ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

রজতজয়ন্তী থেকে সুবর্ণজয়ন্তীর পথে

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

রজতজয়ন্তী থেকে সুবর্ণজয়ন্তীর পথে

যে কোন দেশের নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে সম্পূর্ণ আদর্শভিত্তিক একটি আন্দোলনের পঁচিশ বছর চলমান থাকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বহু সংগঠন অনেক আন্দোলন করেছে, কখনও কিছু সাফল্যও অর্জন করেছে, কিন্তু একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো হাজারো প্রতিকূলতা- জেল, জুলুম, হত্যা, সন্ত্রাস মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারেনি। পঁচিশ বছর পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই, সাফল্যের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় সংগ্রামের স্মৃতি। প্রথম থেকেই একের পর এক আঘাত এসেছে- কখনও আন্দোলনের একক বা নির্দিষ্ট নেতৃবৃন্দের ওপর, কখনও গোটা সংগঠনের ওপর। সূচনালগ্নে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচারের জন্য নির্মূল কমিটির ২৪ নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছিল বিএনপি সমর্থিত খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। এরপর সরকারের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছি অভাজন আমি। সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার কার্যনির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে আমাকে, গণআদালত আয়োজনের তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই। পেশাগত দক্ষতার কারণেই কিছু দৈনিক আমাকে নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল। সরকারের গোপন হুমকির কারণে কেউ কেউ চূড়ান্ত আলোচনা করেও আমাকে চাকরি দিতে সাহস করেনি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমার ওপর তাদের চূড়ান্ত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে ২০০১ সালে। নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ক্ষমতায় এসেই তারা আমাকে গ্রেফতার করে নিক্ষেপ করেছে ভয়ঙ্কর এক কারাগারে। উচ্চতর আদালতের নির্দেশে দু’মাস কারা নির্যাতন ভোগের পর জামিনে মুক্তি পাওয়ার বছর না পেরোতেই আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। সেবার আমাকে একা নয়, আমার বন্ধু, নির্মূল কমিটির দুর্দিনের কা-ারি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও খালেদা-নিজামীদের প্রতিহিংসা থেকে রেহাই পায়নি। আমার প্রথম গ্রেফতারের পর শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীও জামায়াত-বিএনপির প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। তিনি আমার মুক্তির দাবিতে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে নিজের তিল তিল শ্রমে গড়া উদয়ন স্কুল থেকে। ’৭১-এ যখন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গোলাম হয়ে জামায়াত ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের ঘাতক ‘আলবদর’ বাহিনী দেশের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর স্বামী ডাঃ আলীম চৌধুরীকেও নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ’৭১-এ শ্যামলী ভাবি, আমাদের নির্মূল কমিটির আরেক কা-ারি, হারিয়েছেন তার অর্ধেক জীবন, ৩০ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে হারিয়েছেন তার জীবিকা। নির্মূল কমিটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নিবেদিত নেতাকর্মীরা জামায়াত-বিএনপির সম্মিলিত হামলা ও নির্যাতনের কারণে অনেকে জীবিকাচ্যুত হয়েছেন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, বহু কর্মীকে জীবনও দিতে হয়েছে। এত কিছুর পরও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন তারা স্তব্ধ করতে পারেনি। বরং আরও অনেক সংগঠন, অনেক ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। কারাগার থেকে বেরুবার পর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুনতাসীর মামুনের কলম দ্বিগুণ ধারালো হয়েছে। শ্যামলী ভাবির বাড়ি নির্মূল কমিটির কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজী মুকুল প্রেসের ব্যবসার টাকা অকাতরে ঢেলেছে নির্মূল কমিটির কার্যক্রমে। নিভৃতচারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী অভিমানের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে অশক্ত শরীর নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়িয়ে তরুণ নির্বাচকম-লীকে বলেছেন, ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও নারী ধর্ষণকারী জামায়াতকে কেউ যেন ভোট না দেয়। খালেদা-নিজামীদের আক্রোশী হামলা ও নির্যাতন নির্মূল কমিটিকে আরও শক্তিশালী করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি নির্মূল কমিটি এই বিচারের বিরুদ্ধে যাবতীয় অপপ্রচারের যেমন জবাব দিয়েছেÑ বিচার সম্পর্কে সহযোগী অনেকের বিভ্রান্তি দূর করবার জন্যও অবিরাম লড়ে গেছে। নির্মূল কমিটির আন্দোলনের প্রতি মানুষের আগ্রহ লক্ষ্য করে অনেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। এমনকি এক জামায়াতপন্থী যুবক অস্ট্রেলিয়ার এক আদালতে বাংলাদেশে গণহত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেছিল। সহযোগীদের ধৈর্য ধরে বোঝাতে হয়েছে কেন আমরা প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে, প্রচলিত আইনে বিচার না চেয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার চেয়েছি, যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের আইন করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। জামায়াত সব সময় দাবি করেছে ’৭১-এ তারা গণহত্যা করেনি, আর বিচার করতে হলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নয়, ফৌজদারি আইনে প্রচলিত আদালতে বিচার করতে হবে। কারণ, জামায়াত জানে ফৌজদারি আইনে ‘গণহত্যা’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধে’র কোন সংজ্ঞা নেই। অপরাধের সংজ্ঞা যদি আইনে না থাকে তাহলে সে অপরাধের বিচারও সেই আইনে সম্ভব নয়। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতের সফল কর্মসূচীতে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমাকে আর নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে ডেকেছিলেন এ নিয়ে আলোচনার জন্য। তিনি নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করেছিলেন- গোলাম আযমের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে আপনারা দেশের প্রচলিত আদালতে কেন যাচ্ছেন না? কেন গণআদালত করছেন? পাকিস্তানী গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করবেন- এমত গোপন সমঝোতার মাধ্যমে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া এখনকার মতো এত অসহিষ্ণু ও জামায়াতপ্রেমী ছিলেন না। প্রায় এক ঘণ্টার এই আলোচনার বিবরণ আমার ‘গণআদালতের পটভূমি’ বইয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমাদের কথা শুনেছেন এবং গোলাম আযমের বিচারের জন্য আমাদের প্রচলিত আদালতে যেতে বলেছিলেন। পঁচিশ বছর আগে তাঁকে যে কথা বলেছিলাম, পরে একই কথা বহুবার বহুজনকে বলতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বা শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের মতো ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে সম্ভব নয় আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থায় তা স্বীকৃতি পেয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলায় যে সব ট্রাইব্যুনাল বসেছিল তার উদাহরণ অনুসরণের পাশাপাশি এসব ট্রাইব্যুনালের আইনে যে ঘাটতি ছিল সেগুলো পূরণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত আইনজ্ঞদের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু সরকার অত্যন্ত মানসম্পন্ন এই আইনটি প্রণয়ন করেছিল। জামায়াত ও তাদের সহযোগীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের পরিচিতজনদের অনেকেও বলেছেন- ‘সরকার যদি বিচার না করে আমরা আদালতে যাব।’ বন্ধুদের আমরা অনেক বুঝিয়েছি। তারপরও কেউ কেউ যখন অতি উৎসাহী হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মামলা করতে উদ্যোগী হলেন, তখন আমাদের নেতা বিচারপতি কে এম সোবহান প্রকাশ্য জনসভায় তাদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, আমাদের বারবার বারণ করা সত্ত্বেও কেউ যদি প্রচলিত আদালতে কোনও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সেই মামলাকারীকে আমরা জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসর হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হব। তাঁর এই কঠোর মন্তব্যের পর আমাদের সহযোগী সংগঠনের কেউ কেউ তাকে চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন- এসব তিক্ততাও আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপরও বিভ্রান্তি কাটেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন কম্বোডিয়ার মতো জাতিসংঘের সহযোগিতায় ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের প্রতিনিধি যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তিনি এই বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এটি ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতি। এর কার্যকারণ ও ফলাফল বিবেচনা না করে অনেকে কম্বোডিয়ার মতো হাইব্রিড কোর্ট গঠনের জন্য দারুণ হইচই করেছিলেন। আমরা তখন বিশিষ্ট আইনজীবীদের সমন্বয়ে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশন’ গঠন করে গণমাধ্যমে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম। আমাদের সহজ যুক্তি ছিলÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইন, বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা থাকার পর বিচারিক বিষয়ে জাতিসংঘকে যুক্ত করবার প্রয়োজন নেই। জাতিসংঘ বা অন্য যে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশ ’৭১-এর গণহত্যার তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে, বিচার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করবার জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে পারে- এর বেশি আমাদের প্রয়োজন নেই। এই কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা ট্রাইব্যুনালের গঠনপ্রণালী ও লোকবল সংক্রান্ত অর্গানোগ্রাম তৈরি করে আইনমন্ত্রীকে দিয়েছি। ট্রাইব্যুনাল গঠনে কালক্ষেপণ, যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ এমনকি ট্রাইব্যুনালের স্থান কোথায় হবে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রীকে চিঠির পর চিঠি লিখেছি। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরপরই এর বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের ’৭১ এর গণহত্যা সম্পর্কে আমাদের ১৮ বছরের অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের কয়েক হাজার পৃষ্ঠার জবানবন্দী অর্পণ করেছি। ১৯৯৩ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্মের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য আমরা যে গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিলাম, তারই ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম তাদের তদন্ত আরম্ভ করেছে। দেশে ও বিদেশে জামায়াত এবং তাদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচালের ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে আমাদের বহু সেমিনার, সম্মেলন আয়োজন করতে হয়েছে, ক্রমাগত লিখতে হয়েছে এবং বাংলা ও ইংরেজীতে কয়েক ডজন পুস্তক/পুস্তিকাও প্রকাশ করতে হয়েছে। বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত থাকলেও গত ৭ বছরে অর্ধশতাধিক যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটির অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। বিচারের ক্ষেত্রে আগামীতে আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছেÑ ১) এটি চলমান রাখা, ২) ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, রসদ ও দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি, ৩) সাক্ষী সুরক্ষা আইনসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ৪) অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগসহ ঘাতক ‘শান্তি কমিটি’ ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’, ‘মুজাহিদ বাহিনী’ প্রভৃতির বিচার এবং ৫) পাকিস্তানী ১৯৫ জনসহ পরবর্তীকালে যাদের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের পাশাপাশি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাইকমাণ্ডের বিচার দ্রুত আরম্ভ করা। পঁচিশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ গোটা জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। ২০০৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন। তবে তাঁর সরকারের নীতিনির্ধারকদের সবাই এ বিষয়ে তাঁর মতো আন্তরিক মনে করবার কোন কারণ নেই। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা ঘাপটি মেরে বসে আছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচাল করবার জন্য বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছেন- যা আগামীতে আমাদের শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন আমরা এর কঠোর সমালোচনা করে বলেছি, প্রয়োজনে আমাদের বুকের রক্ত দিয়ে হলেও ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে বিচার বিঘিœতকরণের উদ্যোগ প্রতিহত করব। আগামীদিনে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ। এ বিষয়ে গত চার বছরে আমরা পাঁচ খ-ে দুটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ প্রতিহতকরণের জন্য বি-মৌলবাদীকরণ ব্যবস্থাপত্র প্রণয়নের পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলন যেমন জোরদার করতে হবে, একই সঙ্গে আইনী লড়াইও অব্যাহত রাখতে হবে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, বৈষম্যমূলক আচরণ ও নির্যাতন বিলোপ করে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের রাজপথের লড়াই ও আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের এ লড়াইয়ে প্রতিবেশী দেশসমূহের পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার নাগরিক সমাজের সমচরিত্রের আন্দোলনকে যুক্ত করতে হবে। আমাদের আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই যেখানে ধর্মের নামে হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্য, সন্ত্রাস থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭
×