ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রায় সব শীর্ষ জঙ্গী নিহত, মেজর জিয়া কোথায়?

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

প্রায় সব শীর্ষ জঙ্গী নিহত, মেজর জিয়া কোথায়?

শংকর কুমার দে ॥ বিগত ছয় মাসে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দেশের প্রায় সব ‘মাস্টারমাইন্ড’ পরিচিত শীর্ষ জঙ্গী নিহত। তবে এর মধ্যে এখনও রহস্যে ঘেরা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়া কোথায়, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে সৃষ্টি হয়েছে গোলক ধাঁধার। প্রশ্ন উঠেছে, মেজর জিয়া কি গোয়েন্দা হেফাজতে, না গ্রেফতার? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে বলেছেন, জিয়ার (চাকরিচ্যুত মেজর) অনুসারীদের প্রায় সকলকে ধরা হয়েছে। জিয়ার প্রতিও আমাদের নজরদারি রয়েছে। আমরা তাকে ফলো করছি। যে কোন সময় হয়ত আমাদের নেটওয়ার্কে এসে পড়বে। সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর পালিয়ে জঙ্গী নেতার খাতায় নাম লেখানো সৈয়দ জিয়াউল হকের গতিবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের নতুন নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাতে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পলাতক জঙ্গী মেজর জিয়ার নেটওয়ার্কে চলে আসবে বলার পর আবারও জঙ্গী নেতাদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে তার নাম। নামটি সর্বশেষ আলোচনায় প্রাধান্য পায় গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার পর গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্তকারী পুলিশ বলছে, গুলশানে জঙ্গী হামলার সঙ্গে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া জড়িত। গত ২ আগস্ট জিয়াকে ধরতে মঙ্গলবার ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ধারণা করা হচ্ছে জিয়া দেশেই আছেন। কারণ, একটি মামলার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তার সাংগঠনিক নাম জানা গেছে। আমরা অনেক আগে থেকেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। জিয়াকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণার পর এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন সিটিটিসি প্রধান। ২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরই প্রথম আলোচনায় আসে মেজর জিয়ার নাম। অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই জিয়ার আর কোন সন্ধান মেলেনি। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাসদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কিছু সদস্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর এ চক্রান্ত সেনাবাহিনী জানতে পারে। অভ্যুত্থান চেষ্টার সঙ্গে বিদেশে বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীরা জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের অনেকের সঙ্গে মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের যোগাযোগ ছিল। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও জড়িত। জিয়াকে ধরতে ওই সময় পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় তার শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালায় পুলিশ। রাজধানীর কয়েকটি স্থানেও জিয়ার খোঁজে চলে অভিযান। কিন্তু জিয়া ধরা পড়েছে কিনা বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার পরিকল্পনায় একাধিক ব্লগার, লেখক, ভিন্ন মতাবলম্বী ও ধর্মাবলম্বী খুন হন। গত দুই বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার প্রেক্ষাপটে জিয়ার নাম আলোচনায় আসে। এছাড়া গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুর ঘটনার মূল হোতাদের মধ্যে মেজর জিয়া অন্যতম। তিনি প্রথমে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় দুই শতাধিক সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেন। তিনি দেশেই আত্মগোপনে থেকে সক্রিয়। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ জিয়াউল। আত্মগোপনে থেকে জিয়াউল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ধীরে ধীরে এবিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হয়ে ওঠেন। জিয়াউল হক ছিলেন সেনাবাহিনীরও একজন চৌকস অফিসার। কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে তার। জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটির দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়েও বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাই সবার সঙ্গে মেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করতে তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক গুলশান, শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক সব জঙ্গী হামলার মূল হোতা মেজর (অব) জিয়া ও তামিম চৌধুরীকে ধরিয়ে দিলে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করার পর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তামিম চৌধুরী। কিন্তু মেজর জিয়া এখনও ধরা পড়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। মেজর জিয়াউল হকের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামে। তিনি এক সময় রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসের ৯ নম্বর সড়কের ৫১২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন। জিয়া সর্বশেষ মিরপুর সেনানিবাসের পলাশের ১২ তলায় ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও রহস্যের কূলকিনারা না হওয়ার মধ্যেই রয়ে গেছেন শীর্ষ জঙ্গী নেতা মেজর জিয়া। তিনি কোথায় আছেন-এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব নেই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে। ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষিত এই জঙ্গী নেতাকে ধরতে সারাদেশে অভিযান চালালেও বার বার ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মেজর জিয়া কোথায় থাকতে পারেন, এ বিষয়ে তারা কিছু তথ্য পেয়েছেন। তবে ঘন ঘন স্থান বদল করায় তাকে গোয়েন্দা জালে আটকানো যাচ্ছে না। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ধরা পড়ার আগে তিনি একাধিকবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মেজর জিয়া গোয়েন্দা হেফাজতেই আছেন !
×