ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নেপথ্যে প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক গডফাদার ;###;মেয়রের অনমনীয়তায় পাল্টে গেছে গুলিস্তান মতিঝিলের দৃশ্যপট ;###;অবশ্য ফোকর খুঁজছেন হকাররা- মালপত্র গুছিয়ে রেখেছেন আইল্যান্ডের ওপর

ফুটপাথ দখল ব্যবসায় ॥ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

ফুটপাথ দখল ব্যবসায় ॥ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মতিঝিল থেকে গুলিস্তান হয়ে পল্টন মোড় পর্যন্ত বাসে আসতে কত সময় লাগে। যারা নিয়মিত এ রাস্তায় চলাচল করেন, উত্তর তাদের কাছেই। কম হলেও এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এটুকু রাস্তা পার হতে এত সময়? শাপলা চত্বর থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত আসতে প্রায় কাছাকাছি সময় ব্যয় হয়। তিনদিন ধরে যারা মতিঝিলসহ আশপাশের সড়কে চলাচল করছেন তারা নিশ্চয়ই আনন্দিত। ভাল আছেন। যানজটের আর বিড়ম্বনা নেই। ফাঁকা সড়ক। দেড় ঘণ্টার রাস্তা এখন ১৫মিনিটে পাড়ি দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এ কোন গল্প নয়, সত্যি। বদলে গেছে গোটা মতিঝিল- গুলিস্তানের চিত্র। এক সপ্তাহ আগের চেহারার সঙ্গে এখনকার মতিঝিলের কোন মিল নেই। রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অনড় অবস্থানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছে উচ্ছেদ অভিযান। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ দিনের অভিযানে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এখন অনেকটাই ফাঁকা সড়ক। ফুটপাথে তেমন কোন দোকান নেই। তবে সুযোগসন্ধানী লোকজন এখনও অপেক্ষায়। মালপত্র গুছিয়ে রেখেছেন আইল্যান্ডের ওপর। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ামাত্রই ফের পসরা সাজিয়ে বসার পাঁয়তারা চলছে। তবে যে কোন মূল্যে রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হকার পুনর্বাসনেরও দাবি তোলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সিটি কর্পোরেশনের উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টাও অব্যাহত। গুলিস্তানের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চারটি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ফুটপাথের ব্যবসা। রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। ব্যবসা থাকে আগের মতোই। তবে রাজনৈতিক সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রের কিছুটা পরিবর্তন আসে। নিয়ন্ত্রকরা পছন্দের ব্যক্তিদের ব্যবসায় বসান। স্থান নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে নেতাদের পছন্দের ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। অর্থাৎ যেসব এলাকায় ব্যবসা বেশি সেখানেই জায়গা পান পছন্দের ব্যক্তিরা। বর্তমানে গুলিস্তান ও মতিঝিলে ফুটপাথ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে যেসব সংগঠন কাজ করছে: তৃণমূল হকার্স লীগ, বাংলাদেশ হকার্স লীগ, বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন ও বাংলাদেশ আওয়ামী হকার্স লীগ। এসব সংগঠনের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। হকাররা জানিয়েছেন, চারটি সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছেন আবুল কাশেম, হারুন অর রশিদ, জাকারিয়া হামিদ ও মো. নূরু। সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের ২০ নেতার নিয়ন্ত্রণে গুলিস্তান ও মতিঝিলের ফুটপাথের চাঁদাবাজি। এছাড়া ফুটপাথ বাণিজ্যের গডফাদার হিসেবে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গসংগঠনের মহানগরের এক প্রভাবশালী নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হকার্স ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, বহুমুখী চাঁদাবাজি চলে গুলিস্তানের ব্যবসা কেন্দ্র করে। একদিকে রাজনৈতিক দলের লোকজনের অত্যাচার তো আছেই। মহল্লার মস্তানি ভাতা। উৎসবকেন্দ্রিক চাঁদা। পুলিশকেও প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। পুলিশের পক্ষে চাঁদা তোলেন লাইনম্যানরা। ১১ জানুয়ারি নগর ভবনে এক বৈঠক শেষে মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, রবিবার থেকে সাপ্তাহিক কোন কর্মদিবসে আর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় দিনের বেলায় ফুটপাথে হকার বসতে দেয়া হবে না। হকাররা দোকান নিয়ে বসতে পারবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পরে। তবে ছুটির দিনে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এরপর রবি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় চালানো হয় হকার উচ্ছেদ অভিযান। সোমবার উচ্ছেদের পর হকারদের একটি দল মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দিয়ে আসে। পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ না করা, হকারদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, হকারদের ওপর ‘দমন-পীড়ন’ বন্ধ এবং প্রকৃত হকারদের তালিকা করে পরিচয়পত্র দেয়াসহ ১০ দফা দাবির কথা সেখানে তুলে ধরেন তারা। অন্যদিকে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে মেয়র বলেন, জনগণের চলাচল নির্বিঘœ করতে কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মঙ্গলবারের সমাবেশে মেয়রের ওই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে হকার সমন্বয় পরিষদের নেতা আবুল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী হকারদের উচ্ছেদ করতে বলেননি। প্রধানমন্ত্রী একনেক বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার আলোকে ব্যবস্থা নিন। মেয়র একা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী (বিদেশ থেকে) ফিরে আসুন, স্থানীয় সংসদ সদস্যও বিদেশে আছেন। তারা আইন প্রণেতা। আপনার হকার উচ্ছেদের এ সিদ্ধান্ত অমানবিক। সুইজারল্যান্ড সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তার সঙ্গে দেখা করে হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে স্মারকলিপি দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় সমাবেশে। তবে মেয়রের সঙ্গে বৈঠকে হকারদের কাছ থেকে প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কারা চাঁদাবাজি করছেন সে তালিকা দেয়ারও ঘোষণা দেন হকার্স ইউনিয়নের একাধিক নেতা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিল-পল্টন থেকে হকার উচ্ছেদের পর রাজধানীর এই বাণিজ্যিক এলাকায় চিরচরিত সেই যানজটের দৃশ্য নেই। মাত্র এক মিনিটে ইত্তেফাক মোড় থেকে শাপলা চত্বর আসছে বাস। শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা মোড় এবং দৈনিক বাংলা থেকে পল্টন মোড়ে যাওয়া যাচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে। তবে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে মতিঝিল, পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় হকাররা বসার চেষ্টা করে। সকালে প্রেসক্লাবের সামনে হকারদের বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ ও সমাবেশ কর্মসূচী পালন করে। এসব কর্মসূচী থেকে তারা অবিলম্বে হকারদের পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি হাকার উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত ঘোষণারও দাবি জানান নেতারা। তাদের বক্তব্য, অন্যায়ভাবে হকারদের ওপর জুলুন চালানো হচ্ছে। এ কারণে পথে বসেছে তিন শতাধিক পরিবার। প্রকৃত হকারদের তালিকা প্রস্তত করার কথাও সমাবেশে উঠে আসে। রাস্তায় হকার না থাকলেও দিলকুশা ও মতিঝিল এলাকায় রাস্তার ওপর বরাবরের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং অবস্থায় দেখা গেছে। এতে দিলকুশার ভেতরের রাস্তায় (বঙ্গভবন সংলগ্ন) যানজট এবং পথচারীর চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। মতিঝিল মোড়ে নিউ ভিশন পরিবহনের পনেরোটির বেশি গাড়ি রাস্তার ওপর রাখা হয় সব সময়। এই বাসটি মতিঝিল থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত চলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই পরিবহনের এক চালক জানান, গাড়িটির রুট পারমিট মতিঝিল থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত থাকলেও কোন পয়েন্টেই পার্কিং জোন বা টার্মিনাল নেই। মিরপুর থেকে আসার পর মতিঝিল মোড়ে বাসগুলো থামিয়ে রাখা হয়। একেক করে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মতিঝিলের এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংকসহ ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করে রাখতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা সুমন জানান, ফুটপাথ দখলমুক্ত হওয়ার কারণে মতিঝিলে যানজট কমেছে। অফিসের কাজে বাইরে গেলে এখন আর খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। যাতায়াতে সময়ও কম লাগছে বলে জানান তিনি। সেনা কল্যাণ ভবনে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিপুল জানালেন, গুলিস্তান থেকে মতিঝিল আসতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগে এখন। মতিঝিলে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যানজট নিরসন ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ না করা হলে এক মাসের মধ্যে গোটা মতিঝিলের দৃশ্য পাল্টে যাবে। রাস্তার ওপর পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকার কথা জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রভাবশালীরা এখন পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। নইলে মতিঝিলের মতো ব্যস্ততম সড়কে কিভাবে একটি পরিবহনের গাড়ি পার্কিং বানিয়ে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকে। তবে নটর ডেম কলেজের পাশে ও ইডেন মসজিদের সামনের সড়কে বিআরটিসিসহ বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। বুধবার দৈনিক বাংলার একটি প্রিন্টিং অফিসের কর্মী সাঈদ বলেন, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা এলাকায় এখন কোন যানজট নেই। অথচ গত সপ্তাহেও এই এলাকার রাস্তাজুড়েই ছিল তীব্র যানজট। আর ফুটপাথের ওপর বিভিন্ন ধরনের দোকান বসানোয় হাঁটাই যেত না। তিনি আরও বলেন, এখন ফুটপাথে কোন দোকান না থাকায় চলাচলে সমস্যা হচ্ছে না। রাস্তায় কোন যানজট হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি বর্তমানে মতিঝিল, দৈনিক বাংলা এলাকায় যে অবস্থা বিরাজ করছে এটা যেন অব্যাহত থাকে। কিছুদিন পরই যেন আবার আগের অবস্থায় ফিরে না যায়। সাংবাদিকদের মেয়র সাঈদ খাকন বলেন, মতিঝিল ও গুলিস্তানে হকারদের কাছ থেকে কারা চাঁদাবাজি করে তাদের নাম আমরা জানি। তালিকাও আমাদের হাতে আছে। লাইনম্যানধারীরা আসলেই চাঁদাবাজ। হকার নেতাদের তালিকা অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা মানুষের জন্য করা রাস্তা ও ফুটপাথ তাদের ফিরিয়ে দিতে চাই। এজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে এখন আর এ কর্মসূচী থেকে বিরত রাখা যাবে না উল্লেখ করে মেয়র বলেন, মানুষের প্রয়োজনে আমরা কাজ করে যাব। এক্ষেত্রে কারও কোন সুপারিশ বিবেচনায় নেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খান মোহাম্মদ নাজমুস শোয়েব সাংবাদিকদের বলেন, আমার কাজ নির্দেশ দেয়া। এ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। আমরা নির্দেশমতো কাজ করে যাব। আগামী ১৫দিন অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব এলাকায় আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছি সেখানে যেন ফের হকার না বসে এ বিষয়েও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। হকারদের চৌকিসহ পসরা বসানোর সরঞ্জাম ভেঙ্গে দেয়ার কথাও জানান তিনি।
×