ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আয়তি নাহার

নারী শক্তি উদ্দীপ্তকরণে ‘দঙ্গল’

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

নারী শক্তি উদ্দীপ্তকরণে ‘দঙ্গল’

অসংখ্য দর্শক-শ্রোতার প্রিয় ব্যক্তিত্ব বলিউডের জীবন্ত কিংবদন্তি আমির খান। চলচ্চিত্রপ্রেমী এবং ভক্তদের কাছে তিনি একজন নান্দনিক অভিনেতা, শৈল্পিক-সুষমার সমৃদ্ধ বলিষ্ঠ চরিত্রের এক মহিমান্বিত রূপ। সঙ্গত কারণেই একজন নিবেদিত দর্শক কিংবা ভক্তের পক্ষে এমন একজন নন্দিত নায়কের অভিনয় কৌশল নিয়ে লেখা কিংবা আলোচনা-পর্যালোচনা করা দুরূহ একটি কাজ। আর সেদিকে যাওয়া সম্ভবও নয়। তার সম্পর্কে একটি কথাই বলা যায় ছবি দেখার পর কোন দর্শক যখন নিজেকে পরিতৃপ্তির শেষ কিনারায় নিয়ে যায় সেখান থেকেই এই যুগস্রষ্টা শিল্পীকে যৎসামান্যই মূল্যায়ন করা সঙ্গত। আমির খান একজন নিবেদিত অভিনয়শিল্পী নন্দিত তারকা। দর্শকের পর্বতপ্রমাণ চাহিদায় তিনি এমন ছবি উপহার দেন যার রেশ বছরজুড়ে চলতে থাকে। প্রতি বছরের শেষ মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের শেষ দুই সপ্তাহ তার ছবি দর্শকের কাছে পৌঁছায়। ২০১৪ সালে ‘পিকে’ মুক্তি পায়। কিন্তু ২০১৫ সালে অগণিত ভক্ত আর দর্শক তার অভিনীত কোন ছবি দেখতে না পাওয়ায় হতাশ এবং নিরাশ হয়। পুরো দুই বছর পর তিনি উপহার দেন বহুল আলোচিত ছবি ‘দঙ্গল’। ইতোমধ্যে বলিউডের আর এক দক্ষ অভিনেতা সালমান খানের ছবি ‘সুলতান’ মুক্তি পায়। যার পটভূমি কুস্তি এবং অনেকটাই কাল্পনিক ও আবেগতাড়িত। যার ব্যবসায়িক সাফল্য দাঁড়ায় ৩০০ কোটি রুপীতে। একই বছর আমির খানের ‘দঙ্গল’ ছবিটিও তৈরি হতে থাকে। যার নির্মাণশৈলীতেও কুস্তির ভূমিকা বেশ জোরালো। কিন্তু এখানে কুস্তি স্বপ্নাবিষ্ট কোন গল্প কথা নয়- বাস্তব কাহিনী নিরন্তর গতি পাওয়া এক জীবন ঘনিষ্ঠ শিল্পকর্ম। যা সালমান খানের ‘সুলতান’ ছবির সঙ্গে অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং অবস্থানে। সমমানের কাহিনী সম্ভার নিয়ে দুই দিক পালের ভিন্ন মাত্রার গন্তব্যে পৌঁছা, যা ২০১৬ সালের ক্রান্তি লগ্নে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি এবং তৃপ্তির সুবর্ণ সময়। ‘দঙ্গল’ ছবিটি মূলত এক নিবেদিত পরিশ্রমী পিতার সন্তান বাৎসল্যের এক অনুপম কাহিনীচিত্র। আরও আছে অবহেলিত কন্যা সন্তানের প্রতি এক বলিষ্ঠ পিতার দায়বদ্ধতা। পিতৃত্বের অনবদ্য এক মহিমান্বিত রূপ। কন্যাকে মানুষ ভেবে সামনে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। স্নেহাতিশয্যে পিতৃত্বের দায়িত্ববোধে অবিচল পিতার কঠিন মনোবৃত্তিও উপস্থিত ভক্তদের মুগ্ধ করে। শুধু তাই নয় নারী শক্তি এবং চেতনার উদ্দীপ্ত মহিমা ছবিটির বলিষ্ঠতাও তুলে ধরে। ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নিম্ন মধ্যবিত্তের সাংসারিক জীবন প্রবাহ। কর্তা মহাবীর সিং ফোগাটের এক সময় স্বপ্ন ছিল কুস্তিগীর হওয়ার। কিন্তু দারিদ্র্যতার কষাঘাতে স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক ঘটে। হৃদয়ের নিভৃত গাথা এ স্বপ্ন এক সময় ভাবী বংশধরের মধ্যে বীজ বপন করতে থাকে। এখানেই ঘটনার মোড় পরিবর্তন। কারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কুস্তিতে একচেটিয়া অধিকার কোন পুরুষের এখানে নারীরা একেবারেই শূন্যের কোঠায় ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মহাবীর সিং পর পর চার কন্যা সন্তানের পিতা হন। ফলে স্বপ্ন গুমরে মরতে থাকে। কারণ হরিয়ানার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কন্যা সন্তান মানেই সামাজিক অভিশাপ যাদের শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সব ধররে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাল্যবিয়ে যে সমাজের কঠিন শৃঙ্খল। একটি মেয়ে বড় হতে থাকে সংসার করার মনোবৃত্তি আর তালিম নিয়ে এমনই অপ্রতিরোধ্য অনুশাসনের মধ্যে মহাবীর সিংয়ের কন্যারা বড় হতে থাকে মেয়েদের এই কঠোর নিয়মবিধি থেকে বের করে আনবেন সে চিন্তাও কখনও পিতার ভাবনায় আসেনি। এক সময় পিতা প্রত্যক্ষ করেন বড় দুই কন্যা গীতা এবং ববিতার শারীরিক বলিষ্ঠতা কোন অংশেই ছেলেদের চেয়ে কম নয়। পাড়ার উত্ত্যক্ত করা বখাটেদের উপযুক্ত শাস্তি কিংবা মারপিট করেই দুই মেয়ে ঘরে ফেরে টনক নড়ে বাবারও। নিভৃতে যে স্বপ্ন লুকিয়ে আছে তা নবউদ্যমে জাগতে থাকে। ভাবেন এই দুই মেয়েই তার স্বপ্ন পূরণ করে দেশকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেবে। যেই ভাবা অমনি কাজেও লেগে পড়া। প্রতিকূল সামাজিক অব্যবস্থার সঙ্গে উদ্যোগী, উদ্যমী পিতার লড়াই শুরু হওয়ার কাহিনী ছবির গতিপথকে নির্ণয় করে দেয়। সমাজের এই দুর্ভেদ্য, কঠিন অব্যবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রথমেই মুখোমুখি হতে হয় গীতা এবং কবিতার সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে মা এবং পুরো সমাজের সঙ্গে। কিন্তু দৃঢ়চিত্ত এবং অদম্য পিতার শক্ত লড়াইয়ের পথে কোন বাধাই টিকল না এক সময় দুই মেয়েকেই তিনি সফল কুস্তিগীর বানালেন এবং তারা দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মানের স্বর্ণ এবং সিলভার পদক অর্জন করে পিতার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। পিতার ভূমিকায় অভিনয় করা আমির খানের কোন ব্যক্তিক জৌলুস তার এই কঠিন চরিত্রের ওপর সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারেনি। স্থির প্রতিজ্ঞ আমির খান পিতৃত্বের মহিমা এবং দায়বদ্ধতার যে বলিষ্ঠতার প্রমাণ রাখেন সেখানেই তিনি অনবদ্য এবং যুগান্তকারী। বিশাল এবং অসাধারণ আমির খানের দুই কন্যায় ভূমিকায় যারা নামেন তারাও নবাগতা। শৈশবের গীতার ভূমিকায় অভিনয় করেন জারা ওয়াসিম এবং পরিণত গীতাকে যিনি রূপ দেন তিনি ফাতিমা সানা শেখ, আর শৈশব এবং পরিণত ববিতাকে যারা অম্লান করে রাখেন তারা যথাক্রমে সুহানী বাটনাগার এবং সানাইয়া মালহোত্রা। এই দুই নবাগতরা বলিষ্ঠ এবং দর্শকনন্দিত আমির খানের সঙ্গে অভিনয়ে যে সাবলীলতা এবং পারদর্শিতা দেখায় তা যেমন তুলনাহীন একইভাব অভাবনীয়। আর সেই কারণে গীতা এবং ববিতার অভিনয়ও তাদের পিতার অভিনয় কৌশলের সঙ্গে বেশ মানানসই ছিল যা দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দেয় এবং মুগ্ধতার জায়গার নিয়ে যায়। ছবিটির মূল আকর্ষণ এবং শক্তিই ছিল অভিনয়ের সঙ্গে চিত্রনাট্য এবং সংলাপ। নারী শক্তি উদ্দীপ্তকরণে কিছু সংলাপ তো ছিল একেবারে সাড়া জাগানো সোনা তো সোনাই ছেলে আনুক কিংবা মেয়ে এবং তোমার লড়াই শুধু বিদেশে নয় ঐসব মানুষের সঙ্গেও যারা মেয়েদের অবজ্ঞার চোখে দেখে। আর এ সবের অনেকটা কৃতিত্ব বর্তায় পরিচালক নিতেশ তিওয়ারির ওপর। পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যেসব গানের আয়োজন করা হয় তা যেমন শ্রুতিমধুর একইভাবে দর্শক মাতানোও। প্রচলিত সমাজের সঙ্গে আধুনিক এবং অগ্রগামী এক পিতার অসম লড়াই যা পিতৃত্বের অপরূপ শক্তিতে সফল গতি পায়। আমির খানের ছবি মানেই মুনাফা লাভের এক মহাসমারোহ। ‘দঙ্গল’ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বলিউডের প্রথম ১০০ কোটি রুপী অর্জন করা ছবি ‘গজনী’। ২০০ কোটি রুপীর ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’ পরবর্তীতে পিকে অর্জন করে প্রায় ৩শ’ কোটি রুপী। এবার ‘দঙ্গল’ ৪০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করার অপেক্ষায়। দেখা যাক, সময় কি বলে।
×