাম কি- আকাশ একটু আগে একটা কথা বলছিলÑ তুমি কি শুনছ মিলি? কী বলছিলে, বলোÑ আকাশকে তুমি কী বলেছো কে জানে! যা সত্যি তাই বলেছি, নতুন কিছু বানিয়ে বলিনিÑ বানিয়ে আর কী বলবে? মিলি বলে, ‘যা বোঝার আকাশ ঠিক বুঝে নেবে। সে তো তোমাকে আমাকে দু’জনকেই চেনেÑ যাক্ কী বলছিলে বলোÑ আকাশ বলছিল, মিলি নিকিতার মতো নয়। ওর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার ব্যর্থতা তোরÑ তোর নিজেকে সংশোধন করা উচিৎÑ মিলির সঙ্গে এসব নিয়ে বসা উচিৎ। তারপর? মিলি যেন জানতে চায়, তমি কী বললে? আমি শুধু শুনেছি। কিছু বলিনি। ... আসলে কি হয়েছে, শেখর বলে, শর্মিকে খুব মিস্ করছি... তোমাকেও... তোমার মেয়েও মাঝে মাঝে তোমার কথা বলে। বড় হয়ে গেছে নাÑ ছেলেরা যেমন মায়ের তেমনি মেয়েরাও বাপের খুব নেওটা হয়, জানো না! কি জানি! আবার হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে।... যাক্ গেÑ অনেক রাত হলোÑ মিলি, ফোনটা ছেড়ো না, প্লিজ।... আমরা কি নতুন করে আবার... নিজেদের ভুলটুলগুলো শুধরে... মিলি, আমরা কি একটু সময় নিয়ে বসে... তুমি কী বলো...? হঠাৎ কথার মধ্যেই ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেয়ার পরিষ্কার শব্দ শুনতে পায় শেখর। [email protected]
×