ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ পাথরকুচির পাতায় পাতায়

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

বই ॥ পাথরকুচির পাতায় পাতায়

বালিশের শিয়রে জমে গেছে বই। শীত নেমেছে দুনিয়াতে। বেড়েছে আলসেমী অঢেল। তবু শুতে শুতে কিছু বই নাড়াচাড়া যে চরম অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। বইয়ে যেন জমে আছে ওম। সে ছাড়া চোখে সুনিদ্রা সাঁতার কাটে না। হাতড়াতে হাতড়াতে গতরাতে উড়ে এলো কবি মোশতাক আহমদের ‘বুকপকেটে পাথরকুচি’। আলগোছে উল্টাতে উল্টাতে বইটি ভাল লাগল। উপরিভাগে কাচাহলুদ রঙ। নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রচ্ছেদে আড়মোড়া ভাঙানো কারুকাজ। সূচিপত্রের নতুন নামকরণ। সুলুক সন্ধানে চোখ রাখলে চারটি কা- চোখে পড়ে। ‘মুখোমুখি বসিবার’ পয়লা। তারপর ‘দূরাগত হুইসেল’, ‘আজকাল চোখের চারপাশ’ ও ‘উদ্বেল সেলফির মুখ’ এই চারটি ভাগে ৫২টি কবিতার মৌন মিছিল। তো পয়লা আমার মন পড়ে থাকে জীবনানন্দে! মুখোমুখি হতে কষ্ট হয় কবিতার সঙ্গে। আমি যেন জীবনবাবুর মুখোমুখি বসে আছি! এই ভাগে আছে কয়েকজন কবিকে উৎসর্গিত কবিতা। প্রত্যেকটি কবিতায় জীবনানন্দ ঘোর প্রবল। আছেন ঠাকুর বাড়ির রবি, চাকার মালিক বিনয়, চিরদুঃখী আবুল হাসান ও হেনরি স্বপনকে নিয়ে কীর্তনখোলা ছুঁয়ে বলছি। কবি মোশতাক আহমদ বরীন্দ্র আচ্ছন্নতায় যে কবিতাটি লিখেছেন তার শিরোনাম ‘লক্ষ্মণরেখা’। ‘গুরুমারা কাব্য’ কবিতায় তুমুল স্যাটায়ার। যা বর্তমান সময়কে চাটুল হাস্যরসে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। ‘পুনরায় ফিরে এসো চাকা এই গায়ত্রী-সন্ধ্যায় বিনয়ের ঘরদোরে’ কিংবা ‘শতাব্দী-প্রাচীন চিত্রকর্মের থেকে আরক্তিম আলো চোখে মুখে মেখে ‘বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ’ দূর থেকে পরস্পর ‘মিলনের শ্বাসরোধী কথা’ ভাবে স্বপ্নাতুর বেলা।’ পড়লে বিনয় যেন হেসে ওঠেন। তেমনি ‘মুখোমুখি বসিবার’ কবিতায় জীবনানন্দ, ‘আবুল হাসানের জন্য এলিজি’ ও ‘আকাশে ছয়টি তারা’তে খুঁজে পাবো আবুল হাসানকে। ‘লাবণ্যময় পাথর আকাশের ছয়টি তারা আ বু ল হা সা ন’ পড়তে পড়তে ধরতে পারা যায় এসব কবির প্রতি কবি মোশতাক আহমদের প্রীতিতি। যদিও এ রকম কবিতা লেখার পক্ষপাতে আমি না-রাজি। তবে হ্যাঁ উৎসর্গিত কবিতাগুলোই এ রকম একটা শর্ত জুড়ে দেয় বটে। এরপর ‘দূরাগত হুইসেল’ ধ্যান ভাঙে। ‘লিখে দিলাম’ কবিতায় পড়ি। ‘আকাশ জুড়ে দিলাম লিখে জোছনাসমেত চাঁদ অন্তত তা দখল করুক চোখের সীমানা।’ মন ভালো করে দেবার মতো একটি কবিতা। মেদহীন ঝরঝরে। ‘ছায়াবাজি’ কবিতায় বুকপকেটে পাথরকুচির সন্ধান পায়। ‘ঋতুগুচ্ছ’-এ হেমন্ত আর বসন্তকে পেলেও তাদের হাওয়া পাঠককে শীতল করবে। আর কোনো ঋতুর দেখা না পেলেও যেন চলে! ‘দেহাতীত’ ও ‘আলতামিরা’য় দেখতে পাই মানিকের প্রাগৈতিহাসিক ও পুতুল নাচের ইতিকথার আশ্রয় করে রচিত। বেশ লাগে ‘চতুর পদ’ ও ‘পোড়োজমি’র সম্পদগুলো। ‘বাঁকা গাঙের পানি’তে মেলে চিরকালীন বাঙলার ছেলে জসীমউদ্দীনকে। মোশতাক আহমদের কবিতায় তার পাঠের আওয়াজ টের পাওয়া যায়। ‘যতদিন কবিতায় সুস্থির’ ও ‘বন্ধু’ কবিতাদ্বয় সুখপাঠ্য। আরাম লাগে। নিটোল এবং ক্রমশ ইন্দ্রিয়ঘন হয়ে পড়ার সুযোগ লাভ করা যায়। ‘আজকাল চোখের চারপাশ’-এ চোখ রাখা হয় না! ‘বন্ধুর দেখা পেতে’ কবিতায় স্বাদ-আস্বাদ খুঁজে পাই। জাদু-বাস্তবতার একটা ঘোরে আচ্ছন্ন করে তোলে। ভাবিয়ে তোলে মস্তিষ্কের প্ল্যাটগুলো। তারপর পড়ি কাফকার মেটামরফসিস। শার্লক হোমস, ওয়াটসন, হোরেশিওর মৃত্যুচিন্তার কবিতাময় রূপ। ‘খাকির খোঁয়ারি’ কবিতাটি অনিন্দ্য সুন্দর। আলাপী ও আকর্ষণীয়। এরপর ধরা পড়তে হয় ‘উব্দেল সেলফির মুখে’। সেখানে বিখ্যাত সব গানের কথাকে কবিতায় ব্যবহারের মুন্সিয়ানা দেখান কবি মোশতাক আহমদ। ‘খেরোখাতার খ-পদী’র দশটি কবিতা হাইকুর মতো হলেও চলনে বলনে তার বাঙালীয়ানা উজ্জ্বল। ‘নারকোলেপসির দিন’, ‘বইমেলায়’, ‘উপগ্রহ’, ‘আকাশবন্ধু’ কবিতাগুলো স্মৃতির পেয়ালা ভরে পরিবেশন করেন পরিশ্রমী এই কবি। বইটি পড়লে পাঠক অন্যরকম আমেজ পাবেন বলেই এই লেখা। পলিয়ার ওয়াহিদ
×