ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম পান্ডে

’দ্য টেম্পেস্ট’ অনুসৃত ‘অচীন দ্বীপের উপাখ্যান’

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

’দ্য টেম্পেস্ট’ অনুসৃত ‘অচীন দ্বীপের উপাখ্যান’

উইলয়াম শেক্শপিয়ার ‘দ্য টেম্পেস্ট’ লিখেছিলেন ১৬১০ থেকে ১৬১১ সালের দিকে। অবশ্য কিছু গবেষকের মতে রচনার সালটি আরও আগে। এ নাটকটি তাঁর জীবনের শেষদিকের রচনা। নাট্যকাহিনি গড়ে উঠেছে একটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে। শেক্শপিয়ার একজন বৈশ্বিক নাট্যকার। মানুষের মানবিক অন্তর্ঘাতই তাঁর অধিকাংশ নাটকের বিষয়বস্ত। ‘দ্য টেম্পেস্ট’ অনুসৃত নাটক ‘অচীন দ্বীপের উপাখ্যান’। ড. মুকিদ চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত এ নাটকটি মঞ্চে এনেছে প্রতীক থিয়েটার। সম্প্রতি শিল্পকলায় নাটকটির এক বিশেষ প্রদর্শনী হয়। নাটকের বিষয়বস্তু হচ্ছে, রাজত্ব থেকে নির্বাসিত রাঢ়ের অধিপতি বিজয় সিংহকে কন্যা সুকৃতির সঙ্গে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বঙ্গোপসাগরে। ভাসতে ভাসতে তারা সিংহল দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেক বছর। একদিন, হঠাৎ, যুবরাজ সুখময়সৈন্য, রাজভ্রাতা দয়ালসৈন্য, অঙ্গরাজ্য রাঢ়ের অধিপতি সুমিত্র সিংহ(বিজয় সিংহের ভ্রাতা), প্রবীণ অমাত্য গঙ্গা দলবলসহ প্রাচ্য-গঙ্গার মহারাজাধিরাজ উগ্রসৈন্যের বিশাল নৌকা বঙ্গপ সাগরে, সিংহলের পথে, প্রচন্ড ঝড়ের মুখে পড়ে। চারদিকে মেঘের গর্জন। সারেং অধৈর্য হয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে শ্বাস টানতে থাকে আর মাঝিদের তাড়া দিতে। মহারাজাধিরাজ ও তার দল অতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। এক সময় বিশাল নৌকা থেকে আরোহীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সমুদ্রের বুকে যখন এই ঘটনাটি ঘটে চলেছে ঠিক তখনই আরোহীদের আতঙ্গের চিৎকারে রাঢ়ের প্রকৃত রাজা বিজয় সিংহকে তার কন্যা সুকৃতি অনুরোধ জানায় তাদের রক্ষা করার জন্য। সুকৃতিসহ রাজা বিজয় সিংসকে কীভাবে পথের কাঁটা হিসেবে তাকে নির্মূল করার জন্য প্রাচ্য-গঙ্গার মহারাজাধিরাজ উগ্রসৈন্য রাঢ় থেকে কিভাবে বিতাড়িত করেছিলেন তা বর্ণনা করেন। সুকৃতি মান-অভিমানের কারণেই তার পিতা স্বীকার করেন যে, তিনিই তার পুরনো শত্রুদের সুকৌশলে এই দ্বীপে নিয়ে এসেছেন, উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তারপরই নাটকের কাহিনী মোড় খায়। শুরু হয় সুকৃতি ও যুবরাজ সুখময়সৈন্যের প্রেম গাঁথা। সবকিছুই ঘটে বিজয় সিংহের পরিকল্পনা মতো। যুবরাজ সুখময়সৈন্যকে সুকৃতি ভালোবেসে তার মনের বাসনা পূর্ণ করে। বিজয় সিংহ স্পষ্টই বুঝতে পারেন, দুজনে দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে তাই তার পরিকল্পনা অনুসারে তাদের বিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। তখনই সুখময়সৈন্য তার পিতা মহারাজাধিরাজ উগ্রসৈন্যের সন্ধান পায়। মহারাজাধিরাজ তার ভুল স্বীকার করেন এবং বিজয় সিংহের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নির্বাসন, প্রতিশোধ, ক্ষমা ও প্রায়শ্চিত্তের সঙ্গে নাটকের উপাদানে যোগ হয় মায়াবিদ্যা ও অতি প্রাকৃতিক জৈবশক্তি। বিজয় সিংহ একজন সত্যের পূজারী। লোভ ও বিলাসিতার অনেক ঊর্ধ্বে। কণ্ঠে তার পরিশীলিত বিনয় বচন। এই নাটকে হাস্যরসের ব্যবহারের মাধ্যমে চা-বাগানের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। এই হাস্যরসের সৃজনকারী হচ্ছে হরহরি, ত্রিকোণ ও বিশ্রী নামের তিন ব্যক্তি। তাদের কথাপোকথন শুনে বিজয় সিংহ খুবই আনন্দিত হন। নাটকের এই হাস্যরস, বিশেষ করে তাড়ির নেশা, সৃষ্টিতে চা-বাগানের ভাবগম্ভীর সঙ্গীত অনেক সাহায্য করে। আর কুবেণীকে দিয়ে পরাধীনতার বিপক্ষে মুক্তির জয়গান সৃজন করা হয়েছে। কুবেণী যদিও বিজয় সিংহের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেও সে জানে, দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে শাসকরা আনন্দ পায়, বিজয় সিংহও এর বাইরে নন। কুবেণী চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় শোষিতদের মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষও বটে। কিন্তু কুবেণী স্বাধীনতার দাবিদার। বিজয় সিংহের প্রতি দায়িত্ব পূরণ করার পরে অবশেষে সে মুক্তি লাভ করে। নাটকের শেষ বাক্যটি মুক্তির জয়গানই করে, ‘কুবেণী, তোমার সেবা ও যতেœ আমি [বিজয় সিংহ] মুগ্ধ হয়েছি; তাই তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। আর আমি এই দ্বীপে মুক্তভাবে শেষজীবনটা কাটিয়ে দেব। ‘অচিন দ্বীপের উপাখ্যান’-এ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই দেখানো হয় যে, একই ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যথাক্রমে ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, জাতিগত মানদন্ড ও মূল্যবোধ অনুসারে, যেখানে গৃহীত মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয় পুনঃস্থাপনের ওপর ভর করে, যা চিহ্নিত করে একটি পুনর্র্নিমাণ কাঠামো, এই পুনর্র্নিমাণ কাঠামো তৈরি হয় একটি সংস্কার-ধারার মাধ্যমে। নাটকে চা-বাগানের সঙ্গীত রচনা করেছেন ডা. সুনীল বিশ্বাস। ‘টেম্পেস্ট’ অনুসৃত হলেও নাটকটিতে বাংলা নাট্যমঞ্চ বৈশিষ্ট্যের আবহ বিদ্যমান ছিল। বাংলা নাট্যের পরিবেশনা বৈশিষ্ট্যে প্রতিটি চরিত্র ও অনুষঙ্গই সর্বক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত। অর্থাৎ আসরের মতো মঞ্চের কলা-কুশলী বেশিরভাগ সময়ে মঞ্চের আপস্টেজে অপেক্ষমাণ। ঘটনা প্রবহমানতায় স্ব স্ব চরিত্ররূপ নিয়ে নাট্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। পোশাক পরিকল্পনায় নৈর্ব্যক্তিকতার চমৎকার ব্যবহারের মাধুর্যে স্থান-কাল প্রেক্ষিত উপেক্ষা করে চরিত্র ও বিষয় হয়ে উঠেছে সর্বকালের। আলোক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য অসাধারণ। সঙ্গীত ও কোরিওগ্রাফি পরিকল্পনায় বাংলার ঐতিহ্যবাহীকতা কুশলতায় অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছে। তবে নাট্য সংলাপের উচ্চারণ ও আপেক্ষিকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নমানের হয়েছে। অভিনয়-আলো-সঙ্গীত থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি বিষয়ই সাবলিলভাবে উঠে এসেছে এতে। এমন নান্দনিক প্রযোজনায় প্রতীক থিয়েটার নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
×