ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ পাঠ্য হোক

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ পাঠ্য হোক

আজকের প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস জানে না। জানার সুযোগও নেই। বিশাল মুক্তিযুদ্ধের অনেক দিকই তাদের অজানা। আর এই ঘাটতির সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে অনায়াসে মিশে যেতে পারছে জনজীবনে একাত্তরের দালাল, রাজাকার আলবদরসহ যুদ্ধাপরাধীরা। এই পরাজিত শক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠাতে পারছেন। তাদের নামে সড়ক, স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানও হচ্ছে। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় শতবর্ষ আগে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়। বাঙালী সেই কবিতাকে ধারণ করেই স্বাধীনতাকে অর্জন করেছে। কত রক্ত, কত প্রাণ ক্ষয় হয়েছে। কত সম্পদ হয়েছে বিনষ্ট কত তাজা প্রাণ বুলেটে হয়েছে ঝাঁজরা। কত মা-বোন হারিয়েছে সম্ভ্রম সেই একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের নরাধম দোসর রাজাকার আলবদর, দালালদের হাতে। সে এক কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে বাঙালী জাতি। কিন্তু সে সবের কোন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নেই। রচনাও হয় না। কোন উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয় না অথচ বাঙালী জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ একটি উজ্জ্বল ইতিহাস। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ছেচল্লিশ বছরেও রচিত হয়নি। আর তা রচিত হয়নি বলেই বার বার বিকৃতির শিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি। মনগড়া ইতিহাস ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ভুয়া লোকজন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বীরদর্পে সমাজে বিচরণ করছে। ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার কাজটি শুরু হয়েছে পঁচাত্তরের পনরোই আগস্টের পর থেকে। সামরিক জান্তা শাসক জিয়া-এরশাদ এবং পরবর্তীকালের বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের মতো করে বিধৃত করেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। গণহত্যাকারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে হানাদার হিসেবে উচ্চারণেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। নানা বিভ্রান্তির বেড়াজাল ও বিভ্রমের কুয়াশায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও আদর্শ এবং অঙ্গীকারকে ভূ-লুণ্ঠিত করে পাকিস্তানী ভাবধারায় দেশকে যেভাবে ফিরিয়ে প্রায় নিয়েছিল, তাতে হানাদারদের দোসর যুদ্ধাপরাধীরা ও সমাজ, রাজনীতিতে ও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা ক্ষমতার অলিন্দে বসে জনমন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু মুছে দিতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালের দ্রুতগামী সময়ের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলী সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রগুলো নানাভাবে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বহু দলিল দস্তাবেজ জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক গণমুখী ইতিহাস চর্চার ধারাটি বিলীন হয়ে আসছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জাতীয় ইতিহাস পাঠকে আবশ্যিক না করার নেপথ্যে পরাজিত শক্তির কলাকৌশলের ফসল বলা যায়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস পাঠ নামমাত্র। সঠিক ইতিহাস না পড়ানো এবং চর্চাহীনতার কারণে বাঙালী জাতির গৌরবের ইতিহাস যেমন বিকৃত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম তাই অবহিত নয় তার দেশ জাতি ও সমাজের ঐতিহাসিক অবদানসমূহ সম্পর্কে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সাধারণ ইতিহাসের বিকল্প হিসেবে ইসলামের ইতিহাসও ইসলামী শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতিহাস পড়ানো হয় না। দেশের সরকারী কলেজের মধ্যে কয়েকটিতে ইতিহাস পাঠ্য হিসেবে রয়েছে এই করুণ দশা থেকে উত্তরণের কোন প্রক্রিয়া দেখা যায় না। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে স্বাধীনতাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমুন্নত রাখার কথা বলেছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। কিন্তু কে নেবে সে উদ্যোগ- কেউ জানে না।
×