ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি

স্বাধীনতাবিরোধীরা ধর্মের নামে সন্ত্রাস চালাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

স্বাধীনতাবিরোধীরা ধর্মের নামে সন্ত্রাস চালাচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করতে ধর্মের নামে সন্ত্রাস চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির রজতজয়ন্তী ও সপ্তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়ে তুলুন’ এ সেøাগান সামনে রেখে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে তিন পর্বে ছিল আনুষ্ঠানিকতা। উদ্বোধনের পর দুপুরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বিকেলে ‘নির্মূল কমিটির ২৫ বছর : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক মূল অধিবেশনে দেশের বিশিষ্টজনরা অংশ নেন। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। মূল অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, দেশে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। মূলত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা না থাকায় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই আগামীর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ধর্মীয় রাজনীতি ও মৌলবাদের উত্থান। এর বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এজন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। ধর্মের নামে সন্ত্রাসে স্বাধীনতাবিরোধীরাÑ রাষ্ট্রপতি ॥ উদ্বোধনী অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আমাদের উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করতে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে কলঙ্কিত করতে চাইছে। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়; এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে ঘর ছাড়তে, দেশান্তরী হতে বাধ্য হচ্ছে। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জঙ্গী দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও নাগরিক সমাজ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করছে তা বহু দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। রাষ্ট্রপতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, কোন অপশক্তি এ গৌরবময় অর্জনকে ম্লান করতে পারবে না। আমাদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ শুধু সংরক্ষণ নয়, এর বিকাশও ঘটাতে হবে- বলেন রাষ্ট্রপতি হামিদ। তিনি বলেন, শুধু ইসলাম নয়, কোন ধর্মই নরহত্যা, সন্ত্রাস, ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করে না। সকল ধর্মের মর্মবাণী হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা এবং সমাজ ও মানুষের কল্যাণ। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই। তাদের পরিচয়, তারা সন্ত্রাসী। এদের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে, হতে হবে ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার দুই দশক পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন গড়ে ওঠা এবং সে আন্দোলনে শহীদ জননী জাহানার ইমামের অবদানের কথাও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও চেতনা সম্পর্কে সচেতন করতে এ আন্দোলন বিশাল ভূমিকা পালন করে। আজ আপনারা এ আন্দোলনের রজতজয়ন্তী উদযাপন করছেন। গত ২৫ বছরে অনেক ঝড়ঝাপ্টা আপনাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। কিন্তু শত বাধা উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থেকে আপনারা এ সময়ে অনেক অর্জনও করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করলেও তাকে হত্যার পর সে বিচার যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সংসদে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত সে বিচার কার্যক্রম আবারও শুরু হয়। সে সময় আবদুল হামিদ ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পীকার। সেদিনের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পুনরায় এ বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। ২০০৯ সালে মহান জাতীয় সংসদে ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। আমার সৌভাগ্য, তখন আমি স্পীকারের চেয়ারে আসীন ছিলাম।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন করেছে। বাঙালী আজ ‘অনেকটা’ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে এ অনুষ্ঠানে পাঁচ শহীদ পরিবারকে সম্মাননা দেয়া হয়। শহীদজায়া লিলি চৌধুরী, পান্না কায়সার, শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, সুচন্দা রায়হান ও সারা মাহমুদকে উত্তরীয় ও ক্রেস্ট দেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে রজতজয়ন্তী ও সপ্তম সম্মেলনের সূচনা করেন রাষ্ট্রপতি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি গোলাম রব্বানী। অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, নর্থ আমেরিকা জুরিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি উইলিয়াম সেøান, ফোরাম ফর সেক্যুলার নেপালের আহ্বায়ক যুবনাথ লামসাল, সুইডিশ মানবাধিকারকর্মী এরিক হুদলান্দ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ‘মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদমুক্ত দেশ গড়ে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ’ ॥ মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধান পরির্বতন করে মৌলবাদ উস্কে দিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের গর্বের উল্লেখ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এ বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিবর্তন ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রেখে সকলে মিলে বাংলাদেশেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। শুভেচ্ছা বক্তব্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধী যে দলেরই হোক না কেন একজনকেও ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল থাকবে। আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। সংবিধান থেকে সামরিক শাসনের স্মৃতিচিহ্ন মুখে দেয়া হবে- এ কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আট বছরে স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী শক্তি অনেকটা কোণঠাসা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির যৌথ ক্লাবের সভাপতি খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করেননি। তাই জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস চলছে। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের বিপদ কাটেনি উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনের আগে যেন আগুন সন্ত্রাসী খালেদা জিয়ার আত্মসমর্পণ ও বিচার শেষ করতে পারি। পাশাপাশি জামায়াত নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন শেষ করতে পারি। বিএনপিকে জঙ্গী উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের কারখানা দাবি করে ইনু বলেন, খালেদা জিয়া হলেন জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষক। আগামী নির্বাচন অনেক কঠিন হবে। তাই মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেন ১৪ দলের অন্যতম এ শরিক নেতা। সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিরোধী দল গঠনে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। জামায়াত-শিবিরের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে নেই উল্লেখ করে সাবেক এ খাদ্যমন্ত্রী বলেন, তারা দেশকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করতে চায়। তাদের কোনভাবেই সফল হতে দেয়া যাবে না। জেএমবিসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, জামায়াতসহ তাদের কমান্ড সেন্টার, নেটওয়ার্ক, অর্থের উৎস চুরমার করে দিতে হবে। তাদের ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনে আরও বিপদ আসবে। সামাজিক মনস্তত্ত্বে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে যাচ্ছে, এটি বিরাট বড় বিপদ বয়ে আনবে উল্লেখ করে এ বাম নেতা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। সর্বশেষ নমুনা হলো পাঠ্যবই থেকে হিন্দু কবি ও লেখকদের লেখা বাদ দেয়া। এটি তো হেফাজতের দাবি ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের পক্ষ থেকে কারা বাস্তবায়ন করেছে তা বের করা দরকার। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করলে সামাজিক পরিস্থিতি আরও অশান্ত হবে। দেশের সরকার ও প্রধান বিরোধী দল হবে মুক্তিযোদ্ধাদের, তাহলে মৌলবাদের দানব রুখতে পাবর। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, সরকারের আন্তরিকতা থাকার পরও সাম্প্রদায়িকতা রোধ করতে পারছি না, এটাই সবচেয়ে বড় অশনি সঙ্কেত। সরকারের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি ঢুকে গেছে। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র তো আছেই। আইএস ও জেএমবি তো দেশবিরোধী তৎপরতায় কাজ করছে। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে হেফাজত যখন সরকারকে ধন্যবাদ দেয় তখন সন্দেহ বাড়ে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, মৌলবাদী গোষ্ঠী দেশকে থামিয়ে দেয়ায় ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। সাংবাদিক হারুণ হাবীব বলেন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ন্যাপের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক পার্থ সারথি চক্রবর্তী বলেন, দেশে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা না থাকায় মৌলবাদ চাঙ্গা হচ্ছে। মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়াই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পাঠ্যবই নিয়ে হেফাজতে ইসলাম যা করেছে এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। মৌলবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ে তোলা এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অপেক্ষা করছে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডাঃ নুজহাত চৌধুরী।
×