ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মৃত্যুর ধারণা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মৃত্যুর ধারণা

জন্মিলে মরিতে হয়- এই সত্যটি আমাদের সকলেরই জানা। একটি মানবশিশুর আলো-হাওয়ার এই পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্ধারিত নিয়মে সে বেড়ে ওঠে। সময়ের চলার সঙ্গে তাল রেখে তার চলার ধারাবাহিকতা চলমান থাকে। সময়ের গতিতে তার বয়স বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, দেহের বৃদ্ধিও ঘটে নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত। দেহের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বুদ্ধির পরিপক্বতা ঘটে। কিন্তু সবার জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপক্বতা যেমন সমান হয় না, তেমনি বয়সও সমান থাকে না। কেউ আবার অকালে ঝরে যায়। মানুষের বয়স বাড়ে বটে, কিন্তু তার আয়ু কমে যায়। মৃত্যুর শীতল পরশে তাকে এই আলো-হাওয়ার পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয় অন্যলোকে। এই পৃথিবীতে একটি মানবশিশুর আগমন ঘটে মাতৃগর্ভরূপী জাহাজে করে। তারপর পৃথিবীতে বসবাসের জন্য তার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে তাকে পৃথিবীর মায়াবন্ধনের সব জাল ছিন্ন করে দিয়ে চলে যেতেই হয়। হাজার চেষ্টা করেও তাকে ধরে রাখা যায় না। পৃথিবীতে সে রেখে যায় কিছু স্মৃতি, হয়তবা কিছু কীর্তি। সঙ্গে নিয়ে যায় কিছু পাথেয়- যা সে অর্জন করে কর্মের মাধ্যমে। কর্মফলই হচ্ছে মানুষের পাথেয়। সৎকর্মের জন্য সে আখিরাতে লাভ করবে যে প্রতিদান তা হচ্ছে জান্নাত। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ, পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ কর তাহলে ভেবে দেখ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকা হতে, তারপর শুক্র (নুত্ফা) থেকে, তারপর রক্তপি- (‘আলাক) হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোশতপি- (মুদ্গাত) হতে- এ সবই (আমার কুদ্রতের মাহাত্ম্য) তোমাদের নিকট ব্যক্ত করার জন্য। আমি যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি, তারপর তোমাদের শিশুরূপে বের করি- পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও। আর তোমাদের মধ্যে কতক এমন থাকে, যারা যৌবনের পূর্বেই মৃত্যুপ্রাপ্ত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কতক এমনও থাকে, যাদের পৌঁছানো হয় অকর্মণ্য বয়স পর্যন্ত, ফলে যে বিষয়ে তার জানা ছিল, তা সে মনে রাখতে পারে না। (সূরা হজ্জ : আয়াত ৫)। মানব সন্তানের পৃথিবীতে আবির্ভাব এবং তার ক্রমবিকাশ, সেই সঙ্গে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন মানুষের মৃত্যুÑ এটাও আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদ্রতের নিদর্শন। মৃত্যু হচ্ছে জীবনের একটা অবস্থান থেকে আর একটা অবস্থানে চলে যাওয়া। যে কারণে একে ইন্তেকাল অর্থাৎ স্থানান্তর হওয়া বা পর্দার অন্তরালে চলে যাওয়া বলে। ‘আলমে আরওয়া বা রুহসমূহের জগত থেকে একটা বিশেষ পদ্ধতির নিয়মে নির্দিষ্ট মানব সুরতের ভেতর রুহ প্রবিষ্ট হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। পৃথিবীটা হচ্ছে মানব সন্তানদের জন্য আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। পার্থিব জীবন হচ্ছে আখিরাতের জীবনে পৌঁছার জন্য একটি মন্যিল মাত্র। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই জীবনকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমের একটি স্তর হিসেবে অভিহিত করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেছেন যে, একদিন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন : এই পৃথিবীতে তুমি এমনভাবে বসবাস করবে যেন তুমি একজন মুসাফির বা পথিক। যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালবেলার আশা রেখ না এবং যখন সকালে উপনীত হবে তখন সন্ধ্যাবেলার আশা কর না। আর যখন তুমি সুস্থ থাকো তখন তার সদ্ব্যবহার কর এবং মৃত্যুর পূর্বেই তোমার জীবনের সুযোগ গ্রহণ কর। (বুখারী শরীফ)। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : কুল্লু নাফ্সিন্ যায়িকাতুল মাওত, ওয়া ইন্নামা তুওয়াফফাওনা উজুরাকুম্ ইয়াওমাল্ কিয়ামাত- নিশ্চয়ই প্রতিটা আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অবশ্যই কিয়ামতের দিন তোমরা তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় প্রাপ্ত হবে। (সূরা আল ইমরান: আয়াত ১৮৫)। পৃথিবীতে আগমন করাটাই হচ্ছে জন্ম আর এখান থেকে নির্গমন করাটাই হচ্ছে মৃত্যু। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : দুনিয়ার জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগ মাত্র। (সূরা রা’দ : আয়াত ২৬)। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস’উদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেন, একদিন আমি হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম যে, তিনি খেজুর পাতার মাদুরের ওপর শুয়ে আছেন। তাঁর দেহ মুবারকে মাদুরের দাগ পড়েছে। আমি বললাম : ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা ভাল বিছানা পেতে দিতাম। তিনি বললেন, দেখ এতসব কিছুর কি প্রয়োজন? একজন ঘোড় সওয়ার দীর্ঘ পথ চলতে চলতে ক্ষণিক সময়ের জন্য কোন গাছের ছায়ায় এসে বিশ্রাম নিয়ে পরক্ষণেই সেখান থেকে চলে যায়। পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্কও সে রকম। (তিরমিযি শরীফ)। হাদিস শরীফে আছে যে, প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : সুখনাশককে বহুবার স্মরণ কর, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসুলুল্লাহ্, সেটা কি? তিনি বললেন : মৃত্যু, মৃত্যু এবং মৃত্যু। (তিরমিযি শরীফ, নাসায়ী শরীফ, ইবনে মাজা)। হাদিস শরীফে আরও আছে যে, প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মৃত্যুর পূর্বে মরণের জন্য প্রস্তুত হও। (সগীর)। মানুষের পার্থিব জীবন তখনই সুন্দর ও উত্তম জীবনে পরিণত হতে পারে যখন তাতে আল্লাহ্র স্মরণ সর্বক্ষণ অনুরণিত হয় এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহকে সমর্পিত ও নিবেদিত থাকে, রসূলপ্রেমে আপ্লুত থাকে এবং মানবকল্যাণে নিয়োজিত থাকে। এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনে যেজন সর্বক্ষণ অনন্ত জীবনের জন্য পাথেয় সংগ্রহে তৎপর থাকতে পারে মূলত তার জীবনটাই সার্থক। জীবন-মরণ, দুনিয়া-আখিরাত সবই তার জন্য হয়ে ওঠে সুখের, কল্যাণের ও আনন্দের। সে জীবন আসমানী নূর বা অফুরান জ্যোতিতে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জন্মিলেই মরিতে হয়Ñ এটা যেমন অকাট্য সত্য, তেমনি এটাও অকাট্য সত্য যে, মানুষের পার্থিব জীবনের অবসান ঘটতে পারে সুন্দর ও কল্যাণের সঙ্গে, অমরত্ব লাভের সম্ভাবনা নিয়ে এবং অনন্ত জীবনে চির সুখের অধিকারিত্ব নিয়ে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করে নারী, সন্তানসন্ততি, সঞ্চিত স্বর্ণরৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুসম্পদ এবং ক্ষেত-খামারের সঙ্গে আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসব পার্থিব জীবনের ভোগের বস্তু। আর আল্লাহ্ তাঁরই নিকট রয়েছে সুন্দরতম আশ্রয়। (হে রসূল) আপনি বলুন, আমি কি তোমাদের এসবের চেয়েও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলে দেব? যারা মুত্তাকি আল্লাহ্র নিকট তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত- যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে ঝর্ণাধারা। তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে আর সেখানে রয়েছে পবিত্র সঙ্গিনীগণ এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৪-১৫)। পৃথিবীর সব কিছু ছেড়ে অজানা জীবনপথে যে পাড়ি জমাতে হবে এটাই বাস্তব এবং সত্য। এই বাস্তবতা ও সত্যকে আমরা অনেকেই বেমালুম ভুলে যাই পার্থিব মোহের টানে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য- এই ষড়রিপু যেন আমাদের পেয়ে না বসে, অথচ আমরা দেখতে পাই নিত্যদিন নানা বয়সের কত যে মানুষ আমাদের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আমরা ভুলে যাই যে, পৃথিবীতে মানুষের আগমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্র ইবাদত করা, আল্লাহর সৃষ্টির খিদমত করা (খিদমতে খালকা) এবং শান্তির জগত নির্মাণ করা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : বলো, আমার সালাত ও আমার ইবাদত-কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ্ রব্বুল ‘আলামীনের জন্য। (সূরা আন’আম : আয়াত ১৬২)। জীবন-মৃত্যু আল্লাহ্র কুদ্রতের এক অপূর্ব নিদর্শন। মৃত্যুর অলঙ্ঘনীয় শীতল পরশ যখন কোন মানুষের আত্মার ওপর পড়ে তখন পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, দেহ তার সকল কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তার দেহের প্রাণস্পন্দন থেমে যায়, সে তখন হয়ে যায় লাশ, আত্মা বা রুহ্ তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন রুহবিহীন দেহের বাসস্থান হয় ‘আলমে র্বযখ। (বাকি অংশ আগামী শুক্রবার) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×