ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদ মান্নান

কথা যখন কবিতা নিয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

কথা যখন কবিতা নিয়ে

একটা মাত্র জীবন। জীবের জীবন। এ জীবনের কিছুটা কাটে জাগরণে, কাটে... কিছুটা তন্দ্রায়, কিছুটা ঘুমে, কিছুটা প্রেমে, কিছুটা কামে, কিছুটা আশায়, কিছুটা হতাশায়। আর কিছুটা দেখে দেখে, উড়ে-ঘুরে, অবসরে, আদরে আর অনাদরে, আলোয় আর অন্ধকারে এভাবে এক জীবনের আয়ুতেল ফুরিয়ে যায়, নিভে যায় জীবনপ্রদীপ। কবির জীবন শুধু কি করির?- না। সকল প্রাণের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে কবির জীবন। প্রাণ তো দেখা যায় না। কিন্তু জগতের সব প্রাণ আর অস্তিত্ব ধারণ করেই তো পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার এ কবিজীবন। কোন মহাশূন্যে কোন অনাদিকাল আগে এ জীবনের শুরু হয়েছিল, আবার তার সমাপ্তি ঘটবে সবার মতো তা আমারও জানা নেই। আমি শুধু জানি- জীবনের বোঝা কাঁধে সময়ের জলঘড়ি সারাক্ষণ টিক টিক করছে মাথার ভেতর : অস্থির কাঁটায় তার স্বপ্ন আর ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে : পৃথিবীর অন্তর অলকাজুড়ে ছুটে যাচ্ছে অনঙ্গের অশ্বারোহী জীবনের ছায়া; চিতার আগুনরূপী রূপসীর চোখের কটাক্ষ আর অই মায়াপর্বতের উঁচু গ্রীবা ছুঁয়ে যৌবন কাটে মৌ বনে... একে কী শ্রেষ্ঠ সময় বলা যায়? ... না। কিংবা তারও আগে মায়ের আঁচল ছেড়ে নদীকে বুকের মাঝে তুলে নিয়ে যখন কল্পজগতের গল্পকথা শুনতে শুনতে যে-কৈশোর কাটিয়েছি বনে-জঙ্গলে, ক্ষেতে-খামারে, ঘুড়ির লাটাই হাতে উড়ে গেছি দিগন্ত রেখায়, মায়ের বকুনি খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছি, বাবার পকেট কেটে দেখেছি যাত্রা-থিয়েটার। কীর্তন আর পালা গান শুনতে শুনতে কেটে গেছে সারারাত। সোনার রঙ দিয়ে রাঙানো আমার সেই মধুময় শৈশব আর কৈশোর তো কখনো ফিরে আসবে না। মনে পড়ে : সেই কিশোরের হাতে ছিল এক আকাশের ঘুড়ি; যে ঘুড়ি লাটাই ছেড়ে মহাশূন্যে উড়ে গেছে, বালক কী করে তাকে ফিরে পাবে? আকাশে ফ্যাকাশে মেঘ উড়ে উড়ে খুব ক্লান্ত; শাদা কাফনের মতো ডানাহীন উড়ে যাচ্ছে অবসন্ন মন : বুকজুড়ে ধীরে ধীরে কুয়াশায় নেমে আসছে দীর্ঘ নীল উপেক্ষার সিঁড়ি; তবু দিগন্তে চাষার মতো খালি পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলোহীন যৌবনের আয়ু : যে নদী জলের প্রেমে মত্ত ছিল একদিন অবিরাম মদনকলায়, নিদারুণ খরার দহনে আজ ফেটে যাচ্ছে তার কোমল জরায়ু। সময়কে জড়িয়ে ধরে আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে : হে জীবন! জেগে ওঠো কফিনের কাঠে- তোমাকে গাইতে হবে এক মহাসমুদ্রের গান; তোমাকে সরাতে হবে পৃথিবীর মুখ থেকে রাত্রির নিকাব, তোমাকে সারাতে হবে হৃদয়ের সকল অসুখ, তার সঙ্গে তোমাকে তাড়াতে হবে মনীষার চোখের কুয়াশা। ...একি সম্ভব? সম্ভব। সম্ভব এজন্য : আমার জীবন আমি এ মাটিতে ভূমিষ্ঠের পর থেকে হেবামুলে দান করি এক অন্ধ অদৃশ্য কবিকে। আমিই সেই অন্ধ অদৃশ্য কবি। আমি কখনও কারও মতো কবিতা লিখতে চাই না। আমি আমার কবিতা লিখতে চাই। একটি কবিতা যতক্ষণ না আমার কবিতা হয়ে উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। জোর করে কবিতা লিখি না। খ্যাতির বাজারে উঠে চিৎকার করতে আমার ঘেন্না লাগে। কেউ আমাকে কবি বলুক তাও কিন্তু আমি চাই না। আবার এও স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, কবিতা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ নেই। কবিতাই আমার প্রেম, আমার প্রেমিকা,আমার জীবন। সবার জীবন নিয়ে আমি আমার জীবন গড়েছি। আমার রক্তে মা আর মাতৃভূমি এক হয়ে মিশে আছে। মা এখন মৃত। কিন্তু মাতৃভূমি তার সবকিছু নিয়ে মায়ের প্রতিমা হয়ে সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে আছে। কাজেই আমি হলফ করে বলতে চাই : আমার জীবনবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই সব মহৎপ্রাণের মানুষদের প্রভাব অনুভব করি যারা আমার এ প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালবেসে জীবন দিয়েছেন, একে নির্মাণ করেছেন নিজেদের রক্ত দিয়ে। আর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমি কখনও কারও মতো কবিতা লিখতে চাই না। আমি আমার কবিতা লিখতে চাই। একটি কবিতা যতক্ষণ না আমার কবিতা হয়ে উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। জোর করে কবিতা লিখি না। খ্যাতির বাজারে উঠে চিৎকার করতে আমার ঘিন্না লাগে। কেউ আমাকে কবি বলুক তাও কিন্তু আমি চাই না। আবার এও স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, কবিতা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ নেইÑ। কবিতাই আমার প্রেম, আমার প্রেমিকা। -এ কথা ঠিক নির্বাচিত কবিতাসহ পৃথক পৃথক নামে আমার এ পর্যন্ত দশটি কাব্য রযেছে। এগুলোকে আমি গ্রন্থ বলতে চাই না। কারণ আমার মনে হয়েছে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি একটিমাত্র কবিতা লিখে চলেছি, যা এখনও লিখছি। কাজেই আমার কোন কাব্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়ার মতো লজ্জাজনক কাজটি আমি করতে চাই না। অনেকেই বলে থাকেন যে ‘সৈয়দ বংশের ফুল’ আমার শ্রেষ্ঠ কাজ। পাঠকের যে স্বাধীনতা রয়েছে কবি হিসেবে আমি সেই স্বাধীনতা দাবি করতে পারি না। করাও ঠিক হবে না। তবে অন্যের মুখে যখন নিজের কবিতার প্রশংসা শুনি তখন তো ভাল লাগবেই। মানুষ তো। বছর পাঁচেক আগে ২০১১ সালে রাজশাহী থেকে ‘যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী’ নামে আমার একটি ক্ষুদ্র কবিতার বই বের হয়। অধ্যাপক কবি জুলফিকার মতিন এ বই সম্পর্কে যে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন তার কিছু অংশ পাঠকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই : ‘এটা ঠিক যে, এক বিরূপ-বিশ্বে যেন কবি দাঁড়িয়ে আছেন। প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছেন, রক্তাক্ত হচ্ছেন। আত্মক্ষরণের এক চিতা জ্বালিয়ে রেখেছেন বুকে। তারই অনুষঙ্গ নানাভাবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতার। কিন্তু তা তো ঐ অবস্থার রূপকে পাঠকদের কাছে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। তবে আপন অন্তরকে যখন মেলে দিয়েছেন, তাতে তাঁর দেখা স্বপ্নগুলোই যেন উঠেছে ভেসে ভেসে। সেখানে আমরা পাচ্ছি তাঁর স্বদেশ, তার প্রকৃতি, তার ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক উপাদান। তাঁর ভাব আর ভাবনাগুলো আবর্তিত হয়েছে নদীকে ঘিরে, যে নদী জড়িয়ে রেখেছে তাঁর স্বদেশকেই। পুরান, লোককথা, রূপকথা, ধর্মীয় উপকরণÑ এ রকম যা যা লোকজীবনের সম্পদ, সেগুলোকেও তিনি ব্যবহার করেছেন একজন স্বপ্নচারীর ভঙ্গিমায়। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের স্রোতেই ঘটেছে তার প্রকাশ। জ্বালা আছে, দহন আছে, বেদনা আছে, ক্ষরণÑ সবই আছে, কিন্তু যে রোমান্টিকতা তার প্রকাশকেও মধুর করে তোলে, সেই মাধুর্যই, আমার মনে হয় আসাদ মান্নানের এই কবিতাগুলোর বড় সম্পদ। লোকে জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ যে আবেগ নিয়ে পড়ে, তার সবটুকুই প্রায় পূরণ হবে ‘যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে।... তাঁকে আমি কোন দশকের কবি বানাতে চাই না, তবে তিনি, আসাদ মান্নান, লিখছেন অনেক দিনই। এর আগে তাঁর অনেক কবিতার বই-ও প্রকাশিত হয়েছে। কবি হিসেবে তিনি খ্যাতিমানও বটে। কিন্তু খ্যাতিই বলি আর বেঁচে থাকাই বলি, কালের খেয়াতে তাঁর জায়গা কীভাবে হবে, সে ব্যাপারটা খুবই দুর্জ্ঞেয়। জীবনানন্দ দাশের কথাটা তো বললামÑ অত বড় কবি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে তাঁর ‘রূপসী বাংলা’-ই। এই একটি মাত্র কাব্য-গ্রন্থই উৎস হয়ে যাচ্ছে তাঁর চিরায়ত প্রতিষ্ঠার। কাজেই, কার খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠা যে কোন বিচিত্র পথে হবে, তা তাদের মানে লেখকদের ঠিক করে নেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।’ ২. কে না জানে, শতায়ুর পর শতায়ু লাভের প্রতিযোগিতার স্বপ্ন নিয়েই তো একটি ভাষায় কবি ও কবিতার লড়াই শুরু হয়; অধিকাংশ কবি ও কবিতা দৌড়ের শুরুতেই ছিটকে পড়ে, হারিয়ে যায়। পাঠক পড়ুক বা না-পড়ুক, এদেশে প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছেÑ দৈনিক বা সাপ্তাহিকের সমঝদার সম্পাদকের কৃপায় এসব ছাপাও হয়। আবার এও লক্ষণীয় যে, এসব কবিতা (?) নিয়ে প্রতি বছর অসংখ্য সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়। অবাক বা হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই : প্রকাশের পর আত্মীয় বা দুই-একজন ঘনিষ্ঠজনের হাত ঘুরে এসব বই একদিন পাঠাগারের পরিবর্তে হকারের দাঁড়িপাল্লায় ওঠে, মুড়ি-মুড়কির ঠোঙ্গার পরিণতি লাভ করে, অবশেষে একদিন ডাস্টবিনে সমাহিত হয়। এসব কবি ও কবিতার অকাল প্রয়ানে ইন্নালিল্লাহ্ পড়ার মতো পাঠক থাকেন না। আবার এওতো দেখা যায়, অর্থহীন বা অর্থযুক্ত পুরস্কার বা পদকে ধন্য অতি প্রচারিত, প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাত-অখ্যাত অনেক কবি তাঁদের কলমের কালি শুকিয়ে যাবার আগেই ফুরিয়ে যান, যেমন ইতোমধ্যে অনেকেই ফুরিয়ে গেছেন। আশ্চর্য হবার কিছু নেইÑ কোনও কোনও দেশে এমন শ্রেষ্ঠকবিও (?) দেখা যায়, যিনি হয়তো জীবনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিশ কি পঁচিশটা কিংবা হয়তো তারও কিছু বেশি কবিতা বানিয়েছেন। আমাদের এ কবি ও কবিতার দেশে, বাংলাদেশে এমনও কোনও কোনও আত্মস্বীকৃত শ্রেষ্ঠ কবি আছেন, যিনি নিজের লেখাকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে ঘোষণা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কই, বাংলা ভাষার এমন মহৎ বা শ্রেষ্ঠ কবি বা কবিদের কোনও উৎকৃষ্ট কবিতা পড়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। কী করে মনে পড়বে! মনে রাখার বা মনে পড়বার মতো কোন কবিতা কি এঁরা লিখতে পেরেছেন? আড্ডায় বন্ধুদের কাছে জেনেছি যে, এঁদেরই কেউ কেউ শব্দবিদ্যার চেয়ে ছুরিবিদ্যায় (অনেকেই বলে থাকেন চুরিবিদ্যা) পারদর্শী; এঁদের মেধা ও রুচি এমন যে, এঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে বহু শ্রেষ্ঠ কবিতার অতুলনীয় স্রষ্টায় অভিষিক্ত করেন। এ নিয়ে এঁদের গর্বেরও শেষ নেই। এঁরা গর্বিত চিত্তে আরও বেশি বেশি শ্রেষ্ঠডিম্ব গর্ভে ধারণ করুন। কারও আপত্তি নেই। কেন থাকবে? পাঠকের ভালোবাসার পরিবর্তে যারা মিডিয়ার জোরে বেঁচেবর্তে মর্ত্যধামে নামে-দামে বেশ আছেন অনাগতকালে তাদের পরিণতি সম্পর্কে মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে কি? না। এ ধরনের কবিদের পরিণতি কবিতার প্রকৃত পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। এইসব আত্মতুষ্ট কবিশ্রেষ্ঠ (!) জানুন বা না জানুন পাঠক কিন্তু ঠিকই জানেনÑ পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়। সামাজিক কারণে কবির শত্রু বা মিত্র কবি হতে পারেনÑ তাই কবির শত্রু বা মিত্রকে সহজে চেনা যায়; কিন্তু কবিতার শত্রু-মিত্রকে সহজে কি চেনা যায়? যায় না। কবিতার প্রকৃত পাঠক যিনি তিনিই পারেন শনাক্ত করতে কে কবিতার শত্রু আর কে কবিতার শত্রু নয়। আমি কবি বা কবিতার শত্রু নই, কবিতার একজন অন্ধ মুরিদ। আমার বন্ধুরা জানেন, আমি কখনও কোনও কবির নিন্দা করি না; কারও নিন্দা করা আমার স্বভাবে নেই। কবিতা আমার স্বপ্ন-অন্ন-জল অস্তিত্বের গান। সে-কবিতা অবশ্যই আমার কবিতা নয়, অন্যের কবিতা। যে কোনও কবির উৎকৃষ্টমানের কবিতাগুলোকে আমার নিজের কবিতার মতো ভালোবাসি, গভীর মমতায় নিজের মধ্যে লালন করি। আমার মধ্যে এ নিয়ে কোনও ঈর্ষাবোধ জাগে না। এ জন্যে আমার মনে হয়, একজন কবির একটি কবিতা যখন আমার চোখে পড়ে সেটি তখন আর ওই কবির থাকে না, তা যেন আমারই হয়ে যায়। এইভাবে আমার মনে হয়, হাজার পাঠকের হাতে গিয়ে একটি কবিতা হাজার কবিতা হয়ে ওঠে; একটি কবিতা থেকে এইভাবে হাজার কবিতার জন্ম হয়। কবি ও কবিতা সম্পর্কে আমার এ বোধকে আমি আমৃত্যু সযতেœ লালন করতে চাই। কখনও কখনওÑ বন্ধ্যাসময়ে Ñ নতুন কবিতা লেখার প্রস্তুতি হিসেবে অনেক কবির অনেক কবিতা পড়তে থাকি। সেই স্রষ্টা কবির ওই প্রকৃত কবিতা পড়তে পড়তে আমার ভেতরে অবচেতনে কখনও কখনও কোন এক মহাসমুদ্রের নিচে ঘুমন্ত বাঘের মতো নিশ্চুপ ঘুমিয়ে থাকা আমার অলৌকিক কবিসত্তাটি ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। আমার সামাজিক জীবসত্তা লুপ্ত হয়Ñ আমি কবি হয়ে উঠি; কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। আর এ কবিতা লিখতে চেষ্টা করি বলেই অন্য কোনও কবির নিন্দা করি না, নিন্দা করতে পারি না। এ জন্য পারি না যে, সেই নিন্দা তো আমাকেও ছুঁয়ে যাবে। কেননা, আমি মনে করি, পৃথিবীর সব কবিই মূলত এক অখ- কবিসত্তার অংশবিশেষ। এইভাবে একজন শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট কবির কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকি। আমার বন্ধুরা জানেন : আমার কাছে কেবল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুকবিরা নয়, যে কোনও অগ্রজ বা অনুজ কবির একটিমাত্র কবিতা পাঠ করে যদি আমি প্রাণীত হই, তাকে আমি আমার চেয়েও উঁচুমানের কবি মনে করিÑ তাকে প্রণাম করি, ভালোবাসি। এসব বলার অর্থ এ নয় যে আমি বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি কিংবা পাঠক আমাকে তাঁর প্রিয় কবির তালিকায় স্থান দেবেনÑ হলফ করে বলতে চাই এমন নির্লজ্জ বাসনা আমার ভেতরে নেই। এ পর্যন্ত কবিতার পোশাক পরিয়ে অজস্র্র লেখা বাজারে ছাড়া হয়েছে, এতে কবির সংখ্যা বাড়ে, কবিতার সংখ্যা বাড়ে না। কাজেই কবিরহাটে কবিকে যত সহজে পাওয়া যায়, কবিতাকে পাওয়া যায় না। সাধারণ পাঠক হয়ত এতে বিভ্রান্ত হবেন, প্রকৃত কবি ও কবিতা থেকে পাঠকের দৃষ্টিকে সাময়িকভাবে কিছুটা সরিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু কালের বিচারে প্রকৃত কবি ও কবিতাকে বেশিদিন দূরে রাখা যায় না, যেমন রাখা যায়নি দাশ কবিকে। এ দাশ কিন্তু পশ্চিমবাংলার শ্রীযুক্ত রণজিৎ বাবু নন, আমাদেরই জীবনানন্দ। হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশকে পাঠকের রক্তে মাংসে মেধায় প্রবেশ করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমৃত্যু। একথার মর্ম কী? এর মর্ম হলো : কবির মৃত্যুর পর কবিতার প্রকৃতজীবন শুরু হয়, নতুন নতুন পাঠকের চিত্তে কবিতা পুনর্জš§ লাভ করে। যদি সেটি প্রকৃত কবিতা হয়। প্রশ্ন থেকে যায় : একটি কবিতা কী করে প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠে বা একটি কবিতার মধ্যে কীরকম সৌন্দর্য বা রস সঞ্চিত হলে তা যুগান্তরে পাঠকের চিত্তে সঞ্চারিত হয়, আর এইভাবে কী করে একটি কবিতা কালের শ্রেষ্ঠ কবিতা হয়ে ওঠে? প্রকৃত কবিতাকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে হয়তো আলঙ্কারিকের সহায়তা নেয়া যাবে, কিন্তু একজন কবির শ্রেষ্ঠ কবিতাকে বাছাই করার যন্ত্র বা মন্ত্র কী? একজন কবি কী করে তাঁর আপন ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হয়ে ওঠেন, যদি একে শুধু কথার কথা বলে মেনে না নেওয়া হয়? কবিতার গুণবিচারের স্থির কোনও মানদ- আছে কি? নেই। মেপে, হিসেব করে, ওজন করে কোনও কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করা যায় না, তবে বার বার পড়ে ও বিবেচনা করে, কবিতার বিষয়, বাণী, প্রকাশ ও আরও বহু বিষয় অনুভব, উপলব্ধি ও বিচার-বিশ্লেষণ করে কোনও কবির উৎকৃষ্ট কবিতাগুলো শনাক্ত করা যায়। কিছু কবিতা নিয়ে চিরকালই দ্বিমত থাকতে পারে, কবির ব্যক্তিগত আবেগবশত নিজের কোনও কোনও কবিতা তার কাছে উৎকৃষ্ট বলে মনে হতে পারে, তবে তা উৎকৃষ্ট কবিতা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রজ্ঞা ও মেধাসম্পন্ন পাঠক বা সমালোচকের কাছে ততোটা উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হবে না। আবার এও সত্য যে, একটি কবিতার উৎকর্ষ নিয়ে সমালোচক বা পাঠকভেদে মতভেদ থাকতে পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক; এজন্যে স্বাভাবিক যে, একটি ভালো বা উৎকৃষ্টমানের কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না। একজন পাঠকের পাঠাভিজ্ঞতার বিবেচনায় যে-কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না তাকেই ঐ কবির শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট কবিতা হিশেবে গণ্য করা যায়, যাতে বিষয়, বাণী ও ভাষার চূড়ান্ত সমন্বয় ঘটে, যা পাঠকের আবেগ, উপলব্ধি বা চেতনাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এ কবিতা শুধু ওই কবির রচনাবলীর মধ্যেই উৎকৃষ্ট নয়, যে-ভাষায় কবিতাটি লেখা হয়েছে সে-ভাষার উৎকৃষ্ট কবিতার সারিতে বসার উপযুক্ত। পাঠক অবশ্যই মনে করেন যে কোনও কবির শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট কবিতা শুধু তার ভাল বা মানসম্পন্ন হলে চলবে না, ওই কবিতাকে তার ভাষার আবহমানকালের সমস্ত ভাল বা উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠমানের কবিতার সমতুল্য হতে হবে; সমতুল্য না হলেও অন্তত কাছাকাছি মানসম্পন্ন তো হতে হবে।
×