ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মহাকাশ অভিযাত্রায় হাইপারসনিক বিমান

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

মহাকাশ অভিযাত্রায় হাইপারসনিক বিমান

মহাকাশ অভিযাত্রায় অস্ট্রেলিয়া নতুন কোন কুশীলব নয়। অনেক আগেই এ জগতে দেশটির পদার্পণ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উমেরায় মরুভূমিতে আকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ব্ল্যাক এ্যারো নামে বুলেট আকৃতির একটি রকেট। পরে রকেট প্রযুক্তি বা মহাকাশ অভিযাত্রায় দেশটির আর কোন অগ্রগতি ঘটা তো দূরের কথা বরং এ জাতীয় কার্যক্রম কার্যত পরিত্যক্তই হয়েছিল। কিন্তু একজন মানুষ এই পরিস্থিতি বদলে দিতে চান একটি বিমানের সাহায্যে যে বিমান শব্দের গতির চেয়ে পাঁচগুণ গতিতে চলতে পারে। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর উমেরা মরুতে ব্ল্যাক এ্যারো রকেট উৎক্ষেপণ অস্ট্রেলিয়ার একান্ত নিজস্ব উদ্যোগ ছিল না। ওটা ছিল আসলে ব্রিটেনের প্রসপ্যারো কৃত্রিম উপগ্রহ। রকেট উন্নয়নে দশ বছরেরও বেশি চেষ্টার পর ওটা মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। এই মিশনের মধ্য দিয়ে এক বড় ধরনের আন্তর্জাতিক মহাকাশ বন্দর হিসেবে উমেরার এক নবযুগের উন্মেষ ঘটতে পারত। হয়ত এটি নাসার কেপ ক্যানভেরাল অথবা রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোমের মতো বিখ্যাত হয়ে উঠত। কিন্তু ইতিহাস সে পথে অগ্রসর হয়নি। ব্রিটিশ রকেট উৎক্ষেপণ কর্মসূচীটি বাতিল হয়ে যায় এবং এডিলেডের ৫শ’ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত উমেরা মরুর সেই উৎক্ষেপণ কমপ্লেক্সটি শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। এখন এটি বিশাল একটা ভূখ- ছাড়া আর কিছু নয়। ষাটের দশকে এবং সত্তুরের দশকের প্রথম দিকে যা ছিল এক পুরদস্তুর মহাকাশ কেন্দ্র ৫০ বছর পর তা একেবারে মুছে যায়। উমেরা অবশ্য সামরিক বাহিনীর আর্টিলারী, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানের পরীক্ষার পাল্লা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইপারসনিক্সের অধ্যাপক মাইকেল স্মার্ট এখন এই বিচ্ছিন্ন নির্জন স্থানটিকে আশকোরা নতুন প্রজন্মের স্ক্র্যামজেট মহাকাশযান পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করছেন। স্ক্র্যামজেট নভোযান উদ্ভাবিত হয় ষাটের দশকে। প্রথম সাফল্যের সঙ্গে উড্ডয়ন করা হয় নব্বুইয়ের দশকে। স্ক্র্যামজেটের ইঞ্জিন বায়ু টেনে নিয়ে হাইপারসনিক বা শব্দাতিগ গতিতে অর্থাৎ শব্দের গতির চাইতে পাঁচগুণ গতিতে চলে। জেট ইঞ্জিনের মতো স্ক্র্যামজেট বায়ু টেনে নিয়ে থ্রাস্ট বা বেগ সৃষ্টির জন্য সেটিকে জ্বালানি পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করে। জেট বিমান বায়ুকে চাপযুক্ত করতে টার্বাইন ব্যবহার করে। অন্যদিকে স্ক্র্যামজেটের এ ধরনের কোন ঘূর্ণায়মান অংশ নেই। এক্ষেত্রে বিমানের যে হাইপারসোনিক গতি সেটাই মোটরের ভিতর বায়ুকে চাপযুক্ত করার জন্য যথেষ্ট। প্রফেসর স্মার্ট যে উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা চালু করতে চান তাতে কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠানোর খরচ বহুলাংশে কমে যেতে পারে। তবে একটা সমস্যা আছে। শব্দের গতির চেয়ে পাঁচগুণ বেশি গতি অর্জনের জন্য ক্র্যামজেটের প্রয়োজন অন্য কোন ধরনের প্রপালশন। আর এই সীমাবদ্ধতার কারণেই স্ক্র্যামজেটের প্রয়োগ বহু বছর ধরে আটকে ছিল। স্ক্র্যামজেট কাজ করার আগে হাইপারসনিক গতিতে চলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে একবার সেই গতি অর্জন করতে পারলে দেখা যাবে স্ক্র্যাম জেট হলো এ যাবতকালের সবচেয়ে দক্ষতাসম্পন্ন ইঞ্জিন। হাইপারসনিক গতি অর্জনের জন্য প্রফেসর স্মার্ট স্ক্র্যামজেটকে প্রচলিত রকেটের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে তার এই বিশেষ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর খরচ আমূল কমে আসতে পারে। স্মার্ট বলেন, প্রচলিত সকল কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তর বা ধাপ ব্যবহার করা হয়। প্রথম স্তর বা ধাপের রকেট সাধারণ শব্দের গতির ৫ বা ৬ গুণ স্তর পর্যন্ত যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের স্ক্র্যামজেট মহাশূন্যে যাবার দুই-তৃতীয়াংশ পথ হয়ত অতিক্রম করে। আর চূড়ান্ত উপরের স্তরের রকেটটি কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষপথে স্থাপন করে। উৎক্ষেপণ মঞ্চে স্পার্টান রকেটকে দেখতে লাগবে এবং সেটি যাত্রাও করবে প্রচলিত রকেটের মতো। এটি হাইপারসনিক গতিতে পৌঁছলে এর প্রথম স্তরটি খসে পড়বে এবং স্ক্র্যামজেটটি চালু হয়ে নভোযানকে সবেগে বয়ে নিয়ে যাবে উর্ধ বায়ুম-ল পর্যন্ত। বায়ু ফুরিয়ে গেলে স্ক্র্যামজেট বিচ্ছিন্ন হয়ে খসে পড়বে এবং প্রচলিত একটি জোট রকেট নভোযানকে মহাকাশে বয়ে নিয়ে যাবে। স্পার্টান রকেটের যতটা সম্ভব বেশিরভাগই পুনর্ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা। প্রথম স্তরের রকেট ও স্ক্র্যামজেটÑ দুটোই উড়ে এসে রানওয়েতে অবতরণ করবে। ওগুলো স্রেফ বড়সড় টিনের পাত্রের মতো। অতিমাত্রায় হাল্কা। শুধু উড়বার ব্যবস্থা আছে বলেই ওগুলোকে ছোটখাটো বেড়া নির্মাণের মতো দেখাবে। শুধু তৃতীয় ধাপের রকেটটি ফেরত আসবে না। মহাশূন্যে নভোযানকে ছেড়ে দেয়ার পর ওটি মহাকাশেই জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। গত কয়েক বছরে প্রফেসর স্মার্ট উমেরায় একটি রকেট ও একটি দুই মিটার লম্বা স্ক্র্যামজেট দিয়ে হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছেন। বিমানটিকে তিনি হাইপারসনিক গতিতে মরুভূমির ওপর চারশ’ কিলোমিটার পথ চালিয়েছেন জয়স্টিক দিয়ে। স্মার্টের লক্ষ্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে আবার কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা। অনেক সাংবাদিকই হাইপারসনিক গতিতে যাত্রা নিয়ে নানান কাহিনী লিখেছেন এবং লন্ডন থেকে সিডনি দুই ঘণ্টায় পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই স্বপ্ন পূরণে নানান প্রস্তাবও এসেছে। তবে প্রচলিত রকেটের সঙ্গে স্ক্র্যাম্পজেট যুক্ত করে সেই স্বপ্নপূরণ সম্ভব কিনা সেটাও প্রশ্ন। স্মার্ট বলেন, যদি প্রমাণ করা যায় যে স্ক্র্যামজেট যাত্রীদের মহাশূন্যে পাঠানোর একটা উপযোগী প্রযুক্তি তার পরে প্রশ্ন আসবে সেই প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করা যাবে। সিডনি থেকে লন্ডনে যেতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হবে কিনা সে আরেক প্রশ্ন। তবে স্মার্ট মনে করেন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিলিয়নকে বিলিয়ন ডলারের দরকার পড়বে না এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ তা সহজেই করতে পারবে। সূত্র : সিবিসি নিউজ
×