ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আরও কয়েকটি মামলা দায়ের

নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আরও ২৪ মামলা এখনও বিচারাধীন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আরও ২৪ মামলা এখনও বিচারাধীন

আরাফাত মুন্না/মোঃ খলিলুর রহমান ॥ নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা আরও ২৪ মামলা এখনও বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে নয়টি মামলায় বিচারিক আদালতে খালাস পেলেও উচ্চ আদালতে এসব মামলার বিচার চলছে। এসব মামলার মধ্যে সাত খুনের ঘটনার পরেও দায়ের হয়েছে বেশ কয়েকটি। এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের একটি মামলায় গত বছর তার এক বছরের কারাদ-ও হয়েছিল। এসব মামলার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, নিহত প্যানেল নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেনের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ ১৭ বছরের। মূলত ১৯৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জয়-পরাজয় নিয়ে এবং শিমরাইল মোড়ে অবস্থিত সড়ক ও জনপদ বিভাগের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে। কাঁচপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি, নদী দখল, মাদক ব্যবসাসহ অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা। যা এখনও তার সহযোগীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ সদর ও ফতুল্লা মডেল থানা এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় চাঁদাবাজি, বিস্ফোরক, মাদক, ভূমি দখলসহ বিভিন্ন ধারায় ২৪টি মামলা ছিল। কিছু মামলায় জামিনে রয়েছেন নূর হোসেন। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী নূর হোসেনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের হয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ধারা ৩/৪ এ মামলা নং- ১৮(৬)৯২ হয়। এরপর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একের পর এক মামলা হলেও নূর হোসেনকে দমানো যায়নি। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলাগুলো হচ্ছে- মামলা নং ১৩(৩) ৯৬, ধারা- ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৬/৩০৭/৩০২/১১৪ দ-বিধি সহ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ধারায় দায়ের করা হয়। এছাড়াও মামলা নং ১৫(১০)৯৬, ধারা- ১৪৩/৩২৩/৩৪৪/৩৭৯/১১৪ দঃ বিঃ। মামলা নং ১(২)৯৭, ধারা- ১৪৭/১৪৮/৪২৭/৩২৩/৩৫৩/১৮৬ দঃবিঃ। মামলা নং ১০ (১)৯৮, ধারা- ১৪৩/৩৪৪/৩০৭/৪২৭/৩৪ দঃবিঃ তৎসহ বিঃদ্রঃ আইনের ৩ ধারায়। মামলা নং ৩৬(১২)৯৯, ধারা- বিঃদ্রঃ আইনের ৩ ধারায়, মামলা নং ২১ (৯)০০, ধারা- ১৪৩/৪৪৭/৪২৭ দঃবিঃ, মামলা নং ২৩(৭)০১, ধারা- ১৪৩/৩৩৩/৩৫৩/৩৩২ দঃবিঃ। মামলা নং ২১ (৯)০১, ধারা- ১৪৩/৪৪৭/৪২৭ দঃবিঃ, মামলা নং ২ (১০)০১, ধারা- ১৪৩/৩৪৪/৩২৩/৫০৬ দঃবিঃ। মামলা নং ৪ (১২)০১, ধারা- ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩৪২/৩৫৩/৩৭৯/৪২৭/৩০৭/১১৪ দঃবিঃ। মামলা নং ৬ (৪)০২, ধারা- ১৪৩/৫০৬ দঃবিঃ তৎসহ বিঃদ্রঃ আইনের ৩ ধারায়, মামলা নং ৩৬ (০২)১১, ধারা- ৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৭৯/৫০৬ দঃবিঃ রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় ৫টি ও ফতুল্লা থানায় ৫টি এবং পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ৬টি জিডি রয়েছে বলে জানা গেছে। মামলা করে রোষানলে পড়েছিলেন বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা ॥ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে নূর হোসেন ও তার লোকজন গড়ে তোলেন বালু ও পাথরের ব্যবসা। নদী দখল করে নূর হোসেন ও তার লোকজন ব্যবসা করতেন। হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শীতলক্ষ্যার তীর অবৈধভাবে দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলার অভিযোগে নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ২০১০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেছিলেন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের তৎকালীন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। মামলায় সরকারী কাজে বাধাদান, সরকারী কর্মকর্তাদের হুমকি দেয়া এবং নদীতীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগ আনা হয়। গত কয়েক বছরে ওই দখল উচ্ছেদে আট-দশবার অভিযান চালানো হয়। ওই সময়ে মামলা করে নূর হোসেনের রোষানলে পড়তে বাধ্য হন ওই কর্মকর্তা। মামলা দায়ের করার পর কাঁচপুর আসলেই নূর হোসেন ও তার লোকজনের রোষানলে পড়তে বাধ্য হন। যে ভাবে নজরুল-নূর হোসেন বিরোধ ॥ সাত খুন মামলার নথি থেকে জানা গেছে, নিহত প্যানেল নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেনের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ ১৭ বছরের। মূলত ১৯৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জয়-পরাজয় নিয়ে এবং শিমরাইল মোড়ে অবস্থিত সড়ক ও জনপদ বিভাগের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। দু, জনের দ্বন্দ্বে ১৯৯৬ সালের মার্চে শিমরাইল মোড়ে নিহত হন আওয়ামী লীগ কর্মী আলী হোসেন। সেই মামলায় নূর হোসেন ও তার লোকজন আসামি হলেও আদালত থেকে খালাস পান সবাই। নজরুল ও নূর হোসেনের দ্বন্দে¦র খেসারতে গুলিতে নিহত হন জহিরুল ইসলাম নামে আরেক সবজি বিক্রেতা। অপরদিকে ৯৯ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে নজরুলকে হত্যা করতে এসে ভুলবশত গুলি করে হত্যা করা হয় নজরুলের সমর্থক ও তার বন্ধু যুবলীগ নেতা আবদুল মতিনকে। এভাবে দিনের পর দিন নজরুল ও নূর হোসেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। এরপর একে অপরকে কিলার দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়। সর্বশেষ সফল হয় নূর হোসেন। আরও জানা গেছে, নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেন দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। নজরুল ২ ও নূর হোসেন ৪নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বিরোধ চলেছিল। একে অপরকে মেরে ফেলার চেষ্টাও কম ছিল না। ১৯৯৮ সালে নজরুল বাহিনীর করা ৩টি গুলি বিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান নূর হোসেন। আবার নূর হোসেন বাহিনীর হামলা ও হত্যা চেষ্টার ভয়ে অপহরণের ২ মাস আগে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন নজরুল। ২০১২ সালে পহেলা বৈশাখে নজরুল তার এলাকায় আয়োজিত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেন নূর হোসেনকে। নূর হোসেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পর সিদ্ধিরগঞ্জবাসী কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু এই স্বস্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নথি থেকে আরও জানা গেছে, নানা বিষয় নিয়ে আবার দুজনে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর দুজনই স্ব স্ব এলাকায় ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে। গত ২ বছরে নূর হোসেন তার নিজের নামে ২টিসহ ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়। বহু আগ থেকেই নজরুলের লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। নজরুল নিহত হওয়ার ৪ মাস আগ থেকেই তাদের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ১ ফেব্রুয়ারি ২নং ওয়ার্ডে একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ নিয়ে নূর হোসেনের খালাত ভাই মোবারক আলীর সঙ্গে নজরুল ইসলামের তর্ক হয়। নূর হোসেনের কাছে খবর যায় নজরুল তার ভাইকে মারধর করেছে। নূর হোসেন বাহিনী নজরুলের এলাকায় হানা দেয়। মারামারি ভাংচুরের এক পর্যায়ে নজরুল পিছু হটেন। ওইদিন গভীর রাতে মোবারক আলীর ছেলে বাদী হয়ে নজরুলকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করেন। পুলিশি গ্রেফতার ও নূর হোসেন বাহিনীর হামলার ভয়ে অনেকটা আত্মগোপনে চলে যান নজরুল। অভিযোগ রয়েছে, র‌্যাব-১১-এর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে নূর হোসেন ও নজরুল দুজনেরই সম্পর্ক তৈরি হয়। গত ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ইং তারিখে ওই মামলায় হাজিরা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে নজরুল ও তার সঙ্গীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করে। এরপর ৩০ এপিল ও ১ মে এক এক করে ৭ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
×