ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আয়তি নাহার

উন্নয়নের ধারায় নারীকে যুক্ত হতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

উন্নয়নের ধারায় নারীকে যুক্ত হতে হবে

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারীর সামাজিক অবস্থার তারতম্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, ভৌগোলিকসহ নানামাত্রিক উপাদানে কাঠামোর যে রকম ফের সেখান থেকেই নির্ণীত হয় কোন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের মাপকাপি। বিভিন্ন সূচকের মাত্রায় নারীদের এগিয়ে যাওয়া এবং পেছনে পড়াও নির্ভর করে একটি দেশের নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থার গঠন প্রক্রিয়ার উপর। আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণভাবে কিছু গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে কোন দেশের সামগ্রিক অবস্থার যে চিত্র বের হয়ে আসে সেখান থেকেই স্পষ্ট হয় এ দেশের নারী সমাজের উন্নয়নের বিবিধ মাত্রা। সম্প্রতি বাংলাদেশে সফরে আসা দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রণী নারী নেত্রী কমলা ভাসিনের দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রণী নারী নেত্রী কমলা ভাসিনের বক্তব্যেও এই মতই প্রতিভাত হয়। তাঁর মতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারীর সামাজিক অবস্থানে সব চাইতে অগ্রগামী দেশ ভুটান। নারী নির্যাতনের হার যেমন কম পাশাপাশি সম্পত্তির মালিকানা কাঠামোতেও নারীরা শক্ত অবস্থানে যা কোন দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। মালদ্বীপের অবস্থান এক সময় ভাল থাকলেও বর্তমানে দেশটি নারীর অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আর ভারতের অবস্থান তো বাংলাদেশের চাইতেও খারাপ। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত হলেও সামগ্রিক উন্নয়নের এটাই একমাত্র মাপকাঠি নয়। নারী যদি সহিংসতা থেকে মুক্তি না পায়, তার মর্যাদা ও অধিকার যদি তাকে যথার্থভাবে বাঁচার পথ দেখাতে ব্যর্থ হয় তাহলে কিছুসংখ্যক নারী নেতৃত্বের প্রভাব সামগ্রিক অবস্থার উপর ছাপ ফেলতে পারে না। কোন দেশের উন্নয়নে নারী শিক্ষা যেমন জরুরী, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন যেমন আবশ্যক একইভাবে তৃণমূল থেকে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকারের অন্যতম পূর্বশর্ত। বাল্যবিয়ে, অপরিণত মাতৃত্ব, শিক্ষাঙ্গন থেকে অল্প বয়সে ঝরেপড়া, কর্মযোগে নিজেকে যথার্থভাবে নিয়োজিত করতে না পারা সর্বোপরি পারিবারিক নির্যাতনের মতো মানসিক এবং শারীরিক পেষণ নারীর সামনে এগিয়ে যাবার নানা বাধা প্রতিবন্ধক। সম্মান, মর্যাদা এবং মালিকানার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নারীরা একেবারেই অসহায়। এসব ক্ষেত্রেও আবার কিছু পার্থক্য স্পষ্ট হয়। যেমন শহর, নগর, বন্দরে নারী নিপীড়নের চিত্র কম এবং সহনীয় হলেও গ্রামে-গঞ্জে এর মাত্রা অনেক বেশি। আবার যেসব দেশে সীমিতসংখ্যক আদিবাসী থাকে তারা পুরো জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেকটা চাপের মধ্যে থাকে অধিকারের মাত্রায়। স্বল্পসংখ্যক এসব উপজাতি প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যেসব সঙ্কট মোকাবেলা করে সেখানে নারীদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সম্পদের ফারাক যেমন মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে একইভাবে তা নারী-পুরুষের ভোদভেদকেও নানাভাবে উসকে দেয়। যুগ যুগ ধরে সমাজের ভেতরে এমন দেয়াল তৈরি হয়ে আছে সময়ের পরিবর্তনেও সেখানে ফাটল ধরে না, যুগের চাহিদাও তাকে নড়বড়ে করতে পারে না সে সব বন্ধ জীর্ণ প্রাচীরকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে না পারলে বহু পুরনো এসব সামাজিক আবর্জনা থেকে দেশ এবং সমাজ কখনও মুক্ত হতে পারবে না। উন্নয়নের অনেক স্রোতধারা সমাজে বহমান থাকলেও পেছনে পড়ে থাকা কিছু বর্জ্য এই গতিপথকে মাঝপথে আটকে দেবে। তার উপর প্রকৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গে বৈরিতা করে টেকসই উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। প্রকৃতিকে জয় করতে হবে, পরিবেশবান্ধব কর্মযজ্ঞের আবহ তৈরি করতে হবে তবেই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। নারী সমাজকেও সব উন্নয়নের সঙ্গে সমান তালে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নিজের মতে ও পায়ে নিজেকেই শক্ত অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সমাজের প্রতিটি উপাদানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নিজের সম্মান, মর্যাদা, অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলার গতিপথকে নিরন্তর করতে হবে। সব ধরনের সঙ্কীর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতাকে অকুতোভয় সৈনিকের মতো জয় করতে হবে। ঘরে-বাইরে নিজের অবস্থঅনকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে সমস্ত অসহায়ত্ব এবং বন্দিত্বকে অতিক্রম করতে হবে। অপরিণত বয়সে বিবাহ-ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। তার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ এবং সুস্থ মানসিকতা। সমাজের গভীরে গেঁড়েবসা অপ্রয়োয়জনীয়, অকল্যাণকর, অপসংস্কারকে রোধ করতে হবে। শিক্ষার্জনের মতো সমৃদ্ধ সামাজিক সূচকে নিয়ে যেতে পারলে কর্মসংস্থানের মতো আরও বৃহত্তর আঙ্গিনায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা সম্ভব হবে। আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোন নারীকে নিয়ে যাবে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। এ পথ সহজ সরল না হলেও অতিক্রমযোগ্য। কারণ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। সময়ের এই নিরন্তর গতিই নারীদের নিয়ে যাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। সচেতন এবং সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরকে পাড়ি দিতে হবে। সামাজিক অপসংস্কার, অভিশাপ, অপশাসন চলার পথে বিঘœ সৃষ্টি করলেও ঠা-া লড়াইয়ে তার মোকাবেলা করতে হবে। নিজের মৌলিক ও যৌক্তিক অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের মহতী উদ্যোগে সকল নারীকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ছাড়া দেশ যথার্থভাবে সমৃদ্ধি দ্বারে পৌঁছাতে বিলম্ব করবে।
×