ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী

তুমি যত উঁচুই হও, আইন তোমার উর্ধে

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

তুমি যত উঁচুই হও, আইন তোমার উর্ধে

শিরোনামের উক্তিটি আমার নয়। বিলেতের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড ডেনিং এক মামলার রায় প্রদানকালে একটি পুরনো উক্তি উদ্ধৃত করে একথা বলেন। ডেনিং সাহেবের এ উদ্ধৃতির মধ্যে প্রতিফলিত রয়েছে অধ্যাপক ডাইসি প্রদত্ত আইনের শাসনের মূল সংজ্ঞা। আর নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায় আবার প্রমাণ করল বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে সত্যিই আইনের শাসন দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং তার ধারাবাহিকতা চলমান। প্রমাণিত হলো যে, যত প্রভাবশালীই হোক, সে আইনের উর্ধে নয়। আরও প্রমাণিত হলো যে, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি বিগত সরকারগুলোর সময় বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে রেখেছিল, তারও অবসান হয়েছে। এ রায় এবং বিগত কয়েক বছরের অন্য কয়েকটি রায় এ বার্তা প্রদান করবে যে ক্ষমতার অন্তরালে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না, অর্থাৎ ডেনিং সাহেবের উক্তি অনুসরণ করতে হবে। বিগত সময় বিচারহীন সংস্কৃতির কথা এ জন্য লিখতে বাধ্য হচ্ছি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি নামক কালো এবং আইনের দৃষ্টিতে অচল তথাকথিত একটি আইন প্রণয়ন করে বিচারহীনতার প্রথম কলঙ্কময় এবং ঘৃণ্য অধ্যায়ের সূচনা করলেন, যার ধারাবাহিকতা চলল জিয়া পরবর্তীকাল, বিশেষ করে তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনকালেও। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে, শাহ কিবিরিয়া হত্যা মামলা নিয়ে, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা নিয়ে কত ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তা ভুলে যাবার নয়। এমনকি ইয়াসমিন হত্যা মামলাও। যে মামলাটি আমি উপ-এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে রাষ্ট্রের পক্ষে পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিচার যেন না হয় তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার, বিশেষ করে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বোন, চকলেট আপা কি না করেছেন সে বিচার বন্ধ করার জন্য। চকলেট আপার কার্যক্রমের প্রতিবাদ করায় পুলিশের গুলিতে আরও কয়েকটি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ ঢলে পরল দিনাজপুর শহরের রাজপথে। এ্যাডভোকেট আব্দুর রহিম, আওয়ামী লীগ দলীয় একজন প্রাক্তন সাংসদ (বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের সদ্য প্রয়াত পিতা) সাহেবের নিরলস এবং আপোসহীন প্রত্যয়ের কারণে এবং ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলামসহ আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অন্য আইনজ্ঞদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে শেষ অবধি মামলাটি দিনের আলো দেখতে পায়। তবে এর মধ্যে কয়েকটি নিরীহ মানুষের প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়ে যায়। এসব কথা হয়ত অনেকেই ভুলে গেছেন। দুজন পুলিশ সার্জেন্ট সাহসিকতার সঙ্গে উদ্যোগী না হলে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাও ভেস্তে যেত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া আরও একটি নিকৃষ্ট মানব রাষ্ট্র পরিচালিত অপরাধের দ্বার খুলে দেন ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে। কত শত ব্যক্তিকে এ অপারেশনের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত খুন করা হয়েছে তার হিসাব হয়ত খালেদা জিয়ার কাছেও নেই। অপারেশন ক্লিন হার্ট ছিল নিছক খুন-ক্রসফায়ার নয়। খালেদা জিয়া শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রকে মানুষ খুন করতে লেলিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, খুনীরা যাতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন তার স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, এসব খুনীর জন্য তথাকথিত ইনডেমনিটি আইন করে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে অপসংস্কৃতির অবসান ঘটেছে- জয় হয়েছে আইনের শাসন এবং তার জন্যই একের পর এক এমন সব আসামির বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে, যারা রাষ্ট্র এবং সমাজ জীবনে এক কথায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলার আসামিরাও তেমনি প্রভাবশালী এবং তাদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এ বিচার আবার প্রমাণ করল দেশে আইনের শাসন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিরাজ করছে, নিম্ন আদালতের বিচারকগণও সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র। তারা মোটেও প্রশাসন বিভাগ দ্বারা প্রভাবিত নয়, প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং যে যত বড় দ--ম-ের কর্তাই হোক না কেন, আইনের শৃঙ্খল থেকে তাদের বাঁচার পথ নেই। এখানে আরও বলতে হয়, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ ধরনের বেশ কিছু প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে যা বার বার প্রমাণ করেছে আইনের শাসনের বাধাহীন প্রবাহের কথা। অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জের মামলাটিই এ ধরনের প্রথম বা একমাত্র মামলা নয়, এটি বহু মামলার একটি। এ মামলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল খুবই দৃশ্যমান। সরকারী উদ্যোগ ছাড়া মামলাটি দিনের আলো দেখতে পেত না। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মূল আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা সরকারের বৈ কারও পক্ষেই আনা সম্ভব হতো না। মামলার তদন্ত করে চার্জশীটও পুলিশই দিয়েছিল। আসামিদের পদচ্যুত করেছিল সরকার এবং তদন্ত বিষয়ে র‌্যাবের সহায়তাও ছিল প্রশংসনীয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারও সরকারের কৃতিত্ব। সুতরাং সরকারও নিশ্চিতভাবে প্রশংসার দাবিদার। যেমনি প্রশংসার দাবিদার সংবাদ মাধ্যম, জাগ্রত জনতা এবং আইনজীবীদের ভূমিকা। যারা বলে থাকেন দেশে আইনের শাসন নেই। প্রশাসন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বাক্সবন্দী, এ মামলা এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অন্যান্য মামলা আবারও প্রমাণ করল তাদের উক্তি মিথ্যা ধারণা প্রসূত। আরও একটি কথা না বলে পারছি না, প্রধান বিচারপতি তার পদের দ্বিতীয় বর্ষপূতি উপলক্ষে এক বাণী দিয়েছেন, যা তিনি এ রায়ে উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, এ ধরনের বাণী দেয়ার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রধান বিচারপতি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। দ্বিতীয়ত, যে মামলাটি ভবিষ্যতে আবারও আদালতেই আসবে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের জন্য, সেই মামলার রায়ের ওপর মন্তব্য করা, যে মন্তব্যের ভাষা আগাম রায় প্রদান করারই শামিল। এর আগে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোন দেশের কোন চাকরিরত বিচারপতিই এমন কোন মামলার রায়ের ওপর কোন আগাম মন্তব্য করেননি, যে মামলা এখনও বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আইন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখা এমন ব্যক্তিও জানেন এ ধরনের আগাম মন্তব্য সম্পূর্ণ বেআইনী, নেচারাল জাস্টিসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং ন্যায়বিচারের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। এর ফলে ন্যায়বিচার বিঘিœত হতে পারে। এ ধরনের উক্তি ন্যায়বিচারের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। দেশের কোন ব্যক্তিই সংবিধান ও আইনের উর্ধে নন। এবং সাংবিধানিক পদের ব্যক্তিবর্গ তাদের শপথ দ্বারা বাধিত ও নিয়ন্ত্রিত।
×