ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ

সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রাীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব এবং অর্জিত কীর্তিসূমহ। বহু শতাব্দী ধরে বাঙালী সংস্কৃতি পরিশীলিত এবং বৈদগ্ধ লাভ করে তা কেবল নাগরিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেনি, বরং তা একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জন করেছে। কোন দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা প্রধানত দুটি: নগরসংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির ধারা তিনটি: নগরসংস্কৃতি, গ্রামসংস্কৃতি ও উপজাতীয় সংস্কৃতি। বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। আর আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তাই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। বাংলার লোকসাহিত্য, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য লোকনাট্য ইত্যাদির সঙ্গে ভক্তিবাদ বাঙালী মানসকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করে। ব্রিটিশ আমলে বঙ্গদেশে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এই শ্রেণীও গড়ে উঠেছিল উপনিবেশিক কারণে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বঙ্গীয় গ্রামীণ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারায়, এটা আজ অনস¦ীকার্য যে, নানা শ্রেণীপেশার এমনকি গরিব চাষীরাও শ্রমের ব্যস্ততা আর বিজ্ঞানের যান্ত্রিক সুবিধার সুবাদে যেমন কম বেশি সুবিধা ভোগ করছেন কিংবা, সুবিধার আঁচ পাচ্ছেন, তেমনি বিপরীতক্রমে পুরনো লোক সংস্কৃতির ইতিকথাগুলোও মানুষের স্মৃতির ভা-ার হতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে, মাটির গন্ধ বিশিষ্ট ক্ষণিকের গ্রামীণ বিনোদন বা লোকজ সংস্কৃতির উৎসারিত আনন্দের পরিতৃপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমিয়ে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের ধরনও। কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থেই এই বিলুপ্তপ্রায় লোকসঙ্গীত বা লোকগানগুলো টিকিয়ে রাখা দরকার। আমাদের লোকসাহিত্য বেশ প্রাচীন। বিশ্বের প্রায় সব ধারার লোকসাহিত্যের উপাদানই বাংলা ভাষায় বিদ্যামান। বাংলায় লোককাহিনী, লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন, প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যের প্রচলন আছে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসঙ্গীতের প্রচলন আছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, গম্ভীরা, ঘাটু, ঝুমুর, যাত্রা, আলকাপ, লেটো, ধামালি খেমটা প্রভৃতি ধারার শত শত গান আজও প্রচলিত আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আবার অনেক ধরনের লোকসাহিত্য আজ একেবারে হারিয়ে গেছে আমাদের সমাজ থেকে। মুখ্যত কৃষকসমাজই লোকসাহিত্যের স্রষ্টা ও ধারক-বাহক। এর সঙ্গে গো-মহিষের রাখাল, নৌকার মাঝি-মাল্লা, গায়ক সম্প্রদায় বাউল, ফকির-বৈরাগী ও পেশাজীবী বেদে-বেদেনীরা লোকসঙ্গীতের চর্চা করে থাকে। লোকচিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ওঁঝা ও মন্ত্রগুপ্তিরা মন্ত্রের চর্চা করে। তবে বাঙালী জাতি চিরকালই বিনোদন প্রিয়। গ্রাম কিংবা শহরে যে কোন জায়গায় গান-বাজনার শব্দ পেলে আমরা সেখানে না গিয়ে থাকতে পারি না। তাই তো এখনও এই কনকনে শীতের রাতেও কোথাও যাত্রা হলে ব্যাপক লোক সমাগম লক্ষ্য করা যায়। আমাদের উত্তরাঞ্চালে এখনও বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা, আলকাপ, গম্ভীরার মতো ঐতিহ্যবাহী এই বিনোদন মাধ্যমগুলো টিকে আছে। মানুষ এগুলোকে ভালবাসে বলেই আছে। যদিও এখন যাত্রার মাঝে অনেক অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে তাই রুচিশীল দর্শক অনেকে যাত্রা দেখতে যায় না। আমি নিজেও জীবনে বহু যাত্রা দেখেছি। প্রচ- শীতের রাতে সারারাত জেগে যাত্রা উপভোগ করতাম, ফেরার সময় বন্ধুদের বলতাম এটাই শেষ এত কষ্ট করে আর আসা যাবে না কিন্তু ক’দিন পরে সেই কথা ভুলে যেতাম। তবে দীর্ঘদিন অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিকের পরে আর যাত্রা দেখা আমার হয়নি। যাত্রার মতো ‘আলকাপ’ আরেকটি বিনোদনভিত্তিক লোকসংস্কৃতি। এটি পুরোপুরি বিলুপ্তি না হলেও এখন খুব একটা দেখা যায় না। আলকাপ মূলত সঙ্গীতধর্মী নাট্যানুষ্ঠান। আলকাপের মূল অনুষ্ঠান হলো কাপ অর্থাৎ নাটক। কাপকে সঙ বলা হয়। আলকাপের নাটক ব্যঙ্গ রসাত্মক। তাই প্রচুর হাস্য কৌতুকের আয়োজন থাকে। আলকাপ মূলত বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম অঞ্চলে এই গানের প্রচলন আছে। ১৯৮২ সালের ২১ আগস্ট কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকায় বাংলা ভাষার এক প্রখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আলকাপ গানের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল ‘আলকাপ, নাট্যরীতি এবং আর্ট থিয়েটার’। তারপর থেকেই আলকাপ গানের পরিচিতি অনেকটা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৩২টি উপজাতি। উপজাতীয় সংস্কৃতি এক অর্থে লোকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত। উপজাতীয় সংস্কৃতি অধিক মাত্রায় রক্ষণশীল, পরিবর্তনবিমুখ ও ঐতিহ্যপন্থী। অর্থাৎ তারা তাদের সংস্কৃতির অনেকটাই ধরে রেখেছেন। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের মানুষের মনেপ্রাণে এখনও বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত জায়গা করে আছে। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতি ও স্মার্টফোনের এ যুগে আমাদের নিজস্ব এসব সংস্কৃতি কতদিন টিকে থাকবে তা ভাবার বিষয়। জাতীয় স্বার্থেই এসব সংস্কৃতি আমাদের রক্ষা করা উচিত।
×