কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর আগ্রাসন বন্ধের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়নেরও অভিযোগ করেছে সংস্থাটি। রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে ওআইসির সব সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। এছাড়া ওআইসির বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও মিয়ানমারের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার রাজধানীর কুয়ালালামপুরে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান। ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বিশেষ বৈঠকের উদ্বোধন করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি নাজিব রাজাক। এতে বক্তব্য রাখেন ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসুফ আহমেদ আল ওথায়মিন, ওআইসির মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ড. হামিদ আলবার, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো সেরি আনিফা আমান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মালয়েশিয়ায় ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসুফ আহমেদ আল ওথায়মিনের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। ওআইসির বৈঠকের ফাঁকে তুরস্কের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী আহমেদ ইলদিজ ও কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ আল মুরাইখির সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরেন। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওআইসির বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এ সময় শাহরিয়ার আলম রাখাইন রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত ও বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে (মিয়ানমারে) ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ওআইসি দেশগুলোকে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
ওআইসির বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি তুলে ধরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে অস্থিতিশীলতার কারণে রোহিঙ্গা নাগরিকরা স্থানচ্যুত হচ্ছেন। তারা নিজ ভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। এসব নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে জোর দেন শাহরিয়ার আলম।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রোহিঙ্গা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও তুলে ধরেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য তিনি আহ্বান জানান।
বৈঠকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেন ওআইসির মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ড. হামিদ আলবার। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এর নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
ওআইসির বৈঠকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জানতে সহযোগিতা করার বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই সময় তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের কথাও উল্লেখ করেন।
মালয়েশিয়ার স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ায় ওআইসির বৈঠকে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেতৃত্ব নিয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর কাঠামোগত সহিংসতা ও নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন তারা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্য নিরসনে ওআইসির সদস্য দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার তাগিদ দিয়েছে মালয়েশিয়া।
ওআইসির বৈঠকে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সদস্য দেশগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ ঘোষণা দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যও আহ্বান জানান তিনি। এছাড়াও মানবিক সহায়তা এবং সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য মিয়ানমারের সরকারকে ১৭ কোটি টাকারও বেশি (১০ মিলিয়ন মালয়েশীয় রিঙ্গিত) সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া।
ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেতৃত্বকে নিয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেন ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসুফ আহমেদ আল ওথায়মিন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিসংতা নিরসনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ওআইসি মহাসচিব বলেন, সুচির বিজয়ে ওআইসি অনেক আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। ওআইসি মনে করেছিল, ধর্মীয় কিংবা জাতিগত পার্থক্য অতিক্রম করে এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার হবে। তবে সেটা হয়নি।
ওআইসি মহাসচিব বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের যে অগ্রগতি হয়েছে, যেভাবে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী এবং কাঠামোগত সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাগুলো অব্যাহত রয়েছে।
বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্য নিরসনে ওআইসির সদস্য দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো সেরি আনিফা আমান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জীবনের আর্তনাদের কথা তুলে ধরেন। পরিস্থিতির উন্নয়নে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। রোহিঙ্গাদের প্রতি জারি থাকা চলমান বৈষম্য নিরসন করার তাগিদ দেন তিনি।
বৈঠকে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা সঙ্কটকে আর কেবলমাত্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট আকারে দেখার সুযোগ নেই। আমরা আশা করি মিয়ানমারের সরকার ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছে থেকে আসা মানবিক সহায়তা নির্বিঘেœ পৌঁছাতে দেবে। মালয়েশিয়াসহ ওআইসির সব দেশ মিলে ঐক্যবদ্ধ চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে কোন ইতিবাচক ফলাফল আসবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মিয়ানমারের চলমান সহিংসতা অব্যাহত থাকলে এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বৈঠকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মানবিক সহায়তা এবং সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য মিয়ানমারের সরকারকে ১৭ কোটি টাকারও বেশি (১০ মিলিয়ন মালয়েশীয় রিংগিত) সহায়তার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের মতো অবকাঠামোগুলোর উন্নয়নের কাজে এই টাকার একাংশ ব্যয় করা হবে যেন রোহিঙ্গাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা কর্মসূচীর মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবসম্পদ উন্নয়নেও ভূূমিকা রাখার আগ্রহের কথা জানান নাজিব।
তিনি বলেন, আজকের মিয়ানমার প্রযুক্তিগত সহযোগিতা কর্মসূচী গ্রহণের প্রশ্নে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। মানুষের সক্ষমতার উন্নয়নে এই কর্মসূচীতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়, রোহিঙ্গা সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের ক্ষেত্রে সেটা খুবই জরুরী। এ বিষয়ে ওআইসিভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোকেও এগিয়ে আসার তাগিদ দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবল মুসলমান নয়, সব দুর্গত এলাকাতেই এসব সহায়তা দেয়ার প্রত্যয় জানান নাজিব। তিনি মনে করিয়ে দেন, মালয়েশিয়া সেই দেশ, যারা ঘরহারা ৫৬ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছেন। নৈতিকভাবে এই কাজটিই করা উচিত। নিজ দেশে ভয়াবহ সব ঘটনা আর পরিস্থিতি দেখে তারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা মানব পাচারের শিকার হচ্ছে এবং তাদের জঙ্গীবাদে ঝোঁকার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নাজিব রাজাক বলেন, এটি ওআইসির সদস্য দেশগুলোর সামষ্টিক দায়িত্ব। ইসলামী সংহতির বোধ থেকে তাদের প্রতি দায়িত্ববান হতে হবে।
নাজিব রাজাক বলেন, মানবিক সঙ্কট থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে হবে। একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হবে। কোন পদ্ধতিতে এই সঙ্কটের সমাধান হবে তার উত্তর দিতে গিয়ে নাজিব বলেন, মিয়ানমারের সরকারকে হত্যাকা- বন্ধ করা, নারী ও শিশু নিপীড়ন বন্ধ, মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকের আগে নিউইয়র্ক, ব্রাসেলস ও জেনেভায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠক করে ওআইসি। আর কুয়ালালামপুর বৈঠকে ওআইসির ৫৭ দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন।